দান্ডি যাত্রা, যাকে লবণ সত্যাগ্রহও বলা হয়, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন ছিল। মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে ১২ মার্চ ১৯৩০ সালে এটি শুরু হয়েছিল এবং ৬ এপ্রিল ১৯৩০ সালে গুজরাটের দান্ডি গ্রামে লবণ আইন ভঙ্গের মাধ্যমে শেষ হয়েছিল। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক আরোপিত অন্যায় লবণ করের (Salt Tax) অহিংস প্রতিবাদ করা।
এটিকে ভারতে সবিনয় অবাধ্যতা আন্দোলনের সূচনা বলে মনে করা হয়, যা ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে জনসচেতনতাকে নতুন দিশা দিয়েছিল। এই আন্দোলনের অধীনে গান্ধীজী এবং তাঁর ৭৮ জন অনুসারী ২৪১ মাইল (৩৯০ কিমি) পদযাত্রা করেছিলেন, যাতে হাজার হাজার ভারতীয় ধীরে ধীরে যোগ দিয়েছিলেন। এই যাত্রা কেবল ভারতেই নয়, বিশ্বের সর্বত্র ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী বার্তা প্রেরণ করেছিল।
পটভূমি এবং কারণ
ব্রিটিশ সরকার ভারতে লবণ উৎপাদন এবং বিক্রয়ের উপর একচেটিয়া কর নিয়ন্ত্রণ করেছিল। এই একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণের কারণে ভারতীয়দের নিজেদের দেশে লবণ কিনতে অতিরিক্ত কর দিতে হতো। দরিদ্র মানুষের জন্য এই কর ছিল অতিরিক্ত অর্থনৈতিক বোঝা, কারণ লবণ ছিল একটি প্রয়োজনীয় জিনিস। মহাত্মা গান্ধী এটিকে অন্যায়, নিপীড়নমূলক এবং অমানবিক কর বলে অভিহিত করেছিলেন।
তিনি এটিকে ব্রিটিশ শোষণের প্রতীক মনে করে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল যে, যদি ভারতীয় জনতা সবিনয় অবাধ্যতার মাধ্যমে এই আইন ভঙ্গ করে, তাহলে ব্রিটিশ সরকারের ভিত্তি কেঁপে উঠতে পারে।
যাত্রার সূচনা এবং পথ
১২ মার্চ ১৯৩০ সালে মহাত্মা গান্ধী ৭৮ জন অনুসারী নিয়ে সাবরমতী আশ্রম (আহমেদাবাদ, গুজরাট) থেকে দান্ডি (গুজরাটের সমুদ্র উপকূলে অবস্থিত গ্রাম) অভিমুখে ২৪১ মাইল (৩৯০ কিমি) দীর্ঘ পদযাত্রা শুরু করেন। এই যাত্রা ২৪ দিন ধরে চলে এবং পথে হাজার হাজার ভারতীয় এতে যোগ দিয়েছিলেন। গান্ধীজী এবং তাঁর অনুসারীরা প্রতিদিন ১০-১৫ মাইল পদব্রজে চলতেন এবং পথে গ্রামে গ্রামে থেমে লোকজনকে ব্রিটিশ আইনের বিরুদ্ধে অহিংস প্রতিবাদ এবং সবিনয় অবাধ্যতার প্রেরণা দিতেন।
৬ এপ্রিল ১৯৩০ – আইন ভঙ্গের ঐতিহাসিক দিন
৬ এপ্রিল ১৯৩০ সালে গান্ধীজী তাঁর অনুসারীদের সাথে গুজরাটের দান্ডি সমুদ্র সৈকতে পৌঁছে যান। সেখানে তিনি সমুদ্র থেকে জল নিয়ে তা শুকিয়ে লবণ তৈরি করে ব্রিটিশ সরকারের আইন ভঙ্গ করেন। এটি একটি প্রতীকী কাজ ছিল, কিন্তু এর ফলাফল ছিল খুব ব্যাপক। গান্ধীজী বলেছিলেন: "যদি একটা ছোটো বাচ্চাও লবণ তৈরি করতে পারে, তাহলে ব্রিটিশ শাসনকে বুঝতে হবে যে ভারত এখন স্বাধীনতার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত।"
এর পরে, লক্ষ লক্ষ ভারতীয় এই আইন ভঙ্গ করার জন্য নিজেরাই সমুদ্র থেকে লবণ তৈরি শুরু করে। অনেক জায়গায় নারীরাও সক্রিয় ভূমিকা পালন করে এবং সত্যাগ্রহকে শক্তিশালী করে।
ব্রিটিশ সরকারের প্রতিক্রিয়া এবং দমনচক্র
মহাত্মা গান্ধীকে ৫ মে ১৯৩০ সালে গ্রেপ্তার করা হয়।
