রাজীব গান্ধীর ৫ টি অসাধারণ অবদান যা বদলে দিয়েছে ভারতের চেহারা

🎧 Listen in Audio
0:00

যখনই ভারতের আধুনিক উন্নয়নের ভিত্তির কথা উঠে, তখনই সবার আগে এক নাম মনে পড়ে—রাজীব গান্ধী। ভারতের সবচেয়ে কনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাজীব গান্ধী কেবলমাত্র একজন নেতা ছিলেন না, বরং একজন দূরদর্শী ব্যক্তি ছিলেন, যিনি বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, শিক্ষা এবং গণতান্ত্রিক সবলীকরণের মতো ক্ষেত্রে দূরদর্শী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে দেশকে নতুন দিক দিয়েছিলেন। ২১শে মে তাঁর পুন্যতিথির দিনে আসুন জেনে নিই তাঁর পাঁচটি সবচেয়ে বড় অবদান, যা ভারতের চিত্রই বদলে দিয়েছে।

ডিজিটাল বিপ্লবের ভিত্তি স্থাপন

আজ যার ডিজিটাল ইন্ডিয়ার কথা বলা হয়, তার ভিত্তি রাজীব গান্ধী ১৯৮০-এর দশকেই স্থাপন করেছিলেন। তিনি ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলেন যে, ভারতকে যদি বিশ্বের মঞ্চে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়, তাহলে তথ্য প্রযুক্তি (IT) এবং দূরসংযোগে আত্মনির্ভরতা অপরিহার্য।

এই চিন্তাধারার অধীনে তিনি ১৯৮৪ সালে C-DOT (Centre for Development of Telematics)-এর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানটি দেশজুড়ে টেলিফোন নেটওয়ার্কের বিস্তার শুরু করে। ফলশ্রুতিতে, দূরবর্তী গ্রামগুলি পর্যন্ত যোগাযোগ সুবিধা পৌঁছে গেল এবং গ্রামের মানুষও দেশ-বিশ্বের সাথে যুক্ত হতে লাগল।

MTNL (Mahanagar Telephone Nigam Limited)-এর সূচনা ১৯৮৬ সালে তাঁরই উদ্যোগে হয়, যার ফলে নগর টেলিফোন সেবাগুলি ব্যবস্থাপিত হল। আজ ভারত যার মোবাইল এবং ইন্টারনেট বিপ্লবে গর্ব করে, তার ভিত্তি অনেক আগেই রাজীব গান্ধী স্থাপন করেছিলেন।

কম্পিউটারকে সাধারণ জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়া

এক সময় ভারতে কম্পিউটারকে চাকরির শত্রু বলে মনে করা হত। কিন্তু রাজীব গান্ধী এই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে কম্পিউটারের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন।

তিনি বিজ্ঞানী স্যাম পিট্রোডার সাথে মিলে দেশে কম্পিউটার বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন। কম্পিউটার হার্ডওয়্যারের আমদানি শুল্ক কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল যাতে তা সস্তা হয় এবং আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে।

ভারতীয় রেলওয়েতে কম্পিউটারের মাধ্যমে টিকিট বুকিং, সরকারি দপ্তরের ডিজিটাইজেশন এবং ব্যাংকিং সেবায় প্রযুক্তিগত উন্নয়ন—এগুলি সবই তাঁর চিন্তাধারার ফল।

কম্পিউটার শিক্ষাকে উৎসাহিত করার জন্য স্কুলের পাঠ্যক্রমে কম্পিউটার যোগ করা হয় এবং প্রযুক্তিগত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে সবল করা হয়।

১৮ বছরে ভোটাধিকার

রাজীব গান্ধী যুব ভারতের শক্তিতে পূর্ণ আস্থা রাখতেন। সে সময় ভারতে ভোট দেওয়ার বয়স ছিল ২১ বছর, যা তিনি কমিয়ে ১৮ বছর করেছিলেন।

