‘ইন ট্রানজিট’: ভারতের ট্রান্সজেন্ডার ও নন-বাইনারিদের জীবনের অন্তরঙ্গ চিত্র

‘ইন ট্রানজিট’: ভারতের ট্রান্সজেন্ডার ও নন-বাইনারিদের জীবনের অন্তরঙ্গ চিত্র
সর্বশেষ আপডেট: 14-06-2025

‘ইন ট্রানজিট’ একটি শক্তিশালী ও সংবেদনশীল ডকুমেন্টারি সিরিজ, যা ভারতের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের গভীরে লুকিয়ে থাকা সেসব কণ্ঠকে সামনে নিয়ে আসে যাদের প্রায়ই উপেক্ষা করা হয়। এই সিরিজ নয়জন ট্রান্সজেন্ডার ও নন-বাইনারি ব্যক্তির জীবনে গভীরে প্রবেশ করে।

  • ওয়েব সিরিজ রিভিউ: ইন ট্রানজিট
  • অভিনয়শিল্পী: সাহার নাজ, অনুভূতি বন্দ্যোপাধ্যায়, পটরুনি চিদানন্দ শাস্ত্রী, রুমি হরিশ
  • পরিচালক: আয়িশা সূদ
  • শ্রেণী: হিন্দি, ডকুমেন্টারি, নাটক
  • সমালোচকদের রেটিং: ৩.৫/৫

মনোরঞ্জন: ভারতে ট্রান্সজেন্ডার ও নন-বাইনারি সম্প্রদায়ের কণ্ঠ দীর্ঘদিন ধরেই উপেক্ষিত, অদৃশ্য ও অবহেলিত ছিল। কিন্তু ওটিটি প্ল্যাটফর্মের এই যুগে, কিছু নির্মাতা এখন সেসব গল্প সামনে আনার চেষ্টা করছেন যা সমাজের প্রকৃত স্তরগুলিকে উন্মোচন করে। এই ধারাবাহিকতায় আসা ডকুমেন্টারি ওয়েব সিরিজ ‘ইন ট্রানজিট’ একটি সাহসী, আবেগঘন ও সৎ প্রয়াস, যা ভারতের নয়জন ট্রান্সজেন্ডার ও নন-বাইনারি মানুষের ব্যক্তিগত জীবনযাত্রার চিত্র তুলে ধরে।

গল্প নয়, বাস্তব জীবনই ‘ইন ট্রানজিট’

‘ইন ট্রানজিট’ কোন কাল্পনিক কাহিনী নয়। এটি নয়জন বাস্তব মানুষের গল্পের সমাহার, যাদের পরিচয় ও অস্তিত্বের লড়াই প্রতিদিন নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসে। এই ডকুমেন্টারি মুম্বই, বেঙ্গালুরু, জামশেদপুর, ত্রিপুরা ও হরিয়ানা-সহ বিভিন্ন অঞ্চলের এই ব্যক্তিদের কণ্ঠ উঠিয়ে ধরে। সিরিজ দেখায় যে ট্রান্সজেন্ডার হওয়ার সংগ্রাম শুধু শারীরিক নয়, সমাজ, পরিবার, প্রতিষ্ঠান ও নিজের ভেতরের ভয় থেকেও।

প্রথম পর্বে সকল নয়জন চরিত্রের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়, কিন্তু পরবর্তী পর্বগুলিতে ক্যামেরা প্রত্যেকের জীবনে ধীরে ধীরে গভীরে প্রবেশ করে— আবেগগত সংগ্রাম, আত্ম-স্বীকৃতির যন্ত্রণা ও পরিচয়ের জন্য লড়াইয়ের বিস্তারিত চিত্র তুলে ধরে।

