শেখচাল্লীর চাকরির গল্প
শেখচাল্লী এক ধনী লোকের বাড়িতে চাকরি পেল। সেই ধনী লোকটি তাকে তার উট চড়ানোর কাজ দিল। শেখচাল্লী প্রতিদিন উটগুলোকে চরাতে জঙ্গলে নিয়ে যেত এবং সন্ধ্যায় তাদের চড়িয়ে বাড়িতে ফিরিয়ে আনত। একদিন যখন শেখচাল্লী উটগুলোকে চরাতে জঙ্গলে গেল, তখন সে তাদের চড়তে ছেড়ে দিয়ে নিজে গাছের নিচে ঘুমিয়ে পড়ল। এই সময় কেউ একজন উটগুলোর দড়ি ধরে নিয়ে গেল। যখন শেখচাল্লীর ঘুম ভাঙল এবং সে উটগুলোকে সেখানে দেখতে পেল না, তখন সে ঘাবড়ে গেল। শেখচাল্লী সেখানেই প্রতিজ্ঞা করল যে, সে মালিকের বাড়ি তখনই যাবে, যখন সে সব উট খুঁজে ফিরিয়ে আনবে। উটগুলোর খোঁজে শেখচাল্লী জঙ্গলে এদিক-ওদিক ঘুরতে লাগল। তার উটগুলোর নামও মনে ছিল না। এমন সময় সে মালিকের গ্রামের কিছু লোককে সামনে থেকে আসতে দেখল। শেখচাল্লী তাদের উটের বিষ্ঠা দেখিয়ে বলল যে, আমরা যার চাকর, তাকে গিয়ে বলো যে, যার এই বিষ্ঠা, সে চলে গেছে।
শেখচাল্লী বোকা ছিল, আর এটা তো সবাই জানে যে বোকাদের রাগ খুব তাড়াতাড়ি হয়। একদিনের কথা, যখন শেখচাল্লী রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল, তখন কিছু ছেলে তাকে বিরক্ত করতে শুরু করল। একজন ছেলে বলে মহামূর্খ, তো অন্য ছেলেরা বলে জিন্দাবাদ। ছেলেরা এটা বলার পরে ঘরের মধ্যে লুকিয়ে যেত, আর শেখচাল্লী নিজের রাগ হজম করে থাকত। একদিনের কথা, শেখচাল্লীর হাতে একটি ছোট ছেলে ধরা পড়ে গেল। তারপর আর কী, রেগে গিয়ে শেখচাল্লী ছেলেটিকে কুয়োর মধ্যে ফেলে দিল এবং বাড়ি এসে নিজের স্ত্রীকে এই কথা জানাল। শেখচাল্লীর স্ত্রী রাতে শেখচাল্লী ঘুমিয়ে যাওয়ার পরে গিয়ে সেই ছোট ছেলেটিকে কুয়ো থেকে বের করল। বাইরে খুব ঠান্ডা ছিল আর জলের মধ্যে থাকার কারণে ছেলেটির অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। শেখচাল্লীর স্ত্রী ছেলেটিকে তার ভাইয়ের কাছে নিয়ে গেল এবং সব কথা জানাল।
শেখচাল্লীর শালা নিজের বোনকে বলল, তোর কথা তো ঠিক আছে, কিন্তু যখন এই বাচ্চার মা-বাবা একে খুঁজতে আসবে তখন কী হবে? শেখচাল্লীর স্ত্রী বলল, "ভাই, আমরা যদি এই বাচ্চাটিকে এই অবস্থায় তার মা-বাবার কাছে দিই, তাহলে অকারণে ঝামেলা হবে এবং কথা বেড়ে যাবে। তাই বাচ্চাটি একটু আরাম পাক, ততক্ষণ তুই একে তোর কাছে রাখ। যদি তার মা-বাবা তাকে খুঁজতে আসে, তাহলে আমি তাদের বুঝিয়ে নেব।" এরপর শেখচাল্লীর স্ত্রী নিজের বাড়ি ফিরে গেল এবং একটি ছাগলের বাচ্চাকে কুয়োতে ফেলে এল, যে কুয়োতে শেখচাল্লী সেই ছোট বাচ্চাটিকে ফেলেছিল। পরের দিন সকালে যখন সেই ছোট ছেলেটির মা-বাবা তার খোঁজে শেখচাল্লীর বাড়ির দিকে এল, তখন শেখচাল্লী নিজের বাড়ির গলিতে ঘুরছিল। ছোট ছেলেটির বাবা শেখচাল্লীকে জিজ্ঞাসা করল যে, সে তাদের ছেলেকে দেখেছে কি না?
