শিশুদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি: গ্রীষ্মকালীন ছুটির সঠিক ব্যবহার

🎧 Listen in Audio
0:00

আজকের যুগে শিশুদের স্বাস্থ্যের উপর ঝুঁকি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। জীবনযাত্রার বর্ধিত চ্যালেঞ্জ এবং মোবাইল, ল্যাপটপের মতো গ্যাজেটের অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে দেশের শিশুরা শারীরিক ও মানসিক উভয় দিক থেকেই দুর্বল হয়ে পড়ছে। প্রতিবেদন অনুসারে, ভারতে প্রায় ৪৫% শিশু ওভারওয়েট, ২৮% শিশু নিয়মিত শারীরিক কার্যকলাপ করে না এবং ৬৭% শিশু এক ঘন্টারও কম সময় বাইরে খেলে। এছাড়াও, শিশুদের মধ্যে মায়োপিয়া অর্থাৎ কাছের দৃষ্টি দুর্বলতা, স্থূলতা, থাইরয়েড, ডায়াবেটিসের মতো গুরুতর রোগের ঝুঁকিও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে গ্রীষ্মকালীন ছুটির সঠিক ব্যবহার করে শিশুদের স্বাস্থ্য উন্নত ও শক্তিশালী করার জন্য আমাদের অবশ্যই পদক্ষেপ নিতে হবে।

শিশুদের স্বাস্থ্যের উপর বর্ধিত ঝুঁকি

আজকাল শিশুদের স্বাস্থ্য ক্রমাগত দুর্বল হয়ে পড়ছে। এর প্রধান কারণ হল তাদের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন। শিশুরা দিনভর মোবাইল, টিভি বা ল্যাপটপের মতো গ্যাজেটে সময় কাটায়। এর ফলে শুধুমাত্র তাদের চোখের আলো কমে যাচ্ছে না, বরং তাদের শরীরও ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ছে। গবেষণা অনুসারে, দেশে প্রায় ৩০% শিশু মায়োপিয়া অর্থাৎ দুর্বল দৃষ্টি সমস্যায় ভুগছে। এছাড়াও শিশুদের শারীরিক কার্যকলাপ অনেক কমে গেছে, যার ফলে স্থূলতা, থাইরয়েড, ডায়াবেটিসের মতো রোগ কম বয়সেই দেখা দিচ্ছে। জাঙ্কফুডের অভ্যাস এবং পুষ্টিকর খাবারের অভাব তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকেও দুর্বল করে তুলছে।

এই সমস্ত শারীরিক সমস্যার সাথে সাথে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যও খারাপভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। গ্যাজেটে অধিক সময় কাটানোর ফলে তাদের মনোযোগ দ্রুত ঘুরে যায়, তারা চিড়চিড়ে হয়ে ওঠে এবং ছোট ছোট ব্যাপারে রাগান্বিত হতে থাকে। ক্রমাগত ঘুমের অভাব এবং অনিয়মিত দৈনিক কাজের ফলে তাদের মধ্যে চাপ ও অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়। এর প্রভাব সরাসরি তাদের পড়াশোনা, চিন্তা-ভাবনার ক্ষমতা এবং স্মৃতিশক্তির উপর পড়ে। তাই অবশ্যই আমাদের শিশুদের সময়মতো ঘুমাতে, সুষম খাবার খেতে এবং প্রতিদিন শারীরিক কার্যকলাপ করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। এই ছোট ছোট পরিবর্তনই তাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ উভয়কে সুস্থ ও উজ্জ্বল করে তুলতে পারে।

শিশুদের স্বাস্থ্য কেন দুর্বল হচ্ছে?