প্রতিটি গল্প, একটি অশ্রুত অধ্যায়

অনুভূতি বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প আশার আলো দেখায়, যেখানে পরিবারের সমর্থন কোন আশীর্বাদ থেকে কম নয়। তিনি এখন কর্পোরেট সেক্টরে উচ্চপদে কর্মরত। অন্যদিকে টিনা নাজ, হরিয়ানার একটি গ্রাম থেকে, যিনি সমাজের অনীহা, অর্থনৈতিক দুর্দশা ও অস্বীকৃতির মধ্য দিয়ে গেছেন। তাঁর চোখে আজও সংগ্রামের গভীরতা দেখা যায়।

আর্যন সোমাইয়ার কথা মর্মস্পর্শী ও কষ্টদায়ক, যিনি বহু বছর ধরে নিজের শারীরিক অবস্থা স্বীকার করতে পারেননি। তাঁর অভিজ্ঞতা মানসিক নির্যাতন ও আত্ম-অস্বীকৃতির কঠোর সত্য উন্মোচন করে। মাধুরী সরোদে শর্মা, যিনি নিজের ট্রান্স পরিচয় নিয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া প্রথম নারী, সমাজের জন্য অনুপ্রেরণা। তাঁর যাত্রা দেখায় যে ভালোবাসা ও গ্রহণযোগ্যতার কোন সীমা নেই।

নির্মাণ, উপস্থাপনা ও চিত্রায়ন শৈলী

জোয়া আখতার ও রীমা কাগতি প্রযোজিত এই সিরিজটি সহানুভূতি ও সংবেদনশীলতার ভারসাম্য নিয়ে তৈরি হয়েছে। পরিচালনায় ডকুমেন্টারির গুরুত্বের সাথে মানবিক স্পর্শকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। ক্যামেরা তাদের গল্পকে ব্যবহার করে না, অতিরিক্ত মেলোড্রামারও আশ্রয় নেয় না। চিত্রগ্রহণ অত্যন্ত ব্যক্তিগত ও সৎ। ক্যামেরা এই চরিত্রগুলোর অত্যন্ত সূক্ষ্ম মুহূর্তগুলিতেও তাদের ব্যক্তিগত জীবনের সম্মান রক্ষা করে। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক সাধারণ কিন্তু আবেগগুলিকে গভীরভাবে স্পর্শ করে।

আবেগগত যুক্ততা ও সমাজে প্রভাব

‘ইন ট্রানজিট’-এর সবচেয়ে বড় শক্তি হলো এটি দর্শকদের শুধু তথ্য নয়, বুঝ ও অনুভূতি দেয়। আপনি এই নয়জন মানুষের গল্প দেখেন না, অনুভব করেন। তাদের চোখে ব্যথা ও আশার সেই মিশ্রণ আছে, যা আপনাকে পর্দার সাথে বেঁধে রাখে। যদিও সিরিজে ট্রান্স মানুষের গল্পগুলো অসাধারণভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, কিন্তু তাদের পরিবার, সঙ্গী বা সমাজের সাথে আলাপের অভাব কিছুটা বিরক্তিকর। এই দিকটি টিনা নাজের মতো কিছু চরিত্রের গল্পে দেখানো হয়েছে, কিন্তু বাকি চরিত্রগুলোর সামাজিক মিথস্ক্রিয়া আরও তুলে ধরা যেতে পারত।

‘ইন ট্রানজিট’ শুধু একটি ওয়েব সিরিজ নয়— এটি একটি দলিল, সেই সামাজিক পরিবর্তনের, যার ভারতের অত্যন্ত প্রয়োজন। ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়কে শুধু আইনে নয়, হৃদয়ে ও মনেও স্থান দরকার। এই সিরিজ সেই জানালা খুলে দেয়। জোয়া আখতার ও রীমা কাগতির এই উপস্থাপনা শুধু LGBTQIA+ দর্শকদের জন্য নয়, বরং প্রত্যেক মানুষের জন্য, যারা মানবতাকে অনুভব করেন। এই সিরিজ স্কুল, কলেজ ও প্রতিষ্ঠানে দেখানো উচিত— যাতে পরবর্তী প্রজন্ম শুধু সহনশীল না হয়, বরং সত্যিকার অর্থে অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়।

Leave a comment