শেখচাল্লী উত্তর দিল, "হ্যাঁ, সেই ছোট বদমাশটা কালকে আমার মজা উড়িয়েছিল, আর আমি তাকে সামনের কুয়োতে ফেলে দিয়েছি।" ছোট ছেলেটির মা-বাবা দৌঁড়ে সেই কুয়োর কাছে পৌঁছল এবং গ্রামের এক লোককে তাড়াতাড়ি কুয়োতে নামাল। সেই লোকটি কুয়োর ভেতর থেকে আওয়াজ দিল যে, "সাহেব, এখানে কোনো ছেলে-পেলে তো নেই, হ্যাঁ, একটা ছাগলের বাচ্চা আছে।" এই কথা বলে সে ছাগলের বাচ্চাটিকে দড়ি দিয়ে বেঁধে উপরে পাঠাল। বাচ্চাটিকে সেখানে না পেয়ে তার মা-বাবা খুব চিন্তিত হয়ে পড়ল এবং শহরের অন্য অংশে তার খোঁজ করতে লাগল। এই সময়ের মধ্যে বাচ্চাটি যখন একটু সুস্থ হল, তখন শেখচাল্লীর শালা তাকে তার বাড়িতে রেখে এল। এই সব হওয়ার কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত বেচারা শেখচাল্লী এই ভেবে চিন্তিত ছিল যে, সে তো কুয়োতে মানুষের বাচ্চাকেই ফেলেছিল, তাহলে সেটা ছাগলের বাচ্চা কী করে হয়ে গেল।
এই ঘটনার অনেক দিন পর শেখচাল্লী অন্য এক ধনী লোকের বাড়িতে চাকরি পেল। শেখচাল্লী সেখানে দেখাশোনার কাজ করত। একদিন যখন সে আর তার মালিক গাড়িতে চড়ে বাজারে যাচ্ছিল, তখন শেখচাল্লী মালিকের সঙ্গে গাড়ির পিছনে বসেছিল। গাড়ি চলার সময় জোরে হাওয়ার কারণে শেখচাল্লীর মালিকের রেশমি রুমাল হাওয়ায় পড়ে গেল। মালিক রুমাল পড়ার সময় টের পায়নি, কিন্তু শেখচাল্লী এটা দেখে নিয়েছিল। শেখচাল্লী রুমালটা পড়তে দেখলেও, না তো সেটা তুলল, আর না সে এই বিষয়ে মালিককে কিছু জানাল। ঘটনাক্রমে মালিক রাস্তার ধারে একটি দোকানের কাছে গিয়ে দাঁড়াল, আর যখন তার রুমালের দরকার পড়ল, তখন সে নিজের পকেট খুঁজতে লাগল। যখন সে কোথাও রুমাল খুঁজে পেল না, তখন সে এই বিষয়ে শেখচাল্লীকে জিজ্ঞাসা করল। তখন শেখচাল্লী উত্তর দিল, "সরকার, আপনার রুমাল তো বাজারের কাছেই পড়ে গিয়েছিল।"
এই কথা শুনে মালিক শেখচাল্লীকে ধমক দিয়ে বলল, "তুই বেওকুফ, সেটা কেন তুলিসনি?" শেখচাল্লী হাত জোড় করে উত্তর দিল, "সরকার, হুকুম তো ছিল না আপনার।" মালিক রেগে গিয়ে শেখচাল্লীকে বলল, "এই কথাটা মনে রাখবি যে, কোনো জিনিস আমাদের গাড়ি থেকে বা আমাদের জিনিস নিচে পড়লে সেটা যেন সঙ্গে সঙ্গে তুলে নেওয়া হয়।" শেখচাল্লী মালিকের এই ফরমান মনে রেখে দিল এবং বলল যে, সে এই বিষয়টার পুরো খেয়াল রাখবে এবং এর পর থেকে এই ধরনের অভিযোগের কোনো সুযোগ সে দেবে না। পরের দিন যখন শেখচাল্লী আর তার মালিক ঘুরতে গেল, তখন তার মালিকের ঘোড়া রাস্তায় বিষ্ঠা করে দিল। শেখচাল্লী সঙ্গে সঙ্গে নিজের ঘোড়া থেকে নেমে বিষ্ঠাটা কাপড়ে বাঁধল এবং নিজের কাছে রাখল। যখন শেখচাল্লী আর তার মালিক বাড়ি পৌঁছল, তখন তাদের বাড়িতে একজন অতিথি এল।