  • জাঙ্কফুড এবং অস্বাস্থ্যকর খাবার: শিশুদের মধ্যে জাঙ্কফুডের ব্যবহার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই খাবারগুলি পুষ্টির অভাব ঘটায় এবং স্থূলতার দিকে ঠেলে দেয়।
  • শারীরিক কার্যকলাপের অভাব: আজকের শিশুরা স্মার্টফোন, টিভি এবং গেমিংয়ে এত ব্যস্ত থাকে যে তারা খেলার জন্য বাইরে কমই বের হয়, যার ফলে তাদের শারীরিক কার্যকলাপ কমে যায়।
  • অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম: বর্ধিত স্ক্রিন টাইম শিশুদের মধ্যে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করার ক্ষমতা কমায়, পাশাপাশি মস্তিষ্ক ও শরীরের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
  • ঘুমের অভাব: বর্ধিত চাপ এবং গ্যাজেটের আসক্তির কারণে শিশুরা পর্যাপ্ত ঘুম পায় না, যা তাদের বৃদ্ধি এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে।

গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে শিশুদের জন্য যোগ কেন গুরুত্বপূর্ণ?

গ্রীষ্মের ছুটিতে শিশুদের জন্য যোগ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি শুধুমাত্র তাদের শরীরকে সুস্থ রাখে না, বরং মনকেও শান্ত ও একাগ্র করে তোলে। যোগ এমন একটি সহজ এবং প্রাকৃতিক উপায় যার মাধ্যমে শিশুরা কোনও ওষুধ ছাড়াই সুস্থ হতে পারে। স্বামী রামদেবও শিশুদের প্রতিদিন যোগ করার পরামর্শ দেন, যাতে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী হয় এবং তারা রোগ থেকে দূরে থাকে। যোগ করার ফলে শিশুদের হাড় এবং পেশী শক্তিশালী হয়, যার ফলে তাদের উচ্চতা বৃদ্ধিতেও সাহায্য হয়। এছাড়াও, যোগ শিশুদের চাপ, রাগ এবং চিড়চিড়ে ভাব থেকে মুক্তি দেয় এবং তাদের মন পড়াশোনায় ভালোভাবে লাগে। গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে যখন শিশুদের কাছে সময় বেশি থাকে, তখন তাদের যোগের অভ্যাস গড়ে তোলা সহজ হয়, যা তাদের জীবনব্যাপী কাজে লাগে।

শিশুদের স্থূলতা থেকে কীভাবে রক্ষা করবেন?

ঘরের তাজা ও পুষ্টিকর খাবার দিন: শিশুদের স্থূলতা থেকে রক্ষা করার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল তাদের ঘরোয়া তৈরি তাজা ও পুষ্টিকর খাবার দেওয়া। বাজারের ভাজা-ভুনা এবং জাঙ্কফুড যেমন চিপস, পিজ্জা, বার্গার বা কোল্ড ড্রিঙ্ক থেকে দূরে রাখুন। ঘরে দাল, ভাত, سبزی, রুটির মতো সুষম খাবার প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করুন যাতে শরীরকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান পাওয়া যায়।

ফল ও সবুজ শাকসবজির অভ্যাস গড়ে তুলুন: প্রতিদিন শিশুদের তাজা ফল এবং সবুজ পাতাযুক্ত শাকসবজি অবশ্যই দিন। এই জিনিসগুলি ফাইবার, ভিটামিন এবং খনিজ পদার্থে সমৃদ্ধ যা শুধুমাত্র ওজন নিয়ন্ত্রণ করে না, বরং শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকেও শক্তিশালী করে তোলে।

যোগ ও খেলার প্রতি উৎসাহিত করুন: শিশুদের টিভি, মোবাইল এবং ভিডিও গেম থেকে যতটা সম্ভব দূরে রাখুন এবং তাদের বাইরে খেলতে, দৌড়াতে বা যোগ করার জন্য উৎসাহিত করুন। সকালে আধা ঘন্টা যোগ বা দৌড় শিশুদের শরীরকে সক্রিয় ও ফিট রাখতে অনেক সাহায্য করে।

ক্যালোরি ও পুষ্টির দিকে নজর দিন: শিশুদের খাবারে ক্যালোরির পরিমাণ সুষম রাখুন। অতিরিক্ত মিষ্টি, ভাজা এবং চর্বিযুক্ত জিনিসপত্র থেকে বিরত থাকুন। তাদের খাদ্যতালিকায় দুধ, দই, ফল, শুকনো মেওয়া এবং পুরো শস্য অন্তর্ভুক্ত করুন, যাতে তাদের বিকাশ সঠিকভাবে হয় এবং ওজনও নিয়ন্ত্রণে থাকে।

যোগ থেকে শিশুরা কী কী সুবিধা পায়?

