রজোনিবৃত্তির পর মহিলাদের হৃদরোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি: সচেতনতা ও প্রতিরোধ

🎧 Listen in Audio
0:00

এক সময় হৃদরোগকে পুরুষদের সমস্যা হিসেবে ধরা হতো, কিন্তু এখন সেই ধারণা বদলাচ্ছে। গত কয়েক বছরে হার্ট অ্যাটাক ও কার্ডিয়াক ডিজিজের ঘটনায় মহিলাদের অংশগ্রহণ ক্রমশ বাড়ছে। বিশেষ করে ৪৫ থেকে ৫৫ বছর বয়সের মধ্যে, যখন মহিলারা রজোনিবৃত্তির (Menopause) সময়কাল অতিক্রম করেন, তখন হৃৎপিণ্ডের সাথে সম্পর্কিত সমস্যা বেশি দেখা যায়।

হরমোনাল পরিবর্তন বড় কারণ

গুড়গাঁওয়ের ফোর্টিস মেমোরিয়াল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ উদগীথ ধীরের মতে, ৪৫ বছর বয়সের পর মহিলাদের দেহে একটি বড় হরমোনাল পরিবর্তন শুরু হয়, যাকে আমরা মেনোপজ বা রজোনিবৃত্তি বলি। এই সময় এস্ট্রোজেন নামক হরমোনের মাত্রা দ্রুত কমে যায়। এই হরমোনই মহিলাদের হৃদরোগ থেকে প্রাকৃতিকভাবে সুরক্ষা দেয়।

এস্ট্রোজেন বিভিন্নভাবে হৃৎপিণ্ডকে সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করে। এটি রক্তনালীগুলিকে নমনীয় রাখে, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে এবং শরীরে প্রদাহ কমায়। এছাড়াও, এটি শরীরে খারাপ কোলেস্টেরল (LDL) কমিয়ে ভালো কোলেস্টেরল (HDL) বাড়ায়। যখন এই হরমোন কমে যায়, তখন শরীরে অনেক নেতিবাচক পরিবর্তন শুরু হয় যা সরাসরি হৃৎপিণ্ডের স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলে।

রজোনিবৃত্তির পর হৃৎপিণ্ডের উপর ঝুঁকি বেড়ে যায়

এস্ট্রোজেনের মাত্রা কমে গেলে মহিলাদের ধমনী শক্ত হতে শুরু করে। এর ফলে এথেরোস্ক্লেরোসিস (ধমনীতে প্লাক জমে যাওয়া) প্রক্রিয়া দ্রুত হয়। এই প্লাক পরবর্তীতে হার্ট অ্যাটাকের কারণ হতে পারে। এছাড়াও, রক্তচাপ বৃদ্ধি, ওজন দ্রুত বৃদ্ধি, বিশেষ করে পেটের চারপাশে চর্বি জমে যাওয়া – এগুলি সবই বিপদের ইঙ্গিত।

ইন্দ্রপ্রস্থ অ্যাপোলো হাসপাতালের সিনিয়র গাইনোকোলজিস্ট ডাঃ নীলম সুরী জানান, রজোনিবৃত্তির সময় শরীরে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সও বেড়ে যায়, যার ফলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে। পাশাপাশি, চাপ, ঘুমের ঘাটতি, चिड़चिड़ापन এবং উদ্বেগের মতো সমস্যা হার্টের স্বাস্থ্যকে আরও বেশি ক্ষতি করে।

মহিলাদের হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ প্রায়শই আলাদা হয়

পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ প্রায়শই আলাদা হয় এবং অনেক সময় এগুলিকে সাধারণ ক্লান্তি বা অম্লতা বলে ভুল ধারণা করা হয়। তাই সময়মতো চিহ্নিত না হওয়ার ফলে চিকিৎসায় দেরি হয়। মহিলাদের হার্ট অ্যাটাকের সাধারণ লক্ষণগুলি হতে পারে:

