আষাঢ় মাস হিন্দু পঞ্জিকার অনুযায়ী বিশেষ আধ্যাত্মিক গুরুত্ব বহন করে। এটি দুটি ঋতু—গ্রীষ্ম ও বর্ষা—এর সংযোগকাল। এই সময় ভগবান বিষ্ণু যোগনিদ্রায় চলে যান এবং সৃষ্টির পরিচালনার ভার ভগবান শিব বহন করেন। বিশ্বাস করা হয় আষাঢ় মাসে শিবের উপাসনা করলে আত্মশুদ্ধি, মানসিক শান্তি এবং জীবনে সুখ-সমৃদ্ধি লাভ হয়। এই মাসটি ভক্তদের শ্রাবণের শিবভক্তির জন্য মানসিক ও আধ্যাত্মিকভাবে প্রস্তুত করে।
আষাঢ় মাসের ধর্মীয় গুরুত্ব
হিন্দু ধর্মে আষাঢ় মাস একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে কারণ এটি বছরের সেই সময় যখন প্রকৃতি রূপান্তরের ধাপে ধাপে অগ্রসর হয়। গ্রীষ্মের তাপ ধীরে ধীরে বর্ষার শীতলতায় পরিবর্তিত হতে থাকে। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এই সময়টি শুধুমাত্র দেহ ও মনকে শুদ্ধ করার সুযোগ নয়, আত্মাকেও আধ্যাত্মিকতার দিকে ঠেলে দেওয়ার শ্রেষ্ঠ সময় হিসেবে বিবেচিত হয়।
এই বছর আষাঢ় মাসের সূচনা ১২ জুন থেকে হয়েছে এবং এটি ১০ জুলাই পর্যন্ত চলবে। এই সময়কালে শিব উপাসনা, জলাভিষেক, মন্ত্রজাপ এবং দান-পুণ্য বিশেষ ফলপ্রসূ বলে মনে করা হয়।
ভগবান বিষ্ণুর যোগনিদ্রা ও শিবের সৃষ্টি পরিচালনা
আষাঢ় শুক্ল একাদশী, যাকে ‘দেবশয়নী একাদশী’ বলা হয়, এবার ৬ জুলাই পড়ছে। এই দিনেই ভগবান বিষ্ণু ক্ষীরসাগরে চার মাসের জন্য যোগনিদ্রায় চলে যান। এই সময়টিকে ‘চাতুর্মাস’ এর সূচনা বলে মনে করা হয়।
চাতুর্মাসের সময় ভগবান বিষ্ণুর দৈনন্দিন কার্যকলাপ স্থগিত বলে মনে করা হয় এবং সৃষ্টি পরিচালনার কাজ ভগবান শিব নিজের হাতে নেন। বিশ্বাস করা হয় এই সময় ভোলানাথ তাঁর পুরো পরিবারসহ পৃথিবীতে বাস করেন। এই সময় যারা শিবের পূজা-অর্চনা করে তাদের বিশেষ আধ্যাত্মিক লাভ হয়।
শিব পূজার প্রথা ও বিধি
আষাঢ় মাসে সূর্যোদয়ের আগে উঠে স্নান করা, সূর্যকে অর্ঘ্য দেওয়া এবং তারপর ইষ্টদেবতার পূজা করা অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়। এর পরে ভগবান শিবের বিধিপূর্ণ জলাভিষেক করার প্রথা আছে।
শিবলিঙ্গে জল ও দুধের অভিষেক
জলাভিষেক ও দুগ্ধাভিষেক শিবভক্তদের কাছে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। শিবলিঙ্গে বেলপাতা, ধতুরা, ভস্ম ও আকের ফুল অর্পণ করাও শুভ বলে মনে করা হয়।
মন্ত্রজাপ ও আরতি:
“ॐ नमः शिवाय” মন্ত্র জপ, শিব চালিসা পাঠ এবং শিব আরতি করলে মানসিক শান্তি পাওয়া যায় এবং জীবনের নেতিবাচক শক্তির ধ্বংস হয়।
দান-পুণ্যের গুরুত্ব:
এই মাসে দানের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। ধান্য, বস্ত্র, জলপাত্র, ছাতা এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দান করলে পুণ্য লাভ হয়।
