আর্যভট্ট: জীবন, সাধনা ও অসামান্য অবদান

🎧 Listen in Audio
0:00

আর্যভট্টের জীবনী, সাধন এবং কার্যকলাপ

আর্যভট্ট প্রাচীন ভারতের একজন বিখ্যাত গণিতবিদ, জ্যোতির্বিদ এবং জ্যোতিষী। তাঁর সময়কালে বরাহমিহির, ব্রহ্মগুপ্ত, ভাস্করাচার্য, কমলাকর এবং অন্যান্য অনেক ভারতীয় পণ্ডিত আর্যভট্টের অবদানকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।

শাস্ত্রীয় যুগে, তিনি ভারতীয় গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। আর্যভট্ট হিন্দু ও বৌদ্ধ উভয় ঐতিহ্যেরই অধ্যয়ন করেছিলেন। তিনি সেই সময়ের শিক্ষাকেন্দ্র নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা লাভ করেছিলেন। তাঁর গাণিতিক গ্রন্থ "আর্যভটীয়" একটি উত্তম রচনা হিসেবে স্বীকৃত হলে, সমসাময়িক গুপ্ত শাসনের সময়কালে বুদ্ধগুপ্ত তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন।

আর্যভট্টের জন্ম

আর্যভট্টের জন্ম সম্পর্কে সঠিক প্রমাণ নেই, তবে বিশ্বাস করা হয় যে তাঁর জন্ম ৪৭৬ সালে মধ্য ভারতে, নর্মদা ও গোদাবরী নদীর মধ্যবর্তী অশ্মক দেশে, ভগবান বুদ্ধের সময়কালে হয়েছিল। আরেকটি মত অনুযায়ী, বিহারের কুসুমপুরের কাছে পাটলিপুত্রে (পাটালীপুত্র নামেও পরিচিত) তাঁর জন্ম হয়েছিল বলে মনে করা হয়।

আর্যভট্টের শিক্ষা

আর্যভট্টের শিক্ষা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায় না, তবে স্পষ্ট যে তিনি জীবনের কোনও পর্যায়ে কুসুমপুরে, যা তখন অধ্যয়নের জন্য একটি উত্তম কেন্দ্র ছিল, গিয়েছিলেন।

আর্যভট্টের কার্যকলাপ

আর্যভট্ট গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ে অনেকগুলি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, যার কিছু কালক্রমে হারিয়ে গেছে। তবে, তাঁর অনেকগুলি রচনা আজও অধ্যয়নের জন্য উপলব্ধ, যেমন "আর্যভটীয়"।

আর্যভটীয়

এটি আর্যভট্টের গাণিতিক গ্রন্থ, যা ব্যাপকভাবে অঙ্কগণিত, বীজগণিত এবং ত্রিকোণমিতিকে অন্তর্ভুক্ত করে। এতে অন্তর্ভুক্ত আছে অবিচ্ছিন্ন ভগ্নাংশ, দ্বিচর সমীকরণ, জ্যা সারণী এবং শক্তি শ্রেণীর যোগফল ইত্যাদি। আর্যভট্টের কার্যকলাপের বর্ণনা মূলত এই গ্রন্থ থেকেই পাওয়া যায়। "আর্যভটীয়" নামটি আর্যভট্ট নয়, পরবর্তী পণ্ডিতদের দ্বারা দেওয়া হয়েছিল।

আর্যভট্টের শিষ্য ভাস্কর প্রথম এই গ্রন্থটিকে "অশ্মক-তন্ত্র" (অশ্মক থেকে গ্রন্থ) বলে অভিহিত করেছিলেন। সাধারণত এটিকে "আর্য-শত-অষ্ট" (আর্যভট্টের ১০৮) বলা হয়, কারণ এতে ১০৮টি পংক্তি আছে। প্রতিটি পংক্তি প্রাচীন ও জটিল গাণিতিক নীতির বর্ণনা দিয়ে একটি অতি সংক্ষিপ্ত পাঠ্য। গ্রন্থটি ৪টি অধ্যায়ে বিভক্ত।

গীতিকাপাদ (১৩টি পংক্তি)

