লল বহাদুর শাস্ত্রী ভারতের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, যাঁর সরলতা, সততা এবং দৃঢ় নেতৃত্ব দেশকে কঠিন সময়ে পথ দেখিয়েছিল। তাঁর জীবন একজন সাধারণ ভারতীয়ের আশা ও সংগ্রামের প্রতীক। ‘জয় জওয়ান, জয় কিসান’ এই ধরণের নারার জনক শাস্ত্রীজী তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনে বড় বড় কাজ করে গেছেন, যা আজও আমাদের অনুপ্রাণিত করে।
জন্ম ও বাল্যকাল
লল বহাদুর শাস্ত্রীর জন্ম ২ অক্টোবর ১৯০৪ সালে উত্তরপ্রদেশের মুগলসরায় (বর্তমানে পণ্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায় নগর) -এ হয়েছিল। তাঁর পিতা শরৎ প্রসাদ শ্রীবাস্তব একটা স্কুলে শিক্ষক ছিলেন এবং পরে রাজস্ব বিভাগে ক্লার্ক হয়েছিলেন। তাঁর মাতা রামদুলারী দেবী ছিলেন একজন বুদ্ধিমান ও শিক্ষিত মহিলা। শাস্ত্রীজী যখন মাত্র দেড় বছর বয়সী, তখন প্লেগ মহামারীর সময় তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। এর পর তাঁর মাতা তাঁকে নিয়ে নানীবাড়ি চলে যান, যেখানে তাঁর বাল্যকাল কেটেছে। বাল্যকালেই পিতাকে হারানো তাঁর জন্য অত্যন্ত বড় দুঃখ ছিল, কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি।
তাঁর বাল্যকাল ছিল অর্থনৈতিক দুর্দশা ও সমস্যাপূর্ণ, কিন্তু এর পরেও শাস্ত্রীজী পড়াশোনায় অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। তিনি সর্বদা পরিশ্রম ও সততার উপর বিশ্বাস রাখতেন। পরে যখন তিনি বড় হন, তখন তিনি ‘শ্রীবাস্তব’ উপাধি ত্যাগ করেন। তিনি মনে করতেন, জাত-পাত সমাজকে ভেঙে দেয়, তাই তিনি নিজের জাতিগত পরিচয় ত্যাগ করে সমাজে সমতা ও ঐক্যের বার্তা দিয়েছিলেন। তাঁর এই পদক্ষেপ তখন অত্যন্ত সাহসী ও অনুপ্রেরণাদায়ক মনে করা হয়েছিল।
শিক্ষা ও স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগদান
লল বহাদুর শাস্ত্রীর পড়াশোনা হরিশচন্দ্র হাই স্কুল থেকে শুরু হয়েছিল। তিনি পড়াশোনায় ভালো ছিলেন, কিন্তু যখন মহাত্মা গান্ধী ইংরেজদের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেন, তখন তিনি স্কুল ছেড়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৬ বছর। গান্ধীজীর আদর্শ ও চিন্তাধারা তাঁকে অত্যন্ত প্রভাবিত করেছিল। পাশাপাশি স্বামী বিবেকানন্দ ও এনি বেসেন্ট-এর মতো মহান ব্যক্তিদের চিন্তাধারাও তাঁর জীবনে দিকনির্দেশনা দিয়েছিল। শাস্ত্রীজীর ছোটবেলা থেকেই দেশপ্রেমের আবেগ ছিল এবং তিনি সর্বদা সমাজের জন্য কিছু করার চিন্তা করতেন।
পরে তিনি বনারস (বর্তমানে বারাণসী) -এ অবস্থিত কাশী বিদ্যাপীঠ থেকে পড়াশোনা অব্যাহত রাখেন এবং দর্শন ও নীতিশাস্ত্র বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। পড়াশোনা শেষ করে তিনি ‘শাস্ত্রী’ উপাধি পান, যা তিনি তাঁর নামের সাথে যুক্ত করেন। একই সময়ে তিনি ‘সর্বেন্টস অফ দ্য পিপল সোসাইটি’-র সাথে যুক্ত হন। এই সংগঠনটি সমাজসেবার কাজ করে। এখানে তিনি হরিজনদের (দলিতদের) সেবা করেছেন, তাদের উন্নয়নের জন্য কাজ করেছেন এবং সামাজিক সমতার প্রসার ঘটিয়েছেন। শাস্ত্রীজী মনে করতেন, যতক্ষণ না সমাজের সবচেয়ে দুর্বল শ্রেণী ন্যায় ও সম্মান পাবে, ততক্ষণ দেশ উন্নতি করতে পারবে না।
স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা
লল বহাদুর শাস্ত্রীজী খুব কম বয়স থেকেই স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ শুরু করেছিলেন। ১৯২০-এর দশক থেকে ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত তিনি ক্রমাগত স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িত ছিলেন। ১৯৩০ সালে যখন মহাত্মা গান্ধী নুন আইনের বিরুদ্ধে দাঁড়ি মার্চ করেছিলেন, তখন শাস্ত্রীজী তাতে অংশগ্রহণ করেন এবং প্রথমবারের মতো জেলে যান। এর পরেও তিনি প্রতিটি আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি কখনো পিছনে সরে যাননি এবং প্রতিবার ইংরেজদের বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছেন।