শিব পঞ্চাক্ষর স্তোত্র পাঠ কেন বিশেষ
শিব পঞ্চাক্ষর মন্ত্র “ॐ नमः शिवाय” কে পাঁচটি তত্ত্বের প্রতীক বলে মনে করা হয়—পৃথিবী, জল, অগ্নি, বায়ু ও আকাশ। এই মন্ত্রের উপর ভিত্তি করে একটি স্তোত্র আছে—শিব পঞ্চাক্ষর স্তোত্র, যার নিয়মিত পাঠ করলে আধ্যাত্মিক শক্তি ও আত্মবলে বৃদ্ধি হয়।
এই স্তোত্রের পাঁচটি শ্লোক আছে, যা ক্রমশঃ ‘ন’, ‘ম’, ‘শি’, ‘বা’ এবং ‘য়’ অক্ষরকে উৎসর্গ করা হয়েছে। প্রতিটি শ্লোকে শিবের এক একটি গুণ বা রূপের গুণকীর্তন করা হয়েছে। এর পাঠ করলে ভক্ত শিবলোক লাভ করে এবং জীবনে মোক্ষের পথ প্রশস্ত হয়।
আষাঢ় মাস ও শ্রাবণের প্রস্তুতি
আষাঢ়কে শ্রাবণের জন্য ভূমিকা প্রস্তুতকারী মাস বলা যেতে পারে। শিবভক্তরা এই মাসে তাদের আস্থা, সাধনা ও অনুশাসন দ্বারা নিজেদের শ্রাবণে হতে চলা শিব উপাসনার জন্য প্রস্তুত করেন।
শ্রাবণে শিবের বিশেষ পূজন করা হয় এবং আষাঢ়ে প্রাথমিক সাধনা করে মনকে একাগ্র করা হয়। এই সময়কালে করা সাধনার প্রভাব বেশি হয় কারণ এই সময়টি প্রাকৃতিক ও আধ্যাত্মিক উভয় দিক থেকেই পরিবর্তনের সময়।
স্বাস্থ্য ও মনের জন্যও উপকারী এই কাল
আষাঢ়ের সময় জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নানা রকমের রোগ ছড়াতে পারে। তাই দেহের শুদ্ধি ও মনের স্থিরতা বজায় রাখার জন্য আয়ুর্বেদিক নিয়ম অনুযায়ী দিনচর্যা অবলম্বন করা উপকারী।
প্রাতঃকাল যোগ, ধ্যান ও প্রাণায়াম করে শুধুমাত্র শরীর সুস্থ রাখা যায় না, মনকেও সক্রিয় শক্তি দিয়ে পূর্ণ করা যায়। শিব উপাসনা এই মানসিক শুদ্ধির সবচেয়ে সহজ ও কার্যকর উপায়।
তীর্থযাত্রা ও পুণ্যকর্মের গুরুত্ব
আষাঢ় মাসে তীর্থযাত্রা করাও শুভ বলে মনে করা হয়। বিশেষ করে গঙ্গাস্নান, শিবধামের যাত্রা এবং পবিত্র নদীর দর্শন করে ধর্মলাভ করা যায়।
যারা কোনো কারণে তীর্থযাত্রা করতে পারেন না তারা ঘরেই গঙ্গাজল দিয়ে স্নান করে, তুলসী, গীতা এবং শিবপুরাণ পাঠ করে পুণ্য অর্জন করতে পারেন।
শিবের চরণে আত্মিক শান্তির প্রাপ্তি
আষাঢ় মাস সেই সুযোগ যখন মানুষ জীবনের দৌড়ঝাঁপ থেকে কিছুক্ষণ সময় বের করে ঈশ্বরের দিকে ফিরে আসে। এই মাসটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে জীবনের সত্যিকারের দিক আধ্যাত্মিক উন্নতি ও আত্মিক ভারসাম্য।
শিব পূজা কেবল ধর্মীয় কার্যক্রম নয়, এটি আমাদের আত্মাকে শুদ্ধ করার মাধ্যম। যে কোন ভক্ত সত্যিকারের মনে ভোলানাথের উপাসনা করে, সে কেবল মানসিক শান্তিই পায় না, জীবনের কঠিন সমস্যা মোকাবেলার শক্তিও পায়।