মহারাষ্ট্রের নির্মাতা: যশবন্তরাও চবানের সংগ্রামময় জীবন ও অবদান

🎧 Listen in Audio
0:00

ভারতীয় রাজনীতিতে যখনই সুদৃঢ় নেতৃত্ব, সহযোগিতা আন্দোলন এবং সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের কথা উঠে, তখনই যশবন্তরাও বলবন্তরাও চবানের নাম সবার আগে উঠে আসে। মহারাষ্ট্রের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী এবং ভারতের পঞ্চম উপপ্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি দেশের রাজনীতিকে নতুন দিক দিয়েছিলেন। একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী, সহযোগিতা নেতা এবং তীব্র সমাজতন্ত্রী হিসেবে তার ভূমিকা আজও প্রাসঙ্গিক।

মহারাষ্ট্রের নির্মাতা: এক কৃষকপুত্রের সংগ্রামময় যাত্রা

১২ই মার্চ ১৯১৩ সালে মহারাষ্ট্রের সাটারা জেলায় জন্মগ্রহণকারী যশবন্তরাও চবানের জীবন ছিল সংগ্রাম এবং সমাজসেবার প্রতীক। এক কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণকারী চবান বাল্যকাল থেকেই প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলেন। শৈশবেই পিতার ছায়া হারিয়ে ফেললেও তিনি তার শিক্ষা অব্যাহত রাখেন এবং পুনে থেকে আইন বিষয়ে ডিগ্রি লাভ করেন।

ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ‘সহযোগ আন্দোলন’ থেকে তার জনসাধারণ জীবনের সূচনা। ১৯৪২ সালের ‘ভারত ছাড়ো আন্দোলন’-এর সময় তিনি গোপনে থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সংগঠিত করেছিলেন এবং ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন। এই সময় তাকে বার বার জেলে যেতে হয়েছিল।

মহারাষ্ট্রের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী এবং সহযোগিতা আন্দোলনের প্রবক্তা

স্বাধীনতার পর, চবান মুম্বাই বিধানসভার সদস্য নির্বাচিত হন এবং পরে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হন। ১৯৬০ সালে যখন মহারাষ্ট্র এবং গুজরাট দুটি পৃথক রাজ্যে পরিণত হয়, তখন তিনি মহারাষ্ট্রের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হন। এই সময় তিনি রাজ্যের শিল্প উন্নয়ন এবং কৃষি সংস্কারের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। চবান মহারাষ্ট্রে সহযোগিতা আন্দোলনকে উৎসাহিত করেছিলেন এবং কৃষকদের অর্থনৈতিক অবস্থা উন্নত করার জন্য সহযোগী সমিতি স্থাপন করেছিলেন। আজও মহারাষ্ট্রের সহযোগিতা মডেল সমগ্র দেশের জন্য অনুপ্রেরণাদায়ক।

প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে ঐতিহাসিক ভূমিকা

১৯৬২ সালের ভারত-চীন যুদ্ধের সময় যখন তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ভি.কে. কৃষ্ণমেননকে পদত্যাগ করতে হয়, তখন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু যশবন্তরাও চবানকে এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেন। এই পদে অধিষ্ঠিত থাকাকালীন তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীর আধুনিকীকরণের উপর জোর দিয়েছিলেন এবং প্রতিরক্ষা নীতিকে শক্তিশালী করেছিলেন। তার প্রচেষ্টা ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে শক্তি প্রদান করেছিল।

গৃহ, অর্থ এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে অবদান

চবান তার রাজনৈতিক জীবনে গৃহমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। অর্থমন্ত্রী হিসেবে তিনি অর্থনৈতিক নীতিতে সংস্কার সাধন করেছিলেন, আর পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তিনি ভারতের বিশ্বব্যাপী ভাবমূর্তিকে শক্তিশালী করেছিলেন।

রাজনৈতিক উঠাঠাকা এবং কংগ্রেস বিভাজনে ভূমিকা

your image

১৯৬৯ সালে কংগ্রেস বিভাজনের সময় চবান প্রথমে ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিলেন, কিন্তু পরে তিনি তার সমর্থনে এসেছিলেন। ১৯৭৭ সালে যখন কংগ্রেস পরাজিত হয়, তখন তিনি বিরোধী দলনেতা হন। পরে তিনি চরণ সিংহের সাথে মিলে রাজনৈতিক সমীকরণ পরিবর্তন করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু এই কৌশল সফল হয়নি।

রাজনৈতিক জীবনের অবসান এবং উত্তরাধিকার

জীবনের শেষ বছরগুলিতে তিনি সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে সরে যান। ২৫শে নভেম্বর ১৯৮৪ সালে দিল্লিতে তার মৃত্যু হয়। তবে, তার নীতি এবং আদর্শ আজও প্রাসঙ্গিক। মহারাষ্ট্রে সহযোগিতা আন্দোলন এবং কৃষি সংস্কারে তার ভূমিকাকে কখনো ভুলে যাওয়া যাবে না। আজও মহারাষ্ট্র এবং সমগ্র দেশে তার স্মৃতিতে অনেক প্রতিষ্ঠান, পরিকল্পনা এবং পুরস্কার চালু আছে, যা তার উত্তরাধিকারকে জীবন্ত রাখে। যশবন্তরাও চবান শুধুমাত্র একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন না, বরং একজন চিন্তাবিদ এবং সমাজ সংস্কারকও ছিলেন, যিনি ভারতের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

Leave a comment