মালিক আর তার অতিথি যখন একে অপরের সঙ্গে কথা বলছিল, তখন শেখচাল্লী নিজের সততার প্রমাণ দেওয়ার জন্য সেই কাপড়ে বাঁধা বিষ্ঠাটা মালিকের সামনে পেশ করল। যখন শেখচাল্লী মালিককে কাপড়টা দিচ্ছিল, তখন সে খুব সম্মানের সঙ্গে বলল, "মালিক, আপনার আজ্ঞা অনুসারে ঘোড়া থেকে পড়া জিনিসটা আমি তুলে এনেছি।" শেখচাল্লী মালিকের সেই অতিথির সামনে যখন টেবিলের ওপর রেখে কাপড়টা খুলল, তখন অতিথি জোরে জোরে হাসতে লাগল। মালিক যখন ঘোড়ার বিষ্ঠাটা টেবিলের ওপর দেখল, তখন তারা খুব রেগে গেল। শেখচাল্লী পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে চুপচাপ নিজের পা পিছিয়ে নিল। এই ঘটনার পর একদিন শেখচাল্লী তার মালিকের ঘোড়াকে জল খাওয়াতে নদীতে নিয়ে গেল। যখন শেখচাল্লী ঘোড়াকে জল খাওয়াতে লাগল, তখন সে দেখল যে সেখানে জল কম আর কাদা বেশি, তাই কেন না ঘোড়াকে একটু আগে নিয়ে গিয়ে জল খাওয়ানো হয়।
শেখচাল্লী ঘোড়াকে আগে নিয়ে গেল। সেখানে জলের স্রোত তেজ ছিল এবং গভীরতাও বেশি ছিল। শেখচাল্লী সেই জায়গাতেই ঘোড়াকে জল খাওয়াতে লাগল। নদীতে জল গভীর ছিল, তাই শেখচাল্লী ঘোড়ার দড়ি ছেড়ে দিল এবং তাকে আগে করে দিল। জলের স্রোত তেজ হওয়ার কারণে শেখচাল্লী ঘাবড়ে গেল এবং সে এই ভেবে কিনারের দিকে দৌড়ে এল যে ঘোড়াও তার দিকেই ফিরে আসবে, কিন্তু জলের তেজ স্রোতে ঘোড়াটি ভেসে গেল। শেখচাল্লী ঘোড়াকে নদীতে ভেসে যেতে দেখে চিৎকার করতে শুরু করল যে, ঘোড়া পালিয়ে গেছে, ঘোড়া পালিয়ে গেছে। এইভাবে চিৎকার করতে করতে শেখচাল্লী তার মালিকের কাছে পৌঁছল। হাঁপাতে হাঁপাতে শেখচাল্লী মালিককে সব কথা জানাল। মালিক তার কথা বিশ্বাস করে নিজের তলোয়ার তুলে নিল এবং শেখচাল্লীর সঙ্গে নদীর দিকে রওনা দিল।
মালিক ভাবল যে, ওটা তার নিজের ঘোড়া আর সেটা নদীর কাছেই কোথাও থাকবে। যখন শেখচাল্লী আর তার মালিক নদীতে পৌঁছল, তখন সে তার মালিককে বলল যে, আপনার এই তলোয়ার সামলানোর কী দরকার, দিন আমি ধরে নিই। আপনার এমনিই অকারণে কষ্ট হবে। তাছাড়াও নদীতে তো আমরা পৌঁছতেই চলেছি। এই কথা শুনে মালিক তার তলোয়ার শেখচাল্লীকে দিয়ে দিল। যখন তারা নদীর কিনারে পৌঁছল, তখন শেখচাল্লী মালিককে একদিকে মুখ করে দেখাল, যেখানে গভীর জলে ঘোড়াটা ভেসে গিয়েছিল। শেখচাল্লী বলল, "সরকার, ঘোড়াটা এখান থেকে পালিয়েছে।" দিক দেখানোর জন্য শেখচাল্লী কোনো পাথরের বদলে নিজের হাতের তলোয়ারটি নদীতে ফেলে দিল। মালিক শেখচাল্লীর বোকামির সীমা সহ্য করতে পারল না এবং তার গালে দুটো চড় মারল। মালিক তাকে ধমক দিয়ে বলল যে, "প্রথমে তো আমার ঘোড়া ভাসালে, আর এটা দেখানোর জন্য তুমি আমার পছন্দের তলোয়ারটিও নদীতে ফেলে দিলে।"
এই গল্প থেকে এই শিক্ষা পাওয়া যায় যে – মানুষের মধ্যে নিজের বুদ্ধি থাকা খুব দরকার। না ভেবে কাজ করা লোক নিজের সঙ্গে অন্যদেরও ক্ষতি করতে পারে।
```