অনেক আগের কথা। ছোট্ট একটা গ্রামে শিবনাথ নামে একজন পরিশ্রমী কৃষক থাকতেন। শিবনাথ ছিলেন এমন একজন মানুষ, যিনি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খেতে হাল চালাতেন, বীজ বোনতেন এবং ফসল ফলাতেন। তাঁর পরিশ্রমের গ্রামবাসীরা সবাই প্রশংসা করতেন। কিন্তু তাঁর জীবনে একটা বড় সমস্যা ছিল—তাঁর খেতের মাঝখানে একটা জেদি পাথরের টুকরো বেরিয়ে ছিল।
এই পাথরটি যেন তাঁর পরিশ্রমের পরীক্ষা নিতে সেখানে রাখা হয়েছিল। কতবার তাঁর হাল এর সাথে ধাক্কা লেগে ভেঙে গেছে, কতবার বলড়া ঠোঁটকা খেয়েছে, আর শিবনাথ নিজেও কতবার সেই পাথরের সাথে ঠোঁকা খেয়েছেন। প্রতিবার যখন তিনি রেগে পাথরটির দিকে তাকাতেন, বলতেন, “একদিন তোকে আমি উঠিয়ে ফেলব।” কিন্তু দৈনন্দিন ব্যস্ততায় সে কথা কোথাও হারিয়ে যেত।
বছর গেড়ে গেল, শিবনাথ একই খেতে দিন-রাত কাজ করে গেলেন, আর পাথরটিও তেমনিভাবে দাঁড়িয়ে রইল। যখন কেউ গ্রামে তাঁর সাহায্যের জন্য আসত, তখন শিবনাথ বীরত্বের সাথে সেই পাথরটি দেখিয়ে বলতেন,
“দেখো, এটাই আমার সবচেয়ে বড় সমস্যা। এটাকে সরানো সহজ নয়, অনেক ভারী। জড়োপুড়ি।”
একদিন সকাল-সন্ধ্যার আবহাওয়া মনোরম ছিল, আর পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ শোনা যাচ্ছিল। শিবনাথ হাল তুলে খেতে চলে গেলেন। খুশি ছিলেন আজ অনেক কাজ করবেন। কিন্তু যখনই তিনি হাল চালালেন, হাল আবার সেই পাথরের সাথে ধাক্কা খেলো এবং ভেঙে গেল।
সেইদিন তাঁর ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেল। তিনি মাটিতে বসে পাথরটির দিকে তাকিয়ে বললেন,
“এবার যথেষ্ট! বছরের পর বছর তোকে সহ্য করছি, কিন্তু আর নয়! যাবে তুই নাকি যাব আমি।”
তারপর তিনি গ্রামে ছুটে গেলেন এবং তাঁর কিছু বিশ্বস্ত বন্ধু—রামু, ভোলা, নথু এবং আরও দুইজন সঙ্গীকে একত্রিত করলেন। সবাই কৃষক ছিলেন, শক্তিশালী এবং সাহায্য করার জন্য প্রস্তুত।
সবাই মিলে সেই পাথরটি সরানোর জন্য খেতে পৌঁছালো। কোদাল আর লাঙল নিয়ে তারা সেই পাথরটি খোঁড়া শুরু করলো। কিন্তু কি হল, যা শিবনাথ কখনো ভাবতেও পারেননি—কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই পাথরটি মাটি থেকে বেরিয়ে এল।
রামু হেসে বলল,
“শিবনাথ, এটা তো মাত্র একটা ছোট্ট পাথর! তুমি এটাকে এত বড় সমস্যা বানিয়ে রেখেছিলে!”
শিবনাথ সেখানেই বসে গেলেন, কিছুটা লজ্জিত, কিছুটা অবাক। তিনি পাথরটি হাতে তুলে নিলেন এবং ভাবতে লাগলেন—বছরের পর বছর যা আমার কাছে সবচেয়ে বড় বাধা মনে হয়েছিল, তা আসলে ছিল মাত্র একটা সাধারণ পাথর। যদি আমি আগে চেষ্টা করতাম, তাহলে এত ক্ষতি হতো না, আমার পরিশ্রম নষ্ট হতো না।
তাঁর বন্ধুরা তাঁকে বুঝিয়ে বলল,
“কোনো কথা নেই, শিব। এখন তুমি শিখে গেলে, এটাই যথেষ্ট।”
শিবনাথ মনে মনে ঠিক করলেন যে, এখন থেকে যতই কঠিন সমস্যা আসুক না কেন, তিনি পালিয়ে যাবেন না, তাঁর মোকাবেলা করবেন।
শিক্ষা
এই গল্পটি আমাদের শিক্ষা দেয় যে, জীবনে যতগুলি সমস্যা আমাদের থামিয়ে দেয়, সেগুলি প্রায়শই আমরা যতটা ভাবি ততটা বড় হয় না। আমাদের সাহসের অভাব, ভয় এবং দেরিই সেগুলি বড় করে তোলে।
যদি আমরা একটু সাহস দেখাই এবং সামনে দাঁড়িয়ে থাকা “পাথর”টির মোকাবেলা করি, তাহলে দেখা যায় যে এটি ছিল মাত্র একটা সাধারণ বাধা।
তাই আপনাকেও আপনার জীবনের সেই জেদি পাথরটি সরানোর সাহস দেখাতে হবে। তবেই জীবন সহজ ও সুন্দর হবে।
```