মোহনলাল নামে এক কৃষক ছিল, যে ছোট্ট এক গ্রামে বাস করত। তার পুরো জীবনই কৃষিকাজে কেটে যেত। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সে খেতে কাজ করত, ঘাম ঝরাত, যাতে তার পরিবারের পেট পুরোনো যায়। কিন্তু ভাগ্য প্রতিবারই তার সাথে খেলা করত। কখনও বন্যা, কখনও খরা, কখনও বৃষ্টি, কখনও তীব্র রোদ—প্রতি বছরই কোনও না কোনও বিপদ আসত এবং তার ফসল নষ্ট হয়ে যেত।
বারবার পরিশ্রম করার পরও যখন কিছুই পাওয়া যেত না, তখন মোহনলালের মন ভেঙে যেতে লাগল। ধীরে ধীরে তার অন্তরে ঈশ্বরের প্রতিও অসন্তোষ জন্মাতে লাগল। তাকে মনে হত ঈশ্বরের তার দুঃখের কোনও চিন্তাই নেই।
ঈশ্বরের কাছে প্রশ্ন
একদিন অত্যন্ত দুঃখী হয়ে মোহনলাল মন্দিরে গেল। সে ঈশ্বরের মূর্তির সামনে বসে বলল,
“হে ঈশ্বর, আপনি তো সবকিছু করতে পারেন, কিন্তু মনে হয় আপনার কৃষিকাজের কিছুই বোঝা নেই। প্রতিবারই আমাদের পরিশ্রম বৃথা হয়। এক বছর আমাকে সুযোগ দিন। আমি নিজেই আবহাওয়া সামলাব এবং তখন আপনাকে দেখাব কিভাবে ফসল ফলায়।”
মন্দিরে নীরবতা ছিল, কিন্তু তখনই এক ক্ষীণ আওয়াজ শোনা গেল—
“ঠিক আছে মোহন, তোমাকে এক বছরের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। আবহাওয়া এখন তোমার ইচ্ছামতো চলবে। কিন্তু যাই হোক না কেন, তার দায়িত্বও তোমারই হবে।”
সবকিছু নিজের মতো করে
মোহনলালের আনন্দের সীমা ছিল না। এখন বৃষ্টি, রোদ, বাতাস সবই তার ইশারায় ছিল। যখন পানি দরকার হত, তখন হালকা বৃষ্টি হত। যখন রোদ দরকার হত, তখন রোদ উঠত। কোনও বন্যা নয়, কোনও বৃষ্টি নয়, কোনও ঝড় নয়। তার ফসল যেন স্বপ্নের মতো বেড়ে উঠছিল।
মোহনলাল ভাবল, “দেখো ঈশ্বর! এখন আমি তোমাকে দেখাচ্ছি কিভাবে পরিশ্রমের সঠিক ফল পাওয়া যায়।”
কর্তনের দিন এবং বড় ধাক্কা
অবশেষে সেই দিন এল যখন ফসল কাটা উচিত ছিল। পুরো উৎসাহ নিয়ে মোহনলাল ফসল কাটা শুরু করল। কিন্তু যখনই সে গমের শীষগুলো হাতে তুলল, তার মুখের রং ফ্যাকাসে হয়ে গেল। প্রতিটি শীষই ফাঁকা ছিল। ভিতরে কোনও দানা ছিল না।
সে হতবাক হয়ে খেতেই বসে রইল। মনে মনে ঈশ্বরকে ডাকতে লাগল—
“প্রভু, আমি তো পুরো পরিশ্রম করেছি। সবকিছু ঠিক করেছি, তাহলে এটা কেন হল?”
পরমাত্মার সত্যিকার শিক্ষা
তখনই সেই আওয়াজ আবার শোনা গেল—
“মোহন, তোমার পরিশ্রমে কোনও ঘাটতি ছিল না। কিন্তু তুমি ফসলকে কখনো সংগ্রাম করার সুযোগ দাওনি। না তীব্র রোদে পোড়াওনি, না বাতাসে নত হতে দিয়েছ, না বৃষ্টির মার খেতে দিয়েছ। তাই সেই গাছপালা বাইরে থেকে সবুজ দেখায়, কিন্তু ভিতরে দুর্বল ছিল।”
ঈশ্বর আরও বললেন—
“সংগ্রামই সত্যিকার শক্তি দেয়। যেমন সোনা আগুনে পুড়ে ও আঘাত সহ্য করে কুন্দন হয়, তেমনি গাছপালাও আবহাওয়ার মার থেকে শক্তিশালী হয়। মানুষের জীবনও এমনই। যদি প্রতিটি সমস্যা থেকে বাঁচানো হয়, তাহলে সে কখনো শক্তিশালী হতে পারে না।”
মোহনলালের নতুন চিন্তা
মোহনলাল তার ভুল বুঝতে পারল। সে অনুভব করল যে আসলে সেই শিক্ষাই পেল, যার প্রয়োজন ছিল। সে সিদ্ধান্ত নিল যে এখন সে দুঃখকষ্ট থেকে পালিয়ে যাবে না, বরং তার মোকাবেলা করবে। কারণ সেই দুঃখকষ্টই তাকে সত্যিকার শক্তি দেবে।
আমাদের সকলের জন্য শিক্ষা
এই গল্প শুধুমাত্র মোহনলালের নয়। আমরা সবাই চাই আমাদের জীবনে কখনো কোনও সমস্যা না আসুক। কিন্তু সত্যি কথা হল সংগ্রাম ছাড়া আমরা ভিতরে থেকে শক্তিশালী হতে পারি না।
প্রতিটি সমস্যা, প্রতিটি দুঃখকষ্ট আমাদের শেখায় আমরা কী করতে পারি।
সত্যিকার সাফল্য তাদেরই হয় যারা পড়ে, উঠে এবং তারপর হাসিমুখে এগিয়ে যায়।
তাই যখনই জীবনে সমস্যা আসবে, ভয় পেও না। বুঝে নাও এটাই সেই মুহূর্ত, যখন তুমি সত্যিকার শক্তিশালী হতে চলেছ।