জ্যৈষ্ঠ মাসের নবতাপ: সূর্যপূজা ও রক্ষার উপায়

🎧 Listen in Audio
0:00

জ্যৈষ্ঠ মাসে প্রতি বছর একটি বিশেষ সময় আসে যাকে হিন্দু ধর্মে নবতাপ (Nautapa) বলা হয়। এই সময় সূর্যের রশ্মির সরাসরি পৃথিবীতে পড়ার কারণে অত্যন্ত উষ্ণ ও তপ্ত বলে মনে করা হয়। ২০২৫ সালে নবতাপ ২৫ মে থেকে শুরু হয়ে ৮ জুন পর্যন্ত থাকবে। এই সময় সূর্য দেবতার পূজা এবং বিশেষ করে অর্ঘ্য অর্পণ করা অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করা হয়।

এটি করার ফলে সূর্য দেবতা প্রসন্ন হন এবং জীবনে যশ, তেজ ও আরোগ্যের প্রাপ্তি হয়। আসুন বিস্তারিতভাবে বুঝে নেই নবতাপের এই বিশেষ সময়ের গুরুত্ব এবং সূর্য দেবতাকে অর্ঘ্য দেওয়ার পদ্ধতি যাতে আপনি নবতাপের কুপ্রভাব থেকে বাঁচতে পারেন।

নবতাপের জ্যোতিষীয় ও ধর্মীয় গুরুত্ব

নবতাপ শব্দটি সংস্কৃতের দুটি শব্দ ‘নব’ (নয় দিন) এবং ‘তাপ’ (তপ, উষ্ণতা) থেকে মিলিত। এই সময় জ্যৈষ্ঠ মাসে পড়ে যখন সূর্য তার সরাসরি রশ্মি পৃথিবীতে এমনভাবে ফেলে যে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। পুরাণ ও ধর্মগ্রন্থে একে একটি কঠিন ও অশুভ সময় বলে মনে করা হয় কারণ এই সময় সূর্যের তাপে শুধু পরিবেশই নয়, মানব স্বাস্থ্য, মানসিকতা ও পরিবেশের উপরও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

হিন্দু পঞ্জিকা ও জ্যোতিষশাস্ত্র অনুসারে, নবতাপের সময় সূর্য দেবতার পূজা করা অত্যন্ত শুভ। এই সময় সূর্যের আরাধনার ফলে শুধু শারীরিক কষ্ট থেকেই মুক্তি পাওয়া যায় না, বরং মানসিক শান্তি ও আধ্যাত্মিক লাভও হয়। বলা হয়, যে ব্যক্তি এই সময় সূর্যকে অর্ঘ্য অর্পণ করে, সে নবতাপের কুপ্রভাব থেকে বাঁচে এবং জীবনে উন্নতি করে।

সূর্য দেবতাকে অর্ঘ্য দেওয়ার গুরুত্ব

অর্ঘ্যের অর্থ হল জল অর্পণ করা। সূর্য দেবতাকে জল অর্পণ করার প্রথা প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে এবং এর ধর্মীয় গুরুত্ব অত্যন্ত গভীর। নবতাপের সময় জলে রোলী, অক্ষত (চাল) এবং জবা ফুল দিয়ে সূর্যকে জল অর্পণ করলে মনে করা হয় যে সূর্যের শক্তি ও আশীর্বাদ সরাসরি আপনার জীবনে প্রবেশ করে।

সূর্য দেবতার পূজায় অর্ঘ্য দেওয়া অত্যন্ত জরুরি কারণ সূর্য জীবনের ভিত্তি, তিনি আলো, শক্তি ও স্বাস্থ্যের উৎস। অর্ঘ্য দেওয়ার ফলে সূর্য দেবতা প্রসন্ন হন এবং তাঁর ভক্তদের রোগ, বিঘ্ন ও সংকট থেকে মুক্তি দান করেন। এই সাথে এটি শুভ সময় জীবনে সাফল্য, সমৃদ্ধি ও খ্যাতি আনার মাধ্যম হয়ে ওঠে।

নবতাপের সময় সূর্য দেবতাকে অর্ঘ্য দেওয়ার সহজ পদ্ধতি

যদি আপনি নবতাপের সময় সূর্য দেবতাকে সঠিক পদ্ধতিতে অর্ঘ্য দিতে চান, তাহলে নিচে বর্ণিত সহজ কিন্তু কার্যকর পদ্ধতিটি অনুসরণ করুন:

  • সকালে তাড়াতাড়ি উঠুন এবং স্নান করুন — সূর্য দেবতার পূজা সূর্যোদয়ের ठीक পরেই করা উত্তম বলে মনে করা হয়।
  • লাল রঙের বস্ত্র পরুন — লাল রঙ সূর্য দেবতার প্রতিনিধিত্ব করে এবং এটি শক্তির প্রতীক বলে মনে করা হয়।
  • একটি তামার কলসে পরিষ্কার জল পূর্ণ করুন — তামা একটি পবিত্র ধাতু যা শক্তিকে ইতিবাচক করে তোলে।
  • জলে কিছু রোলী, অক্ষত এবং লাল জবা ফুল দিন — এটি অর্ঘ্যকে আরও পবিত্র ও কার্যকর করে তোলে।
  • পূর্ব দিকে মুখ করে দুই হাতে কলসটি ধরুন — পূর্ব দিক সূর্যের প্রতীক, তাই পূজা এই দিকেই করতে হবে।
  • ধীরে ধীরে জলের ধারা সূর্য দেবতার দিকে অর্পণ করুন — খেয়াল রাখুন জল সরাসরি মাটিতে না পড়ে কোনো পাত্রে বা গাছে পড়ে।
  • পরবর্তীতে সূর্য নমস্কার করুন এবং বৈদিক মন্ত্র জপ করুন — সূর্য নমস্কারে শরীরে শক্তি ও শান্তি আসে।
  • পূজার শেষে আরতি করুন — আরতির মাধ্যমে সূর্য দেবতার পূজা সম্পন্ন হয়।
  • পূজার সময় পবিত্রতার বিশেষ খেয়াল রাখুন — চপ্পল বা চামড়ার জিনিস পূজার স্থানে আনবেন না।

নবতাপের সময় জপ করুন এই সূর্য মন্ত্র

পূজার সময় কিছু বিশেষ মন্ত্র জপ করা শুভ বলে মনে করা হয়। এই মন্ত্রগুলি উচ্চারণ করার সময় মনকে একাগ্র রাখুন যাতে ইতিবাচক শক্তি উৎপন্ন হয়:

  • সহস্ররশ্মি: শতধা বর্তমান: পুর: প্রজানামুদত্যেশ সূর্য:।
    (এই মন্ত্রের অর্থ, সূর্য হাজার হাজার রশ্মির সাথে প্রাচীন দেবতা যিনি জীবজন্তুতে প্রজ্বলিত হন।)
  • বিশ্বরূপং ঘৃণিনং জাতবেদসং হিরণ্ময়ং জ্যোতিরূপং তপন্তম্।
    (এটি সূর্যের বর্ণনা করে যিনি বিশ্বরূপ, প্রকাশমান, তপস্বী ও সবার জ্ঞাতা।)
  • উঁ নমো ভগবতে শ্রীসূর্যায়াদিত্যাক্ষিতীজসে হো বাহিনী বাহিনী স্বাহেতি।
    (এই মন্ত্র সূর্য দেবতার পূজায় শক্তি ও শক্তির সংযোগ করে।)

গায়ত্রী মন্ত্র

  • ॐ ভূর্ভুবঃ স্বঃ তৎসবিতুর্বরেণ্যং ভর্গো দেবস্য ধীমহি ধিয়ো যো নঃ প্রচোদয়াত্।
    (এই মন্ত্র জ্ঞান ও আধ্যাত্মিক প্রবোধনের জন্য ব্যবহৃত হয়।)

নবতাপের কুপ্রভাব ও তা থেকে রক্ষা

নবতাপের সময় সূর্যের তীব্র ও সরাসরি পড়া রশ্মি শুধু আবহাওয়াকে অত্যন্ত উষ্ণ করে তোলে না, বরং শরীরের উপরও বিরূপ প্রভাব ফেলে। এই সময় তাপের কারণে অনেক সময় শারীরিক দুর্বলতা, পাচনতন্ত্রের সমস্যা, ত্বকের রোগ, মানসিক চাপ ইত্যাদির সমস্যা হতে পারে। কিন্তু যদি এই সময় সূর্য দেবতার পূজা বিধিপূর্ণ ও নিয়মিতভাবে করা হয়, তাহলে এই কুপ্রভাব দূর হয়ে যায়।

অর্ঘ্য অর্পণ করার ফলে সূর্য দেবতা প্রসন্ন হন এবং তাঁর ভক্তদের সুস্থ, সবল ও সফল করে তোলেন। এই জন্যই নবতাপে সূর্যের আরাধনাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ আধ্যাত্মিক ও চিকিৎসাগত পন্থা বলে মনে করা হয়।

নবতাপ ২০২৫ এর সময়কাল ২৫ মে থেকে শুরু হয়ে ৮ জুন পর্যন্ত, যা জ্যৈষ্ঠ মাসে পড়ে এবং সূর্যের সরাসরি রশ্মির কারণে তাপমাত্রা চরমে থাকে। এই কঠিন সময়ে সূর্য দেবতাকে অর্ঘ্য অর্পণ করা অত্যন্ত জরুরি যাতে কুপ্রভাব থেকে রক্ষা পাওয়া যায় এবং জীবনে স্বাস্থ্য, যশ ও সমৃদ্ধি বজায় থাকে।

Leave a comment