৬০,০০০ এর বেশি সত্যাগ্রহী গ্রেপ্তার হয়।
অনেক জায়গায় ব্রিটিশ পুলিশ সত্যাগ্রহীদের উপর লাঠিচার্জ এবং গুলিবর্ষণ করে।
সরোজিনী নাইডু এবং অন্যান্য নেতারা আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যান।
দেশজুড়ে লবণ সত্যাগ্রহ ছাড়াও আরও অনেক প্রতিবাদ শুরু হয়, যার ফলে ব্রিটিশ সরকার আরও বেশি বিপাকে পড়ে।
দান্ডি যাত্রার প্রভাব
১. ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে নতুন শক্তি যোগ হয়
এই আন্দোলন সমগ্র দেশে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ঐক্য সৃষ্টি করে। হাজার হাজার মানুষ লবণ তৈরি করে এবং ব্রিটিশ পণ্য বর্জন করে স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে।
২. আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্রিটিশ শাসনের সমালোচনা হয়
এই সত্যাগ্রহ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকে বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আমেরিকা এবং ব্রিটেনের অনেক সংবাদপত্র গান্ধীজীর এই যাত্রাকে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে একটি ঐতিহাসিক বিদ্রোহ বলে উল্লেখ করে।
৩. নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পায়
নারীরাও এই আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। সরোজিনী নাইডু, কমলা দেবী চট্টোপাধ্যায় এবং অন্যান্য নারীরা সত্যাগ্রহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং ইংরেজদের বিরুদ্ধে মোকাবেলা করেছিলেন।
৪. গান্ধী-ইরউইন চুক্তি (১৯৩১)
ব্রিটিশ সরকার এই আন্দোলনের প্রভাব দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। ১৯৩১ সালের মার্চ মাসে গান্ধীজী এবং তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড ইরউইনের মধ্যে একটি চুক্তি হয়, যার অধীনে:
ভারতীয়দের লবণ তৈরির অনুমতি দেওয়া হয়।
সত্যাগ্রহে গ্রেপ্তারকৃত বন্দীদের মুক্তি দেওয়া হয়।
গান্ধীজী সবিনয় অবাধ্যতা আন্দোলন স্থগিত করার বিষয়ে সম্মতি জানান।
গুরুত্ব এবং উত্তরাধিকার
দান্ডি যাত্রা অহিংসা এবং সত্যাগ্রহের শক্তির প্রতীক হয়ে ওঠে।
এটি ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামকে নতুন দিক নির্দেশ করে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্রিটিশ শাসনের সমালোচনা হয়।
এই আন্দোলন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র, নেলসন ম্যান্ডেলা এবং অন্যান্য সামাজিক আন্দোলনের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠে।
এই আন্দোলন ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক ছিল এবং এর কয়েক বছর পরেই ভারত স্বাধীনতা লাভ করে।
এই আন্দোলন প্রমাণ করে যে অহিংসার মাধ্যমেও একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্যকে নত করানো সম্ভব।
এই আন্দোলন ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার ভিত্তি স্থাপন করে।
দান্ডি যাত্রা কেবল একটি যাত্রা ছিল না, বরং অহিংসা ও জনসাধারণের শক্তির প্রদর্শন ছিল। এটি প্রমাণ করে যে একটি সাধারণ দেখতে নাগরিক আন্দোলনও একটি বিশাল সাম্রাজ্যকে কাঁপাতে পারে।