২৮ ডিসেম্বর ১৯৩২ সালে গুজরাটের জুনাগড় জেলার চোরওয়াড় গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ধীরজলাল হীরাচাঁদ আম্বানি, যাকে আজ পুরো বিশ্ব ‘ধীরুবাই আম্বানি’ নামে চেনে। তিনি শুধুমাত্র একটি ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেননি, বরং ভারতের কর্পোরেট ইতিহাসের দিকও বদলে দিয়েছেন। স্কুল শিক্ষক পিতা এবং সাধারণ পরিবারে জন্ম নেওয়া এই যুবক ১৯৫৮ সালে রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের ভিত্তি স্থাপন করেন এবং তারপর আর কখনও পিছনে ফিরে তাকাননি।
প্রাথমিক জীবন: ইয়েমেন থেকে মুম্বাই পর্যন্ত
ধীরুবাই তার শিক্ষা বাহাদুর খানজি স্কুল থেকে সম্পন্ন করেন। অল্প বয়সেই তিনি জীবিকার জন্য ইয়েমেন চলে যান। বলা হয় সেখানে তিনি একটি পেট্রোল পাম্পেও কাজ করেছিলেন। তবে ১৯৫৮ সালে তিনি ভারতে ফিরে আসেন এবং নিজের ব্যবসা শুরু করার স্বপ্ন দেখেন। এটাই সেই মোড় যেখান থেকে ভারত রিলায়েন্সের মতো একটি ব্র্যান্ড পেতে চলেছিল।
ব্যবসার সূচনা: ছোট অফিস থেকে বড় উদ্দেশ্য
ভারতে ফিরে আসার পর, ধীরুবাই তার চাচাতো ভাই চম্পকলাল দামানির সাথে মিলে ‘মাজিন’ নামক একটি কোম্পানি গঠন করেন। এই কোম্পানি পলিয়েস্টার সুতা আমদানি করত এবং মশলা রপ্তানি করত। তাদের প্রথম অফিস মুম্বাইয়ের মসজিদ বন্দর এলাকায় মাত্র ৩৫০ বর্গফুটের ছিল। সেখানে ছিল মাত্র একটি টেলিফোন, একটি টেবিল এবং তিনটি চেয়ার। এই ছোট্ট অফিস থেকেই ভারতের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপিত হয়।
ধীরে ধীরে ধীরুবাই এবং চম্পকলালের ব্যবসা করার পদ্ধতিতে মতবিরোধ দেখা দেয় এবং ১৯৬৫ সালে উভয়ে তাদের অংশীদারিত্ব শেষ করে। এর পর ধীরুবাই একাই নিজের দমে ব্যবসা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন।
রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের উড়ান
১৯৭৭ সালে রিলায়েন্সকে জনসাধারণের কাছে উন্মুক্ত করা হয় এবং এটি শেয়ার বাজারে পদার্পণ করে। ধীরুবাই জনসাধারণের কাছ থেকে মূলধন সংগ্রহে দক্ষ ছিলেন। তিনি শেয়ার বাজারে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করেন এবং মানুষকে বিনিয়োগের জন্য আকর্ষণ করেন।
তিনি পলিয়েস্টার, পেট্রোকেমিক্যাল এবং পরবর্তীতে টেলিযোগাযোগের মতো ক্ষেত্রে কোম্পানির সম্প্রসারণ করেন। রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ ভারতের সেইসব নির্বাচিত কোম্পানির অন্তর্ভুক্ত যা ফরচুন ৫০০ তালিকায় স্থান করে নেয়।
বিবাদের ঘেরা কিন্তু কখনও থেমে থাকেননি
ধীরুবাই আম্বানির সাফল্য যতটা বড় ছিল, ততটাই বড় ছিল তার সমালোচনা। তাঁর উপর শেয়ার বাজারে ছলচাতুরি, কর ফাঁকি এবং ভাই-ভাটিজাতির মতো অভিযোগ আনা হয়।
সবচেয়ে বড় বিতর্ক ১৯৮৮ সালে তখন হয় যখন রিলায়েন্স আংশিকভাবে রূপান্তরযোগ্য ডিবেনচারের মাধ্যমে মূলধন সংগ্রহ করছিল। কিছু দালাল রিলায়েন্সের শেয়ার নামানোর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু ‘রিলায়েন্সের বন্ধু’ বলা দালালরা শেয়ার কিনে তাদের পরাজিত করে। এই ঘটনা বাজারকে কাঁপিয়ে তুলেছিল এবং বিএসই তিন দিন বন্ধ করতে হয়েছিল।
পরে জানা যায় যে ধীরুবাই নিজেই সেই দালালদের কাছে শেয়ার বিক্রি করছিলেন এবং তিনি এই সংকট থেকেও লাভ করেছিলেন। যদিও, রিজার্ভ ব্যাংকের তদন্তে রিলায়েন্স বা ধীরুবাইয়ের বিরুদ্ধে কোনও অবৈধ কার্যকলাপ প্রমাণিত হয়নি।
