মুন্সি প্রেমচন্দ হিন্দি সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক হিসেবে পরিচিত। তার জন্ম ১৮৮০ সালের ৩১ জুলাই উত্তরপ্রদেশের বারাণসী জেলার লামহী গ্রামে। প্রেমচন্দ তার লেখায় সমাজের সর্বস্তরকে স্পর্শ করেছেন এবং তার গল্প ও উপন্যাসের মাধ্যমে সমাজে বিরাজমান কুসংস্কারের উপর তীব্র আঘাত হানেন। তার সাহিত্য আজও ভারতীয় সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত।
যদিও আমরা সকলেই তার লেখনীর সাথে পরিচিত, কিন্তু তার ব্যক্তিগত জীবনের বিষয়ে অনেকেরই জ্ঞান নেই। এই প্রবন্ধে আমরা মুন্সি প্রেমচন্দের জীবনের কিছু রোমাঞ্চকর ঘটনার সাথে পরিচিত হব, যা তার ব্যক্তিত্বকে আরও বিশেষ করে তুলে ধরে।
মুন্সি প্রেমচন্দের শৈশব: নাইয়ের খেলা এবং কান কাটার রোমাঞ্চকর ঘটনা
মুন্সি প্রেমচন্দের শৈশব ছিল সাধারণ, কিন্তু তার জীবনের সাথে জড়িত অনেক রোমাঞ্চকর ঘটনা তা আরও বিশেষ করে তুলে ধরে। একবার, পাড়ার অন্যান্য ছেলেদের সাথে "নাইয়ের খেলা" খেলার সময় প্রেমচন্দ ভুলবশতঃ একজন ছেলের কান কেটে ফেলে। এই খেলায় প্রেমচন্দ নাই হিসেবে অভিনয় করছিলেন এবং বাঁশের কামানি দিয়ে ওই ছেলেটির চুল কাটছিলেন। হঠাৎ কামানিটি ছেলেটির কানে লেগে যায় এবং রক্তক্ষরণ শুরু হয়। এই ঘটনাটি শুধুমাত্র প্রেমচন্দের শৈশবকে রোমাঞ্চকর করে তুলেনি, বরং এটি দেখিয়েছে যে, তার মন কখনোই কোন কাজকে হালকাভাবে নেয়নি।
এই ঘটনাটি তার জীবনের অনন্য ঘটনার মধ্যে একটি হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছে, যা পরবর্তীতে তার সাহিত্যিক যাত্রার অংশ হিসেবে সর্বদা স্মরণীয় হয়ে থাকে। প্রেমচন্দ এই ছোট্ট ঘটনার থেকেও জীবনের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন এবং তা তার গল্পে গভীরভাবে উপস্থাপন করেছেন। এই ঘটনার মাধ্যমে এটাও বোঝা যায় যে, মুন্সি প্রেমচন্দের জীবনে শৈশব থেকেই সংগ্রাম ও বুঝের অনুভূতি ছিল, যা তার লেখনীতে স্পষ্ট।
ইন্সপেক্টরকে সালাম না করে চুপ করে বসে থাকা
মুন্সি প্রেমচন্দের জীবন আত্মসম্মান ও স্বাবলম্বীতার অনবদ্য উদাহরণ, যার একটি রোমাঞ্চকর উদাহরণ পাওয়া যায় একটি ঘটনার মধ্য দিয়ে, যখন তিনি শিক্ষা বিভাগের ডেপুটি ইন্সপেক্টর ছিলেন। একদিন, একজন ইন্সপেক্টর স্কুল পরিদর্শন করে প্রেমচন্দের বাড়িতে আসেন এবং আশা করেন যে প্রেমচন্দ তাকে সালাম করবেন, যেমনটি সাধারণত হতো। কিন্তু যখন ইন্সপেক্টর তার বাড়ি দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন প্রেমচন্দ চেয়ারে আরাম করে বসে সংবাদপত্র পড়ছিলেন এবং তিনি উঠে সালাম করেননি। এটা দেখে ইন্সপেক্টরের রাগ হয় এবং তিনি প্রেমচন্দকে ডেকে পাঠান।
যখন প্রেমচন্দ সেখানে পৌঁছান, তখন ইন্সপেক্টর অভিযোগ করেন, 'তুমি আমার সামনে দিয়ে যাচ্ছিলে এবং তুমি সালামও করোনি।' এর উত্তরে প্রেমচন্দ শান্ত কিন্তু কার্যকরীভাবে উত্তর দেন, 'যখন আমি স্কুলে থাকি, তখন আমি একজন কর্মচারীর মতো, কিন্তু বাড়িতে আমি নিজের রাজা।' এই উত্তরটি তার আত্মসম্মান ও স্বাবলম্বীতার भावনাকে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করে, যা যেকোনো পরিস্থিতিতে তার মূল্য এবং স্বাধীনতার সাথে আপোষ না করার দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রদর্শন করে।
অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে মুন্সি প্রেমচন্দের মতামত
