ভারতীয় বুদ্ধিজীবীদের কথা বললেই যে মহান চিন্তাবিদ ও দার্শনিকদের নাম সবার আগে উঠে আসে, তার মধ্যে অমর্ত্য সেনের নাম অন্যতম। তিনি শুধুমাত্র একজন বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ নন, বরং মানবতার, ন্যায়বিচারের ও সামাজিক সমতায় প্রতিষ্ঠিত একজন অনুগত, যিনি তাঁর নীতি ও চিন্তাধারা দিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোচনার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। ১৯৯৮ সালে নোবেল পুরস্কার এবং ১৯৯৯ সালে ভারতরত্ন পুরস্কারে সম্মানিত অমর্ত্য সেনের জীবন ও কর্ম প্রেরণার উৎস।
প্রাথমিক জীবন ও শিক্ষা
অমর্ত্য সেনের জন্ম ১৯৩৩ সালের ৩ নভেম্বর তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের মানিকগঞ্জে (বর্তমান বাংলাদেশ) হয়। গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর নাম রাখেন 'অমর্ত্য' (অমর)। তাঁর পিতা আশুতোষ সেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন এবং মাতা অমিতা সেন, বিখ্যাত পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন সেনের কন্যা ছিলেন। সেন শান্তিনিকেতন, প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং পরে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রিনিটি কলেজ থেকে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেন।
তাঁর শৈশবের একটি দুঃখজনক অভিজ্ঞতা—কাদের মিয়া নামক একজন দরিদ্র মুসলিম ব্যক্তির সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় মৃত্যু—তাঁর মনে গভীর মানবিক অনুভূতি ও আর্থিক বৈষম্যের প্রতি উদ্বেগ সৃষ্টি করে। এই ঘটনা তাঁর সামাজিক ন্যায় সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গীর ভিত্তি স্থাপন করে।
শিক্ষাদান ও বিশ্বব্যাপী অবদান
অমর্ত্য সেন তাঁর কর্মজীবনের সূচনা করেন জাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে। পরবর্তীতে তিনি দিল্লি স্কুল অফ ইকোনমিক্স, অক্সফোর্ড, কেম্ব্রিজ, হার্ভার্ড এবং এমআইটির মতো বিশ্ববিখ্যাত প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপক ও গবেষক হিসেবে কাজ করেন।
দিল্লি স্কুল অফ ইকোনমিক্সে তিনি মনমোহন সিং, কে.এন. রাজ এবং জগদীশ ভাগবতী প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে কাজ করেছেন। ১৯৮৭ সাল থেকে তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে থমাস ডব্লিউ. লাম্ব ইউনিভার্সিটি প্রফেসর পদে কর্মরত আছেন।
চিন্তাধারা ও নীতি
অমর্ত্য সেন অর্থনীতিকে কেবল তথ্যের হিসাব নিকাশ মনে করেননি, বরং তিনি তা মানব উন্নয়ন এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের সাথে যুক্ত করেছেন। তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হল ‘ক্ষমতা দৃষ্টিভঙ্গি’ (Capability Approach), যেখানে তিনি বলেছেন যে, সত্যিকারের উন্নয়ন হল সেই উন্নয়ন যা মানুষকে তাদের জীবনকে উন্নত করার ক্ষমতা প্রদান করে।
তাঁর ‘পভারটি অ্যান্ড ফ্যামিন’ (১৯৮১) বইতে তিনি দেখিয়েছেন যে, দুর্ভিক্ষ কেবল খাদ্যের অভাবের কারণে হয় না, বরং রাজনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যের কারণেও হয়। তিনি ১৯৪৩ সালের বাংলার দুর্ভিক্ষের উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন যে, যখন দরিদ্র শ্রমিকদের মজুরি বাড়েনি, তখন তারা দামী খাদ্য কিনতে পারেনি এবং ক্ষুধার কারণে মারা গেছে।
মানবাধিকার ও সমতার চিন্তাধারা