গণিতপাদ (৩৩টি পদ্য)

কালক্রিয়া পাদ (২৫টি পংক্তি)

গোলপাদ (৫০টি পংক্তি)

আর্যসিদ্ধান্ত

আর্যভট্টের এই গ্রন্থটি আজ পুরোপুরি উপলব্ধ নয়। তবে, এতে বিভিন্ন জ্যোতির্বিদ্যা যন্ত্রের ব্যবহারের বর্ণনা আছে, যেমন, সূক্তি, ছায়া যন্ত্র, সিলিন্ডারাকার কাঠি, ছাদ আকৃতির যন্ত্র, জল ঘড়ি, কোণ পরিমাপের যন্ত্র এবং অর্ধবৃত্তাকার/গোলাকার যন্ত্র। এই গ্রন্থে মধ্যরাত্রি নির্ণয়ের মধ্যে সূর্যের গণনার নীতিও আছে।

গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যায় আর্যভট্টের অবদান

আর্যভট্ট গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন, যার কিছু প্রধান অবদান হল:

গণিতবিদ হিসেবে অবদান:

১. π-এর মান নির্ণয়:

আর্যভট্ট π-এর মান নির্ণয় করেছিলেন, যা আর্যভটীয়ের গণিতপাদ ১০-এ বর্ণিত হয়েছে। π-এর মান নির্ণয়ের জন্য তিনি (৪ + ১০০) * ৮ + ৬২,০০০ / ২০,০০০ এই পদ্ধতিটি প্রস্তাব করেছিলেন, যা ৩.১৪১৬ ফলাফল দিয়েছিল।

২. শূন্যের আবিষ্কার:

আর্যভট্ট শূন্যের আবিষ্কার করেছিলেন, যা গণিতের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার হিসেবে বিবেচিত হয়। কারণ এর অভাবে গণনা অসম্ভব হত, যেহেতু যেকোনো সংখ্যাকে শূন্য দিয়ে গুণ করলে তা দশগুণ বৃদ্ধি পায়। তিনি স্থানীয় দশমিক পদ্ধতি সম্পর্কেও তথ্য দিয়েছিলেন।

৩. ত্রিকোণমিতি:

আর্যভট্ট আর্যভটীয়ের গণিতপাদ ৬-এ ত্রিভুজের ক্ষেত্রফল সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তিনি সাইন ফাংশনের ধারণাও ব্যাখ্যা করেছিলেন, যাকে তিনি "অর্ধ-জ্যা" (অর্ধ-তারা) বলেছিলেন এবং সরলতার জন্য এটিকে "জ্যা" বলা হত।

৪. বীজগণিত:

আর্যভট্ট আর্যভটীয়ে বর্গ ও ঘনের যোগফলের সঠিক ফলাফল ব্যাখ্যা করেছেন।

জ্যোতির্বিদ হিসেবে অবদান:

আর্যভট্টের জ্যোতির্বিদ্যা নীতিগুলিকে মোটামুটিভাবে আউদায়িক ব্যবস্থা বলা হয়। তাঁর রচনাগুলিতে পৃথিবীর কক্ষপথের উল্লেখ রয়েছে, যা ইঙ্গিত করে যে তিনি বিশ্বাস করতেন পৃথিবীর কক্ষপথ বৃত্তাকার নয় বরং উপবৃত্তাকার।

উদাহরণস্বরূপ, চলন্ত বাস বা ট্রেনে বসে থাকা ব্যক্তির কাছে গাছ ও ভবন বিপরীত দিকে যাচ্ছে বলে মনে হয়। একইভাবে, যদি পৃথিবী ঘোরে, তাহলে স্থির তারা বিপরীত দিকে ঘুরছে বলে মনে হবে। এটি পৃথিবী নিজের অক্ষের উপর ঘোরার কারণে সৃষ্ট ভ্রম। গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যায় আর্যভট্টের অবদান ভারতীয় বিজ্ঞানের উপর চিরস্থায়ী প্রভাব ফেলেছে এবং আজও অধ্যয়ন ও প্রশংসা পেয়ে চলেছে।

Leave a comment