ফিট ও শক্তিশালী শরীর পাওয়া যায়: যোগ করার ফলে শিশুদের শরীরের পেশী শক্তিশালী হয় এবং হাড়ও আরও সুস্থ থাকে। এর ফলে তাদের শরীর নমনীয় ও সক্রিয় হয়। বিশেষ করে বর্ধমান বয়সে শিশুদের জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে তাদের শারীরিক বিকাশ ভালোভাবে হয়, যাতে তারা প্রতিদিনের কাজগুলি ক্লান্ত না হয়ে করতে পারে।

প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী হয়: শিশুদের রোগের সাথে লড়াই করার ক্ষমতা বা প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে যোগ অনেক সাহায্য করে। নিয়মিত যোগ করার ফলে শিশুদের ঠান্ডা, কাশি, অ্যালার্জির মতো ছোট ছোট রোগ বারবার হয় না এবং তাদের শরীর সংক্রমণের সাথে লড়াই করতে সক্ষম হয়।

মস্তিষ্ক তীক্ষ্ণ ও একাগ্রতা উন্নত হয়: যোগের সরাসরি প্রভাব শিশুদের মস্তিষ্কের উপর পড়ে। এর ফলে তাদের একাগ্রতা, স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তা-ভাবনার ক্ষমতা উন্নত হয়। পড়াশোনায় ফোকাস বাড়ে এবং তারা দ্রুত জিনিস বুঝতে পারে। এর ফলে তাদের আত্মবিশ্বাসও বৃদ্ধি পায়।

মানসিক চাপ ও চিড়চিড়ে ভাব কমে: আজকের শিশুরাও চাপ, চিড়চিড়ে ভাব এবং রাগের মতো সমস্যায় ভোগে। যোগ করার ফলে তাদের মন শান্ত হয় এবং মানসিক ভারসাম্য বজায় থাকে। এর ফলে শিশুরা সুখী থাকে, তাদের আচরণ উন্নত হয় এবং তারা ইতিবাচক চিন্তাভাবনা করতে শুরু করে।

শিশুদের মধ্যে বর্ধমান মায়োপিয়া

আজকের সময়ে শিশুদের মধ্যে মায়োপিয়া অর্থাৎ কাছের দৃষ্টি দুর্বলতা একটি বড় সমস্যা হয়ে উঠছে। দেশে প্রায় ৩০% শিশু এই সমস্যায় ভুগছে। এর প্রধান কারণ হল শিশুরা ঘন্টার পর ঘন্টা মোবাইল, ল্যাপটপ বা টিভির স্ক্রিনের সামনে বসে থাকে এবং তাদের চোখের উপর ক্রমাগত চাপ পড়ে। এর ফলে তাদের দৃষ্টি ধীরে ধীরে দুর্বল হতে থাকে। দুর্বল দৃষ্টির প্রভাব শুধুমাত্র তাদের পড়াশোনার উপরই পড়ে না, বরং এর ফলে মাথাব্যথা, চোখে জ্বালা, চাপ এবং আত্মবিশ্বাসের অভাবের মতো সমস্যাও দেখা দিতে থাকে। সময় থাকতে শিশুদের স্ক্রিন থেকে দূরে রাখা এবং চোখের যত্ন নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

শিশুদের স্বাস্থ্যকে শক্তিশালী ও উন্নত করার জন্য শুধু গ্রীষ্মের ছুটিই নয়, বরং সারা বছরের জীবনযাত্রায় উন্নতি আনা প্রয়োজন। যোগ, সুষম খাবার, শারীরিক কার্যকলাপ এবং স্ক্রিন টাইম নিয়ন্ত্রণ করে শিশুরা শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে পারে। গ্রীষ্মকালীন ছুটি শিশুদের জন্য একটি সুবর্ণ সুযোগ যখন তারা নতুন অভ্যাস গ্রহণ করে জীবনব্যাপী সুস্থ ও শক্তিশালী হতে পারে।

Leave a comment