  • অতিরিক্ত ক্লান্তি বা দুর্বলতা
  • শ্বাসকষ্ট
  • বুকে চাপ বা ভারীভাব
  • মনোমুখীতা বা বমি বমি ভাব
  • ঠোঁট, ঘাড়, পিঠ বা কাঁধে ব্যথা
  • মাথা ঘোরা বা অজ্ঞান হওয়া

যদি কোনও মহিলার উপরোক্ত যেকোনো লক্ষণ বারবার অনুভূত হয়, তাহলে অবিলম্বে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

৪৫ থেকে ৫৫ বছর বয়স কেন বেশি ঝুঁকিপূর্ণ?

৪৫ থেকে ৫৫ বছর বয়স মহিলাদের জন্য দ্বিগুণ চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসে – একদিকে শরীর হরমোনাল পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়, অন্যদিকে মেটাবলিজম ধীর হয়ে যায়। এই বয়সে রক্তচাপ, রক্তের শর্করা এবং কোলেস্টেরলের মাত্রা দ্রুত असंतुलित হতে পারে। इसके সাথে সাথে যদি মহিলা আগে থেকেই ধূমপান করেন, স্থূলতায় ভোগেন, বা পরিবারে হৃদরোগের ইতিহাস থাকে, তাহলে ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়।

কিভাবে এই বয়সে হৃৎপিণ্ডকে সুস্থ রাখবেন?

চিকিৎসকদের মতে, ৪০ বছর বয়সের পর মহিলাদের হৃৎপিণ্ডের স্বাস্থ্য সম্পর্কে আগের চেয়ে বেশি সতর্ক হওয়া উচিত। কিছু প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে হৃদরোগ থেকে অনেকটা রক্ষা পাওয়া যায়।

১. নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান

বছরে একবার রক্তচাপ, কোলেস্টেরল এবং রক্তের শর্করার পরীক্ষা অবশ্যই করান।

২. খাদ্যতালিকায় পরিবর্তন আনুন

ফল, সবুজ শাকসবজি, ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড এবং ফাইবার সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ করুন। ট্রান্স ফ্যাট, প্রসেস করা খাবার এবং অতিরিক্ত লবণ থেকে বিরত থাকুন।

৩. প্রতিদিন ব্যায়াম করুন

প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটা, যোগা বা হালকা কার্ডিও ব্যায়াম অবশ্যই করুন।

৪. চাপ কম করুন

ধ্যান, সঙ্গীত, ভালো ঘুম এবং শখের সাথে জড়িত হয়ে চাপ কম করা যায়।

৫. ধূমপান এবং মদ্যপান থেকে দূরে থাকুন

ধূমপান এবং অতিরিক্ত মদ্যপান হার্টের স্বাস্থ্য দ্রুত নষ্ট করে।

মহিলাদের কেন হার্ট হেলথ সম্পর্কে জানা জরুরি?

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, মহিলাদের অকাল মৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারণ হল কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ। যেহেতু মহিলাদের লক্ষণ অনেক সময় অস্পষ্ট হয়, তাই সচেতনতা হল সবচেয়ে বড় অস্ত্র। আপনার শরীরের পরিবর্তনগুলিকে উপেক্ষা করবেন না এবং সময়মতো ডাক্তারের পরামর্শ নিন।

মহিলারা গৃহ ও সমাজের মেরুদণ্ড, এবং তাদের নিজের স্বাস্থ্যের যত্ন তেমনি গুরুত্বের সাথে নেওয়া উচিত যেমন তারা পরিবারের যত্ন নেয়। ৪৫ বছর বয়সের পর হৃৎপিণ্ডকে সুরক্ষিত রাখার জন্য জীবনযাত্রায় কিছুটা পরিবর্তন এবং সময়মতো স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি। মনে রাখবেন, একটি সুস্থ হৃৎপিণ্ডই একটি সুস্থ জীবনের চাবিকাঠি।

Leave a comment