১৯৭৯ সালে তাঁর ‘Whose Equality?’ লেখা বিশ্বব্যাপী নীতিনির্ধারকদের ভাবতে বাধ্য করেছে যে, সমতার অর্থ শুধুমাত্র সম্পদের বন্টন নয়, বরং সুযোগের সমতাও। সেন মনে করেন যে, যতক্ষণ পর্যন্ত সাধারণ নাগরিক ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার ব্যবস্থা, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য সুবিধা পাবে না, ততক্ষণ শুধুমাত্র ‘অধিকার’ দেওয়া যথেষ্ট নয়।
১৯৯০ সালে তাঁর ‘More than 100 million women are missing’ লেখায় এশীয় দেশে নারীদের সাথে হওয়া বৈষম্যকে তিনি উন্মোচন করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে, লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য মৃত্যুহারকেও প্রভাবিত করে।
স্বাধীনতার নতুন দৃষ্টিভঙ্গি
১৯৯৯ সালে তাঁর ‘Development as Freedom’ বই উন্নয়নের ধারণাটিকেই বদলে দিয়েছে। তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন যে, সত্যিকারের উন্নয়ন হল সেই উন্নয়ন যা মানুষকে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, স্বচ্ছতা ও নিরাপত্তার স্বাধীনতা প্রদান করে। সেনের মতে, এই পাঁচটি স্বাধীনতা পরস্পরের সাথে জড়িত এবং একটি ছাড়া অন্যটি অসম্পূর্ণ।
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ও সংস্কৃতি
ভারতের প্রাচীন জ্ঞান ঐতিহ্যকে আধুনিক রূপ দেওয়ার লক্ষ্যে অমর্ত্য সেন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় পুনঃনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি এর প্রথম চ্যান্সেলর হন এবং বিশ্বজুড়ে পণ্ডিতদের এই প্রকল্পের সাথে যুক্ত করেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়কে শুধুমাত্র শিক্ষার কেন্দ্রই নয়, বরং বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি অর্জনেও অবদান রাখেন। তবে, পরে কিছু রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও মতবিরোধের কারণে তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে চ্যান্সেলর হওয়া থেকে বিরত থাকেন।
ন্যায়বিচারের উপর চিন্তাধারা
২০০৯ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘The Idea of Justice’ বইতে তিনি জন রোলসের ন্যায়বিচারের ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন এবং একটি এমন মডেল উপস্থাপন করেছেন যেখানে ন্যায়বিচার মানুষের বাস্তব অবস্থা এবং তাদের ক্ষমতার উপর ভিত্তি করে মূল্যায়ন করা হয়। তাঁর মতে, ন্যায়বিচার কেবল আদর্শ অবস্থার কথা নয়, বরং বাস্তবে মানুষ কী পাচ্ছে তার উপর ভিত্তি করে হওয়া উচিত।
ব্যক্তিগত জীবন ও মূল্যবোধ
অমর্ত্য সেনের ব্যক্তিগত জীবনও ততটাই অনুপ্রেরণাদায়ক। তিনি তিনবার বিবাহ করেছেন এবং তাঁর চারটি সন্তান রয়েছে, যারা সাংবাদিকতা, অভিনয়, সঙ্গীত ও সাহিত্যের সাথে জড়িত। তিনি কোন ধর্মীয় পরম্পরাকে অনুসরণ করেন না, তবে মানবিক নীতি ও সামাজিক মূল্যবোধে তাঁর গভীর বিশ্বাস রয়েছে।
অমর্ত্য সেন কেবল একজন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ নন, বরং একজন এমন মহান ব্যক্তিত্ব, যিনি মানবতার, ন্যায়বিচারের ও উন্নয়নের প্রতি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেছেন। তিনি প্রমাণ করেছেন যে, সত্যিকারের অর্থনীতি হল সেই অর্থনীতি যা মানুষকে মর্যাদা, সুযোগ এবং অধিকার প্রদান করে। তাঁর জীবন ও চিন্তাধারা আজও বিশ্বজুড়ে নীতি ও চিন্তাধারাকে দিক নির্দেশনা প্রদান করে।