২৬ জুন ২০২৫ থেকে গুপ্ত নবরাত্রির শুভারম্ভ হতে চলেছে। এই পর্ব সাধক ও তান্ত্রিকদের জন্য অত্যন্ত বিশেষ, যারা শক্তির সাধনার গূঢ় পথে অগ্রসর। যেখানে শারদীয় ও চৈত্র নবরাত্রি জনসাধারণ বড় উল্লাসে পালন করে, সেখানে গুপ্ত নবরাত্রি আন্তরিক সাধনা, আত্ম-শুদ্ধি ও দেবীর রহস্যময়ী রূপের উপাসনার সময়।
এই উপলক্ষ্যে মূলত দশ মহাবিদ্যার পূজা করা হয়। এই মহাবিদ্যাগুলি মা দুর্গার দশ রূপ এবং তন্ত্রশাস্ত্রে অত্যন্ত শক্তিশালী ও রহস্যময়ী বলে মনে করা হয়। এদের সাধনার দ্বারা সাধক সাংসারিক বন্ধন থেকে মুক্তি, সিদ্ধি এবং অদ্ভুত শক্তির প্রাপ্তি লাভ করে।
গুপ্ত নবরাত্রি: সাধনার রহস্যময় পর্ব
গুপ্ত নবরাত্রি বছরে দুইবার আসে, প্রথম আষাঢ় মাসে এবং দ্বিতীয় মাঘ মাসে। এই নবরাত্রিগুলি বিশেষ করে গূঢ় সাধনা ও তান্ত্রিক ক্রিয়াগুলির জন্য পরিচিত। এই নয় দিনে তান্ত্রিক সাধকগণ দুর্গার দশ মহাবিদ্যার আরাধনা করেন। ২৬ জুন সকাল ৫:২৫ টা থেকে ৬:৫৮ টার মধ্যে ঘটস্থাপনার শুভ মুহূর্ত। এই সময়ের মধ্যে শুভ সংকল্প নিয়ে দেবীর মূর্তি অথবা কলসের স্থাপনা করা হয়।
কোনরা দশ মহাবিদ্যা? জেনে নিন প্রতিটি দেবীর রূপ ও গুরুত্ব
১. কালী মা – অজ্ঞানের বিনাশকারীণী
মা কালীকে দশ মহাবিদ্যার মধ্যে সর্বোচ্চ স্থান প্রাপ্ত। এঁরা মা দুর্গার অত্যন্ত রুদ্র রূপ। তাঁর কালো রং অন্ধকারের প্রতিনিধিত্ব করে এবং তিনি সেই অন্ধকারের বিনাশ করে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেন। কালীর সাধনার দ্বারা সাধক ভয়, মৃত্যু ও কালের উপর বিজয় লাভ করে।
- পূজন ফল: ভয়মুক্ত জীবন, কালবিজয়, তান্ত্রিক সিদ্ধি
২. তারা দেবী – মুক্তি ও করুণার দেবী
মা তারাকে ব্রহ্মজ্ঞান ও মুক্তির দেবী বলে মনে করা হয়। এঁদের সাধনার দ্বারা সাধক জীবনের ভৌতিক বন্ধন থেকে মুক্তির পথ পায়। তারার রূপ শান্ত, কিন্তু ভিতর থেকে তিনি চৈতন্য ও তেজোময়ী।
- পূজন ফল: জ্ঞান, মানসিক শান্তি, মোক্ষপ্রাপ্তি
৩. ত্রিপুর সুন্দরী – সৌন্দর্য ও প্রেমের অধিষ্ঠাত্রী
ত্রিপুর সুন্দরীকে শৃঙ্গারের রূপ বলে মনে করা হয়। তিনি প্রেম, সৌন্দর্য, সমৃদ্ধি ও ভোগের দেবী। এঁদের সাধনার দ্বারা সাংসারিক ও আধ্যাত্মিক উভয় প্রকার উন্নতি সম্ভব। এঁকে ‘ললিতা’ নামেও জানা হয়।
- পূজন ফল: ভৌতিক সমৃদ্ধি, আকর্ষণ, বৈবাহিক সুখ
৪. ভুবনেশ্বরী দেবী – সৃষ্টির অধিপতি
মা ভুবনেশ্বরীকে সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডের অধিষ্ঠাত্রী বলে মনে করা হয়। এঁদের উপাসনার দ্বারা সাধক ব্রহ্মাণ্ডীয় চেতনায় যুক্ত হওয়ার শক্তি পায়। এঁদের রূপ করুণাময়ী ও মাতৃবৎ।
