যোগী আদিত্যনাথ: ধর্ম, রাজনীতি ও সমাজসেবার সমন্বয়ে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী

🎧 Listen in Audio
0:00

যোগী আদিত্যনাথ অজয় বিষ্ট থেকে মহন্ত হয়ে পরবর্তীতে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পথ ধর্ম, রাজনীতি ও সমাজসেবার সমন্বয়ে অতিক্রম করেছেন।

জন্মদিন: উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ আজ ৫ই জুন তাঁর ৫৩তম জন্মদিন পালন করছেন। জন্ম থেকে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পথে তাঁর জীবনে অনেক সংগ্রাম, উত্থান-পতন ও দৃঢ় রাজনৈতিক দক্ষতা ছিল। মাত্র ২৬ বছর বয়সে লোকসভা নির্বাচনে জিতে সংসদে প্রবেশকারী যোগী আদিত্যনাথ তাঁর জীবনে অনেক ঘুরান্তি দেখেছেন এবং আজ তিনি উত্তরপ্রদেশের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা। গড়ওয়ালী রাজপুত পরিবার থেকে গোরক্ষপীঠের মহন্ত হয়ে পরবর্তীতে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী পর্যন্ত পৌঁছানোর তাঁর গল্প রাজনীতির জগতে এক অনন্য উদাহরণ।

প্রাথমিক জীবন ও শিক্ষা

যোগী আদিত্যনাথের জন্ম ৫ই জুন ১৯৭২ সালে উত্তরাখণ্ডের পাউড়ি গড়ওয়াল জেলার পাঞ্চুর গ্রামে। তাঁর পরিবার গড়ওয়ালী রাজপুত পরিবার ছিল। তাঁর পিতা আনন্দ সিং বিষ্ট এবং মাতা সাবিত্রী দেবী। সাত ভাইবোনের মধ্যে তিনি পঞ্চম। যোগী আদিত্যনাথ প্রাথমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ করার পরে শ্রীনগরের গড়ওয়াল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে বিএসসি করেন। এরপর ১৯৯৩ সালে এমএসসি পড়াশোনার সময় তিনি গোরখপুরে আসেন।

অজয় বিষ্ট থেকে যোগী আদিত্যনাথ হওয়ার পথ

১৯৯৪ সালে গোরখপুরের গোরক্ষনাথ মন্দিরে মহন্ত অবৈদ্যনাথের কাছ থেকে দীক্ষা গ্রহণ করে অজয় সিং বিষ্ট যোগী আদিত্যনাথ নাম গ্রহণ করেন। এই দীক্ষা তাঁর জীবনের ধারা বদলে দেয়। মহন্ত অবৈদ্যনাথের নির্দেশনায় তিনি রাজনীতি ও ধর্মীয় ক্ষেত্র উভয় ক্ষেত্রেই সক্রিয় হন। ১৯৯৬ সালের লোকসভা নির্বাচনে মহন্ত অবৈদ্যনাথের প্রচারের পর ১৯৯৮ সালে তাঁকে উত্তরাধিকারী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। একই বছর তিনি প্রথমবার লোকসভায় নির্বাচিত হন এবং রাজনীতিতে তাঁর প্রভাব বিস্তার করেন।

গোরক্ষনাথ মন্দির থেকে প্রাপ্ত রাজনৈতিক শক্তি

গোরক্ষনাথ মন্দিরের মহন্ত হওয়ার পর যোগী আদিত্যনাথ ধর্মীয় ও সামাজিক কাজের বৃহৎ দায়িত্ব পান। তিনি মন্দিরের সাথে যুক্ত স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল ও অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সফলভাবে পরিচালনা করেন। এই সময়ে তাঁর জনপ্রিয়তা ও প্রভাব উভয়ই বৃদ্ধি পায়। তিনি একজন দৃঢ় ধর্মীয় নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন এবং জনমনে বিশেষ স্থান করে নেন।

বিবাদ ও সমালোচনার মধ্যে দৃঢ়তা

যোগী আদিত্যনাথের নাম বিবাদের সাথেও জড়িত ছিল। ১৯৯৯ সালে পচরুখিয়া কাণ্ডের পর তিনি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসেন। তাঁর উপর বহুবার ধর্মীয় কট্টরতা ও সাম্প্রদায়িক বক্তৃতা দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়। গোরখপুরে দাঙ্গার সময় তাঁকে কারাভোগও করতে হয়। কিন্তু এসব ঘটনা তাঁর রাজনৈতিক জীবনে বাধা সৃষ্টি করেনি। তিনি হিন্দু যুব বাহিনী ও বজরঙ্গ দলের মতো সংগঠনকে শক্তিশালী করেছেন এবং হিন্দুত্বের এজেন্ডাকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন।