১৯৪০ সালে যখন গান্ধীজী ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহ শুরু করেন, তখনও শাস্ত্রীজী খোলাখুলিভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং জেলে যান। ১৯৪২ সালে ‘ভারত ছাড়ো আন্দোলন’ শুরু হলেও তিনি সক্রিয়ভাবে আন্দোলনের অংশ হিসেবে জেলে যান। মোট মিলিয়ে শাস্ত্রীজী সাতবার জেলে গেছেন এবং প্রায় নয় বছর জেলে কাটিয়েছেন। জেলে থাকাকালীনও তিনি পড়াশোনা এবং সমাজের কল্যাণের কথা ভাবা বন্ধ করেননি। তাঁর ত্যাগ ও সাহস তাঁকে একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক ও নেতা করে তুলেছে।
স্বাধীনতা পরবর্তী রাজনীতি
১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হলে লল বহাদুর শাস্ত্রীকে উত্তরপ্রদেশ সরকারের সংসদীয় সচিব করা হয়। এর পরে তিনি পরিবহন মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। এই সময় তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন। তিনি এমন প্রথম মন্ত্রী হন যিনি বাসে মহিলা কন্ডাক্টর নিয়োগের অনুমতি দেন। সে সময় এটি একটি অত্যন্ত বড় এবং সাহসী পদক্ষেপ ছিল, যার ফলে মহিলারা নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়েছিল।
এরপর শাস্ত্রীজীকে উত্তরপ্রদেশের গৃহমন্ত্রী করা হয়। সে সময় রাজ্যের অনেক জায়গায় দাঙ্গা হচ্ছিল, কিন্তু তিনি শান্তি বজায় রাখার জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন। তিনি সততা ও সরলতার সাথে কাজ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। তাঁর পরিষ্কার ছবি এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতার কারণে মানুষ তাঁকে অত্যন্ত পছন্দ করত।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অবদান
১৯৬৪ সালে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর মৃত্যুর পর লল বহাদুর শাস্ত্রী ভারতের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী হন। সে সময় দেশ অনেক সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল—খাদ্যের তীব্র ঘাটতি, অর্থনৈতিক সমস্যা এবং প্রতিবেশী দেশগুলির সাথে উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশ। এসবের মাঝে শাস্ত্রীজী দায়িত্বের সাথে কাজ সামলে দেশকে শক্তি দিয়েছিলেন। তিনি সাধারণ মানুষের চাহিদা বুঝে কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনে বিশেষ গুরুত্ব দিতে শুরু করেন।
শাস্ত্রীজী দুগ্ধ উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য অমুল ডেয়ারী ও জাতীয় ডেয়ারী উন্নয়ন বোর্ডকে সমর্থন দিয়েছিলেন, যার ফলে ‘শ্বেত ক্রান্তি’র সূচনা হয়। পাশাপাশি, কৃষকদের উৎসাহিত করে ‘সবুজ ক্রান্তি’কেও বিকাশে সাহায্য করেছেন, যার ফলে পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশে খাদ্যশস্য উৎপাদন অনেক বেড়ে গেছে।
১৯৬৫ সালে যখন পাকিস্তান ভারতের উপর আক্রমণ করে, তখন শাস্ত্রীজী দেশের সাহসী নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি ‘জয় জওয়ান, জয় কিসান’ –এর নারা দিয়েছিলেন, যা আজও দেশপ্রেম ও আত্মনির্ভরতার প্রতীক।
তাশকেন্দ চুক্তি ও রহস্যময় মৃত্যু
১০ জানুয়ারী ১৯৬৬ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের অবসান ঘটানোর জন্য তাশকেন্দে (যা বর্তমানে উজবেকিস্তানে অবস্থিত) একটি শান্তি চুক্তি হয়। এই চুক্তিকে ‘তাশকেন্দ চুক্তি’ বলা হয়। লল বহাদুর শাস্ত্রী ও পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান এতে স্বাক্ষর করেন। এর উদ্দেশ্য ছিল দুই দেশের মধ্যে শান্তি ও বন্ধুত্বের বিকাশ।
কিন্তু এই ঐতিহাসিক চুক্তির ঠিক একদিন পর, ১১ জানুয়ারী ১৯৬৬ সালে শাস্ত্রীজীর হঠাৎ মৃত্যু হয়। সরকার তা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বলে জানায়, কিন্তু তাঁর মৃত্যু নিয়ে আজও অনেক প্রশ্ন উঠে। কেউ কেউ এটাকে সন্দেহজনক মনে করেন এবং মনে করেন যে সত্যিটা পুরোপুরি সামনে আসেনি। তাঁর মৃত্যু আজও এক রহস্য হয়ে রয়েছে।
লল বহাদুর শাস্ত্রী একজন এমন নেতা ছিলেন, যিনি কেবল তাঁর কাজে নয়, তাঁর আচরণেও মানুষের হৃদয়ে বাস করেছেন। তাঁর জীবন আমাদের শেখায় যে সরলতা, সততা ও সংকল্পের সাথে যেকোন ব্যক্তি দেশকে নতুন দিক দিতে পারে। আজ যখন দেশ নেতৃত্বের নতুন পথ খুঁজছে, তখন শাস্ত্রীজীর মত আদর্শের প্রয়োজন আরও বেড়ে যায়।