১৯৮৯ সালে ৬১তম সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে তিনি কোটি কোটি যুবককে রাজনৈতিক অংশগ্রহণের অধিকার দিয়েছিলেন। এতে কেবলমাত্র যুবকদের গণতন্ত্রে অংশগ্রহণের সুযোগই হয়নি, বরং দেশের রাজনীতিতে নতুন শক্তি এবং দৃষ্টিভঙ্গি এসেছে।

এই সিদ্ধান্তটি যুবকদের রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করার জন্য অনুপ্রাণিত করেছে এবং গণতন্ত্রকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক করে তুলেছে।

পঞ্চায়েত রাজকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি

রাজীব গান্ধীর সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক সাফল্যগুলির মধ্যে একটি হল পঞ্চায়েত রাজ ব্যবস্থাকে সবল করার উদ্যোগ। তাঁর বিশ্বাস ছিল যে, যতক্ষণ না গ্রামের মানুষ নিজেরাই নিজেদের উন্নয়নের সিদ্ধান্ত নেবে, ততক্ষণ সত্যিকারের গণতন্ত্র আসবে না।

তিনি পঞ্চায়েত রাজ নিয়ে ৬৪তম সংবিধান সংশোধন বিল প্রণয়ন করেছিলেন। যদিও তাঁর জীবদ্দশায় এই আইনটি প্রণীত হয়নি, তবে তাঁর চিন্তাধারার ভিত্তিতে ১৯৯২ সালে ৭৩তম এবং ৭৪তম সংবিধান সংশোধন গৃহীত হয়, যার ফলে পঞ্চায়েতগুলিকে সাংবিধানিক মর্যাদা দেওয়া হয়।

এর পর থেকে ২৪শে এপ্রিল ১৯৯৩ সাল থেকে সারা দেশে পঞ্চায়েত নির্বাচন বাধ্যতামূলক হয় এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ হয়। আজ গ্রামে সরপঞ্চ থেকে ব্লক প্রধান পর্যন্ত সরাসরি অংশগ্রহণ এই চিন্তাধারার ফল।

জওহর নবোদয় বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা

রাজীব গান্ধী শিক্ষার শক্তিতেও গভীর বিশ্বাস রাখতেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল যে, প্রতিভা কেবলমাত্র শহরগুলিতে নয়, গ্রামগুলিতেও জন্মগ্রহণ করে এবং তাকে উপযুক্ত সুযোগ পেতে হবে।

১৯৮৬ সালে তিনি জাতীয় শিক্ষানীতি (National Education Policy) ঘোষণা করেন এবং তার অধীনে জওহর নবোদয় বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেন।

এই আবাসিক বিদ্যালয়গুলি দেশজুড়ে গ্রামীণ অঞ্চলে প্রতিষ্ঠা করা হয়, যেখানে প্রবেশ পরীক্ষার মাধ্যমে নির্বাচিত মেধাবী শিশুদের বিনামূল্যে শিক্ষা, খাদ্য এবং বাসস্থানের সুবিধা দেওয়া হয়।

আজ দেশজুড়ে ৫৫০টিরও বেশি নবোদয় বিদ্যালয় চলছে, যেখানে লক্ষ লক্ষ ছাত্র শিক্ষা লাভ করছে। রাজীব গান্ধীর দূরদর্শিতার ফলশ্রুতিতে দেশের পিছিয়ে পড়া এলাকা থেকে বেরিয়ে অনেক ছাত্র আজ বিশ্বমঞ্চে দেশের নাম উজ্জ্বল করছে।

রাজীব গান্ধী যদিও এক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন, কিন্তু তিনি যা বীজ বপন করেছিলেন, তা আজ বিশাল বৃক্ষে পরিণত হয়েছে। তাঁর চিন্তাধারা কেবল বর্তমানকে নয়, বরং আগামী ভবিষ্যতকেও আকার দিয়েছে। তিনি প্রযুক্তি, শিক্ষা, গণতন্ত্র এবং যুবকদের ক্ষেত্রে এমন ऐतिहासिक সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যা আজও ভারতের উন্নয়নের মেরুদণ্ড।

Leave a comment