নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু: জীবন, সংগ্রাম ও অমর অবদান

🎧 Listen in Audio
0:00

নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু ভারতের অন্যতম মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন। তাঁর সাহস, নেতৃত্ব ক্ষমতা এবং দেশপ্রেম আজও প্রত্যেক ভারতীয়কে অনুপ্রাণিত করে। তাঁর বিখ্যাত স্লোগান, 'তুমি আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাকে স্বাধীনতা দেব', আজও দেশপ্রেমের অনুভূতিকে জীবন্ত রাখে। প্রতি বছর ২৩ জানুয়ারি তাঁর জন্মদিন 'পরাক্রম দিবস' হিসেবে পালিত হয়। আসুন, তাঁর জীবনের পথ, সংগ্রাম এবং অবদান সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিই।

সুভাষ চন্দ্র বসুর জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন

নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর জন্ম ২৩ জানুয়ারি ১৮৯৭ সালে উড়িষ্যা (বর্তমানে ওড়িশা) রাজ্যের কটক শহরে। তাঁর পিতা জনকীনাথ বসু একজন বিখ্যাত আইনজীবী ছিলেন, যিনি 'রায় বাহাদুর' উপাধি লাভ করেছিলেন। তাঁর মাতার নাম প্রভাৱতী দত্ত বসু। সুভাষ কটকের প্রোটেস্ট্যান্ট ইউরোপিয়ান স্কুল (বর্তমানে স্টিওয়ার্ট হাই স্কুল) থেকে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। পরে তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।

মাত্র ১৬ বছর বয়সে সুভাষ চন্দ্র বসু স্বামী বিবেকানন্দ এবং রামকৃষ্ণ পরমহংসের শিক্ষা দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হন। এই আদর্শগুলিই তাঁর মনে দেশপ্রেম ও সেবার भाव জাগ্রত করে।

তাঁর পিতামাতা চেয়েছিলেন তিনি একজন সরকারি কর্মকর্তা হবেন। সেইজন্য তাঁকে ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হয়, যেখান থেকে সুভাষ সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা (ICS) উত্তীর্ণ হন। কিন্তু ১৯২১ সালে ভারতে বর্ধমান জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দেখে সুভাষ ইংরেজদের চাকরি করা থেকে বিরত থাকেন এবং ICS থেকে পদত্যাগ করে ভারতে ফিরে আসেন। এখান থেকেই শুরু হয় তাঁর বিপ্লবী যাত্রা।

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগদান এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে অবদান

ভারতে ফিরে আসার পর, সুভাষ চন্দ্র বসু মহাত্মা গান্ধী এবং অন্যান্য নেতাদের সাথে মিলে অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। তিনি 'স্বরাজ' পত্রিকা প্রকাশ করেন এবং ভারত ছাড়ো আন্দোলনেও অংশ নেন।

১৯৩৮ সালে, সুভাষ চন্দ্র বসু ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। কিন্তু তাঁর মতাদর্শ গান্ধীজীর সাথে ভিন্ন ছিল, এবং এর ফলে দলে মতবিরোধ দেখা দেয়। পরে, নেতাজি কংগ্রেস ত্যাগ করেন এবং 'ফরোয়ার্ড ব্লক' নামে একটি নতুন সংগঠন গঠন করেন।

আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন

  • ভারতের স্বাধীনতার জন্য নেতাজির সবচেয়ে বড় এবং ঐতিহাসিক পদক্ষেপ ছিল আজাদ হিন্দ ফৌজ (Indian National Army - INA) গঠন।
  • দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, জাপান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক অঞ্চল দখল করে নেয়। ভারতীয় যুদ্ধবন্দীদের একত্রিত করে, রাসবিহারী বসু এবং জেনারেল মোহন সিং 'আজাদ হিন্দ ফৌজ'-এর ভিত্তি স্থাপন করেন।
  • ১৯৪৩ সালে সুভাষ চন্দ্র বসু জার্মানি থেকে জাপানে যান এবং সেখানে তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। এরপর:
  • ২১ অক্টোবর ১৯৪৩ সালে নেতাজি 'আজাদ হিন্দ সরকার' গঠন করেন।
  • নেতাজি আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে ভারতের পতাকা উত্তোলন করেন।
  • 'দিল্লি চলো' স্লোগান দিয়ে আজাদ হিন্দ ফৌজ ভারতের দিকে অগ্রসর হয়।
  • আজাদ হিন্দ ফৌজে রাণী লাক্ষ্মীবাই রেজিমেন্টের মতো নারী রেজিমেন্টও গঠন করা হয়, যার নেতৃত্ব দেন ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী স্বামীনাথন।

নেতাজির মৃত্যু

১৮ আগস্ট ১৯৪৫ সালে তাইওয়ানে একটি বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যুর খবর আসে। তবে তাঁর মৃত্যু নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠেছে। কেউ কেউ মনে করেন নেতাজির মৃত্যু হয়নি, এবং তিনি গোপনে জীবনযাপন করছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পরও তাঁর অবদান ভারত কখনো ভুলবে না।

নেতাজির অবদান

নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তিনি কেবল ভারতীয় জাতীয় সেনা গঠন করেননি, বরং নারীদেরও সেনায় অন্তর্ভুক্ত করেন এবং রাণী লাক্ষ্মীবাই রেজিমেন্ট গঠন করেন। তাঁর বিখ্যাত স্লোগান "তুমি আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাকে স্বাধীনতা দেব" আজও ভারতীয়দের হৃদয়ে প্রতিধ্বনিত হয়। এই স্লোগান তাঁর দেশপ্রেম এবং সংগ্রামের भाव প্রকাশ করে।

নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু একজন এমন নেতা ছিলেন যিনি তাঁর জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ভারতের স্বাধীনতার জন্য উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁর সাহস, ত্যাগ এবং দেশপ্রেম সর্বদা আমাদের হৃদয়ে জীবন্ত থাকবে। আজ যখনই আমরা স্বাধীনতার কথা বলি, নেতাজির নাম শ্রদ্ধার সাথে উচ্চারিত হয়।

Leave a comment