- পূজন ফল: আধ্যাত্মিক উন্নতি, সৃজনশীলতা, মানসিক সাম্য
৫. ছিন্নমস্তা – আত্মবলিদান ও পরিবর্তনের দেবী
এই দেবী নিজেরই মাথা কেটে নিজের রক্তে অন্যদের তৃপ্ত করেন। তাঁর এই রূপ আত্মবলিদান, ত্যাগ ও আন্তরিক পরিবর্তনের প্রতীক। এঁদের পূজা অত্যন্ত জটিল এবং কেবলমাত্র অভিজ্ঞ সাধকই এটি করেন।
- পূজন ফল: ত্যাগের भावना, আন্তরিক শক্তি, পরিবর্তন
৬. ত্রিপুর ভৈরবী – চেতনা ও তপস্যার দেবী
মা ত্রিপুর ভৈরবীর রূপ রৌদ্র। তিনি তপস্যা, অনুশাসন ও সাধনার প্রতীক। এঁদের পূজার দ্বারা সাধক জীবনে স্থিরতা ও শক্তি পায়। তিনি শক্তির ভৌতিক রূপের প্রতীক বলে মনে করা হয়।
- পূজন ফল: আত্মনিয়ন্ত্রণ, সাধনা সিদ্ধি, লক্ষ্য প্রাপ্তি
৭. ধূমাৱতী – রহস্য ও বৈরাগ্যের দেবী
মা ধূমাৱতীর রূপ বৃদ্ধা ও বিধবার। তিনি মায়াজাল, প্রতারণা ও ভ্রম থেকে মুক্তিকারীণী দেবী। বলা হয়, তিনি একমাত্র এমন দেবী যিনি একা থাকতে পছন্দ করেন। এঁদের পূজা অধিকাংশ তান্ত্রিক বা ত্যাগী সাধক করেন।
- পূজন ফল: মোহমুক্তি, তান্ত্রিক জ্ঞান, বৈরাগ্য
৮. বগলামুখী – শত্রুদের উপর বিজয়ী দেবী
বগলামুখী দেবীর উপাসনা বিশেষ করে শত্রুদের বশীভূত করতে, ন্যায়িক বিষয়ে সফলতা লাভ করতে এবং বিরোধীদের পরাজিত করার জন্য করা হয়। এঁদের পূজার দ্বারা সাধক তর্ক, বাক্ ও যুক্তিতে বিজয় লাভ করে।
- পূজন ফল: শত্রু নিয়ন্ত্রণ, বাদ-বিবাদে জয়, সুরক্ষা
৯. মাতঙ্গী – কলা, সংগীত ও বাক্য়ের দেবী
মা মাতঙ্গীকে সরস্বতীর তান্ত্রিক রূপ বলে মনে করা হয়। তিনি সংগীত, সাহিত্য, কলা ও বাক্য়ের অধিষ্ঠাত্রী। এঁদের উপাসনার দ্বারা সাধক অদ্ভুত বৌদ্ধিক ও কলাত্মক ক্ষমতা লাভ করে।
- পূজন ফল: বাক্সিদ্ধি, কাব্য-কলায় দক্ষতা, বুদ্ধি বিকাশ
১০. কমলাত্মিকা (কমলা দেবী) – লক্ষ্মীর তান্ত্রিক রূপ
কমলা দেবীকে ধন, ऐश्वर्य, সুখ ও ভাবের দেবী বলে মনে করা হয়। তিনি মা লক্ষ্মীর তান্ত্রিক রূপ। এঁদের পূজা বিশেষ করে সমৃদ্ধি, সৌভাগ্য ও সাংসারিক সুখের প্রাপ্তির জন্য করা হয়।
- পূজন ফল: ধনলাভ, সমৃদ্ধি, সুখ-শান্তি
কেন গুপ্ত নবরাত্রিতে এই দেবীদের পূজা করা হয়?
গুপ্ত নবরাত্রি কেবলমাত্র ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং একটি আধ্যাত্মিক অনুশীলন ও তান্ত্রিক জাগ্রতের সময়। এই দশ মহাবিদ্যার পূজা সাধকের ভিতরের দশ প্রকার মানসিক, আধ্যাত্মিক ও ভাবগত বাধা দূর করে। এই মহাবিদ্যাগুলির সাধনার দ্বারা সাধক আত্মজ্ঞানের দিকে অগ্রসর হয়, আত্মবল ও আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়। এই সাধনা বহির্মুখী আড়ম্বর থেকে দূরে, অন্তরাত্মার ডাক ও দেবী চেতনার অনুভূতির মাধ্যম হয়ে ওঠে।