বিজেপির মধ্যে তাঁর ক্রমবর্ধমান মর্যাদা

২০০৭ সালের বিধানসভা নির্বাচন ও ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের সময় যোগী আদিত্যনাথ বিজেপির মধ্যে তাঁর বৈপরীত্যপূর্ণ ও বিদ্রোহী স্বভাব প্রকাশ করেছিলেন। তিনি দলের নেতৃত্বের উপর প্রশ্ন তুলেছিলেন এবং হিন্দু যুব বাহিনী থেকে তাঁর প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার হুমকিও দিয়েছিলেন। তবে, দলের শীর্ষ নেতৃত্ব অবশেষে তাঁর রাজনৈতিক গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিল এবং বিজেপির মধ্যে তাঁকে একজন শক্তিশালী নেতা হিসাবে স্বীকার করে নিয়েছিল।

সংসদ সদস্য হিসেবে ক্রমাগত পাঁচবার জয়

যোগী আদিত্যনাথ গোরখপুর থেকে ক্রমাগত পাঁচবার লোকসভা নির্বাচনে জিতে তাঁর রাজনৈতিক শক্তি প্রমাণ করেছেন। ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত তিনি প্রতিটি নির্বাচনে সফল হন। তাঁর সক্রিয়তা, স্পষ্ট ও তীক্ষ্ণ বক্তৃতা তাঁকে জনপ্রিয় করে তুলেছিল। গোরখপুর ও সমগ্র উত্তরপ্রদেশে তাঁর দৃঢ় আধিপত্য তাঁকে একজন বৃহৎ নেতা করে তুলেছে, যিনি রাজ্যের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

মুখ্যমন্ত্রী পদ পর্যন্ত যাত্রা

যোগী আদিত্যনাথের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার যাত্রা অত্যন্ত বিশেষ ছিল। ২০১৭ সালে যখন তিনি প্রথমবার উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হন, তখন তিনি গোরক্ষনাথ মন্দিরের মহন্তও ছিলেন এবং রাজ্যের অন্যতম কনিষ্ঠ মুখ্যমন্ত্রীদের একজন হয়ে ওঠেন। তাঁর নেতৃত্বে উত্তরপ্রদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে, উন্নয়নমূলক কাজে গতি এসেছে এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি, তিনি হিন্দুত্ব সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলিকেও দৃঢ়তার সাথে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। ২০২২ সালে দ্বিতীয়বার মুখ্যমন্ত্রী হয়ে তিনি প্রমাণ করেছেন যে জনমনে তাঁর আধিপত্য দৃঢ় এবং তাঁর নেতৃত্ব স্থিতিশীল ও নির্ভরযোগ্য।

সমাজসেবা ও হিন্দুত্বের দৃঢ় পরিচয়

গোরখপুরে তাঁর কর্মকালে তিনি গোরক্ষপীঠকে কেবলমাত্র ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবেই নয়, সামাজিক ও স্বাস্থ্যসেবার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলেছেন। তিনি গুরু গোরক্ষনাথ হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ, গৌশালা এবং জনতা দরবারের মাধ্যমে সরাসরি সাধারণ মানুষের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেছেন।

ধর্মান্তরণ ও ঘর-ফেরতের মতো বিষয়ে তিনি কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছেন। তিনি হিন্দু যুব বাহিনীর মতো সংগঠনের মাধ্যমে সামাজিক সচেতনতা ছড়িয়ে দিয়েছেন। তবে, তাঁর এই অবস্থান নিয়ে অনেক সমালোচনা হলেও তিনি কখনোই তাঁর পথ থেকে সরে যাননি।

সামাজিক ও রাজনৈতিক সাফল্য

মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের নেতৃত্বে উত্তরপ্রদেশে অনেক বড় সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন দেখা গেছে। তিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষার উন্নয়নের জন্য পুলিশ সংস্কার ও অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। অবৈধ খননের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে পরিবেশ রক্ষা করেছেন এবং সরকারি রাজস্বও বৃদ্ধি করেছেন। মন্দির ও ধর্মীয় স্থানগুলির উন্নয়ন করে ধর্মীয় পর্যটনকে উৎসাহিত করেছেন। পাশাপাশি, যোগ ও আধ্যাত্মিকতাকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য অনেক কর্মসূচি শুরু করেছেন। তাঁর আমলে উত্তরপ্রদেশে সড়ক, হাসপাতাল, স্কুল এবং বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাপক কাজ হয়েছে, যার ফলে রাজ্যের ইমেজ বদলেছে এবং উন্নয়নের গতি বেড়েছে।

```

Leave a comment