মৃত্যু এবং উত্তরাধিকার
২৪ জুন ২০০২ সালে ধীরুবাইকে স্ট্রোক হয় এবং তাকে ব্রীচ ক্যান্ডি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এক সপ্তাহেরও বেশি সময় কোমাতে থাকার পর ৬ জুলাই তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। ১৯৮৬ সালে তার প্রথম স্ট্রোক হয়েছিল যার ফলে তার ডান হাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
তার মৃত্যুর পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী তাকে ভারতীয় উদ্যমীতার প্রতীক বলে অভিহিত করেন। মহারাষ্ট্রের তৎকালীন রাজ্যপাল পি.সি. অ্যালেকজান্ডারও তাকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানান।
পারিবারিক মতবিরোধ এবং কোম্পানির বিভাজন
১৯৮৬ সালেই ধীরুবাই ধীরে ধীরে কোম্পানির দায়িত্ব তার ছেলেদের, মুকেশ এবং অনিলের কাছে হস্তান্তর করতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু ২০০৪ সালে মুকেশ আম্বানি এক সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেন যে তাঁর এবং অনিলের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। এরপর কোম্পানিকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয় – রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ (মুকেশের অধীনে) এবং রিলায়েন্স অনিল ধীরুভাই আম্বানি গ্রুপ (অনিলের অধীনে)।
সম্মান ও পুরস্কার
ধীরুবাই আম্বানিকে অনেক পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে। ১৯৯৮ সালে তিনি পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠিত ওয়ার্টন স্কুল থেকে ‘ডীন মেডাল’ পান – এই সম্মান পেতে তিনিই প্রথম ভারতীয়। ২০০৬ সালে তাকে মরণোত্তর ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান ‘পদ্মভূষণ’ এ ভূষিত করা হয়।
মিডিয়ায় ধীরুবাই
১৯৮৮ সালে হেমিশ ম্যাকডোনাল্ডের বই ‘দ্য পলিয়েস্টার প্রিন্স’এ ধীরুবাইয়ের জীবনের অনুমোদিত নয় এমন জীবনী প্রকাশিত হয়। এই বই ভারতে প্রকাশিত হতে পারেনি কারণ আম্বানি আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। তবে পরে ‘আম্বানি অ্যান্ড সন্স’ নামে এর একটি আপডেট সংস্করণ প্রকাশিত হয়।
বলিউড চলচ্চিত্র গুরু, যা মণিরত্নম পরিচালনা করেছিলেন, তাকেও ধীরুবাই আম্বানির জীবনী থেকে অনুপ্রাণিত বলে মনে করা হয়। যদিও পরিচালক এটিকে সরাসরি তাঁর জীবনী বলে মেনে নিতে অস্বীকার করেছিলেন।
একটি অনুপ্রেরণা যা কখনও ম্লান হয়নি
ধীরুবাই আম্বানির গল্প একটি স্বপ্নের মতো – একটি সাধারণ পরিবারের ছেলে, যিনি ইয়েমেনের গরম থেকে মুম্বাইয়ের ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে ভারতের সবচেয়ে বড় শিল্প গড়ে তোলেন। তিনি দেখিয়েছেন যে দূরদর্শিতা, আত্মবিশ্বাস এবং পরিশ্রমের মাধ্যমে যেকোনো স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করা যায়।
আজ, রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ শুধুমাত্র ভারত নয়, বিশ্বের সবচেয়ে বড় কোম্পানির অন্যতম, এবং এই সাফল্যের ভিত্তি স্থাপনকারীর নাম – ধীরুবাই আম্বানি।
ধীরুবাই আম্বানির জীবনকথা এই প্রমাণ করে যে উৎসাহ, দূরদর্শিতা এবং কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে যেকোনো ব্যক্তি অসাধারণ উচ্চতা অর্জন করতে পারে। তিনি শুধুমাত্র একটি কোম্পানি তৈরি করেননি, বরং কোটি কোটি ভারতীয়কে স্বপ্ন দেখা এবং তা বাস্তবায়নের অনুপ্রেরণা দিয়েছেন।