মুন্সি প্রেমচন্দের ধারণা ছিল যে, অন্ধবিশ্বাস শুধুমাত্র মানুষের চিন্তাধারাকে দুর্বল করে এবং সমাজের উন্নতিতে বাধা সৃষ্টি করে। একবার তার স্ত্রী শিবরানী দেবী ঈশ্বরের নাম নেওয়ার পর, প্রেমচন্দ এটিকে অতর্কিত বিশ্বাস বলে মনে করে বলেন, 'ঈশ্বর মনের ভূত, যা মানুষকে দুর্বল করে দেয়।' এই বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট যে প্রেমচন্দ জীবনকে যুক্তি, বিবেক এবং আত্মনির্ভরতার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখেছেন। তার ধারণা ছিল যে, যেকোন ব্যক্তির নিজের চিন্তা ও বুদ্ধিমত্তার উপর পূর্ণ আস্থা থাকা উচিত, নয় যে তিনি বহির্বিশ্ব এবং অন্ধবিশ্বাসী উপাদানের প্রভাবে পড়ে নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
প্রেমচন্দের জীবন দর্শন সর্বদা এ ব্যাপারে উৎসাহিত করে যে, মানুষকে তার বিবেক ব্যবহার করা উচিত এবং অন্ধবিশ্বাস থেকে বিরত থাকা উচিত, কারণ এটি শুধুমাত্র মানসিকভাবে ক্ষতি করে না, বরং সমাজের উন্নয়নেও বাধা সৃষ্টি করে। তার এই চিন্তাধারা তার সাহিত্যেও প্রতিফলিত হয়েছে, যেখানে তিনি অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার এবং সামাজিক অসমতার উপর ক্রমাগত আঘাত হানেন। এভাবে, মুন্সি প্রেমচন্দ তার লেখনী ও চিন্তার মাধ্যমে সমাজকে সচেতন করার কাজ করেছেন।
মুন্সি প্রেমচন্দের মদ্যপান ত্যাগের সংকল্প এবং অনুপ্রেরণামূলক গল্প
মুন্সি প্রেমচন্দের জীবনের আরেকটি রোমাঞ্চকর এবং অনুপ্রেরণামূলক গল্প জড়িত তার মদ্যপান ত্যাগের সংকল্পের সাথে। ১৯২৪ সালে যখন তিনি তার বন্ধু বেদার সাহেবের সাথে প্রয়োগ গেছিলেন, তখন বেদার সাহেব তাকে মদ পান করিয়েছিলেন, কারণ তিনি নিজে মদের শখীন ছিলেন। প্রেমচন্দ, যিনি ততদিন পর্যন্ত মদ্যপান থেকে দূরে ছিলেন, সেই সময় মদ্যপানের প্রভাবে পড়ে বাড়ি ফিরেছিলেন। যখন তিনি বাড়ি পৌঁছেছেন, তখন তার স্ত্রী শিবরানী দেবী দরজা খোলেননি, কারণ ছেলেদের কাছ থেকে তাকে ইতিমধ্যেই জানা ছিল যে প্রেমচন্দ মদ্যপান করে বাড়ি ফিরেছে।
এরপর শিবরানী দেবী প্রেমচন্দকে কঠোরভাবে বলেছিলেন যে, যদি তিনি আবার মদ্যপান করে বাড়ি ফেরেন, তাহলে তিনি দরজা খুলবেন না। এই কঠোর সতর্কীকরণকে প্রেমচন্দ গুরুত্বের সাথে নিয়েছিলেন এবং সেই সময়ই তিনি মদ্যপান ত্যাগের সংকল্প নিয়েছিলেন। এর পর, প্রেমচন্দ তার জীবনে আর কখনো মদ্যপান করেননি। এই ঘটনা তার দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি এবং পরিবারের প্রতি তার দায়িত্ববোধকে প্রদর্শন করে, যা তার জীবনের শৃঙ্খলা ও আত্মসংযমের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল।
হিন্দু সভার বিরোধিতায় মুন্সি প্রেমচন্দের মতামত
মুন্সি প্রেমচন্দের লেখনী সর্বদা স্বাধীন চিন্তা ও স্বাবলম্বীতার দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিল, এবং তিনি কখনোই তার লেখনীকে কারও চাপ বা ইচ্ছানুযায়ী পরিবর্তন করতে তৈরি ছিলেন না। একবার তিনি এমন একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন, যা হিন্দু সভার সদস্যদের ক্ষুব্ধ করেছিল। এই প্রবন্ধ তার চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিফলিত করেছিল, যা সেই সময়ের সামাজিক ও ধর্মীয় ধারা থেকে কিছুটা ভিন্ন ছিল। যখন তার স্ত্রী শিবরানী দেবী তাকে জিজ্ঞাসা করলেন যে তিনি কেন এমন প্রবন্ধ লিখেন, তখন প্রেমচন্দ স্পষ্টভাবে উত্তর দিয়েছিলেন, 'লেখককে কখনো জনগণ বা সরকারের দাস হওয়া উচিত নয়।
যদি লেখক শুধুমাত্র মানুষের ইচ্ছানুযায়ী লেখেন, তাহলে তিনি আর লেখক থাকেন না।' এই উত্তর থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে প্রেমচন্দের কাছে লেখনী শুধুমাত্র শব্দের খেলা ছিল না, বরং এটি ছিল একটি স্বাধীনতার প্রকাশ। তার এই দৃষ্টিভঙ্গি তার সাহস এবং সত্যের প্রতি তার আনুগত্যকে প্রদর্শন করে। এই ঘটনা তার সাহিত্যিক জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে, যেখানে তিনি তার স্বাধীনতাকে যেকোনো বহির্বিশ্বের চাপের চেয়ে উপরে রেখেছেন এবং তার লেখনীর মাধ্যমে সমাজকে সচেতন করার চেষ্টা করেছেন।