বর্তমানের ব্যস্ত ও অস্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রায় দাঁতের সমস্যা এখন খুবই সাধারণ হয়ে উঠেছে। খারাপ খাদ্যাভ্যাস, অতিরিক্ত মিষ্টি খাওয়া, নিরন্তর কিছু না কিছু খেতে থাকা এবং দাঁতের যথাযথ পরিষ্কার না করা – এগুলি সবই দাঁতের ক্ষয় বা ক্যারিয়েসের কারণ হতে পারে।
ক্যারিয়েস শুধুমাত্র একটি ছোট্ট গর্ত নয়, বরং এটি ধীরে ধীরে দাঁতের বাইরের স্তরকে ক্ষয় করে এবং যদি সময়মতো নজর না দেওয়া হয় তাহলে এটি স্নায়ুতে পৌঁছে প্রচুর ব্যথা ও অসুবিধা সৃষ্টি করতে পারে।
দাঁতের ক্ষয় কীভাবে হয়?
যখন আমরা মিষ্টি জিনিস যেমন টফি, চকলেট বা চিটচিটে খাবার বারবার খাই এবং দাঁত পরিষ্কার করি না, তখন এগুলি আমাদের দাঁতে লেগে থাকে। এই লেগে থাকা খাবারের কণাগুলি ধীরে ধীরে ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি ঘটায়। এই ব্যাকটেরিয়াগুলি দাঁতে জমে অ্যাসিড তৈরি করে, যা দাঁতের উপরের স্তর বা ইনামেলকে ধীরে ধীরে ক্ষতি করতে শুরু করে।
সময়ের সাথে সাথে ইনামেল দুর্বল হয়ে যায় এবং তাতে ছোট ছোট গর্ত তৈরি হতে শুরু করে, যাকে আমরা ক্যারিয়েস বা দাঁতের ক্ষয় বলি। যদি সময়মতো ব্রাশ না করা হয় এবং এ বিষয়ে নজর না দেওয়া হয়, তাহলে এই ক্ষয় আরও বাড়তে পারে এবং দাঁতের ভেতরে পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে, যার ফলে ব্যথা, প্রদাহ এবং সংক্রমণ হতে পারে।
ক্যারিয়েসের প্রাথমিক লক্ষণ
প্রাথমিক অবস্থায় ক্যারিয়েসের অনুভূতি হয় না কারণ তখন ব্যথা হয় না। কিন্তু ক্ষয় বৃদ্ধির সাথে সাথে কিছু লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করে:
- ঠান্ডা বা গরম খাবার খাওয়ার সময় দাঁতে কাঁটা
- মিষ্টি খাওয়ার সময় ব্যথা
- দাঁতে গর্ত অনুভব করা
- মুখ থেকে দুর্গন্ধ বের হওয়া
- চিবানোর সময় দাঁতে ব্যথা
যদি এই লক্ষণগুলি উপেক্ষা করা হয় তাহলে এই সমস্যা গুরুতর হতে পারে এবং রুট ক্যানাল বা দাঁত উঠিয়ে ফেলার প্রয়োজন হতে পারে।
দাঁতের ক্ষয় কীভাবে রোধ করা যায়?
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ: দিনে দুবার ব্রাশ করা অভ্যাস করুন। বিশেষ করে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে ব্রাশ করা অবশ্যই করুন যাতে দিনভর জমে থাকা ব্যাকটেরিয়াগুলি সরিয়ে ফেলা যায়। ফ্লোরাইডযুক্ত টুথপেস্ট ব্যবহার করুন কারণ এটি ইনামেলকে শক্তিশালী করে এবং ক্ষয় রোধ করে।
খাদ্যের উপর নজর রাখুন: মিষ্টি, কোল্ড ড্রিংকস, চকলেট, কেক-পেস্ট্রি এবং চিটচিটে খাবার যতটা সম্ভব কম খান। এগুলি দাঁতে ব্যাকটেরিয়ার দ্রুত বৃদ্ধি ঘটায়। ফল, সবজি, দুধ, দই, পনির এবং ডাল ইত্যাদি স্বাস্থ্যকর খাবার খাদ্যতালিকায় সামিল করুন।
বারবার খাওয়া থেকে বিরত থাকুন: কিছুক্ষণ পর পর কিছু না কিছু খেলে দাঁতে অ্যাসিড তৈরি হয় এবং ক্যারিয়েসের ঝুঁকি বাড়ে। দিনে তিনটি প্রধান খাবার এবং দুটি স্বাস্থ্যকর স্ন্যাকস খাওয়ার প্যাটার্ন অনুসরণ করুন।
প্রতি ৬ মাস অন্তর দাঁতের চেকআপ করান: দাঁতের ক্ষয়ের প্রাথমিক চিহ্নিতকরণ শুধুমাত্র দাঁতের ডাক্তারই করতে পারেন। নিয়মিত চেকআপ করানো বড় সমস্যা থেকে রক্ষা করতে পারে।
ক্যারিয়েসের ঘরোয়া উপায় ও প্রাকৃতিক চিকিৎসা
যদি ক্ষয় শুরু হয়ে যায়, তাহলে কিছু প্রাকৃতিক উপায়ে এটিকে রোধ করা যায় এবং ব্যথা কমানো যায়।
- লবঙ্গের তেল: লবঙ্গে থাকা ইউজেনল নামক উপাদান ব্যথা ও প্রদাহ কমায়। এক টুকরো রুইতে লবঙ্গের তেল লাগিয়ে ক্ষতস্থানে রাখুন। দিনে ২-৩ বার এটি পুনরায় করুন।
- নারকেল তেল দিয়ে অয়েল পুলিং: সকালে খালি পেটে ১ চা-চামচ নারকেল তেল মুখে ১০ মিনিট ধরে ঘোরান, তারপর থুথু ফেলে কুলকুলি করুন। এটি মুখের ব্যাকটেরিয়া কমাতে সাহায্য করে এবং দাঁতের ক্ষয় রোধ করে।
- হলুদের ব্যবহার: হলুদে অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল গুণ রয়েছে। আধা চা-চামচ হলুদে অল্প সরিষার তেল মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করুন এবং দাঁতে লাগান। এতে দাঁতের ব্যথা ও প্রদাহ কমে।
- নিমের দাতুন: নিমে প্রাকৃতিক অ্যান্টিসেপটিক উপাদান রয়েছে। নিমের দাতুন করলে দাঁত পরিষ্কার থাকে এবং ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধি পায় না।
- গরম পানিতে লবণ দিয়ে কুলকুলি: এক গ্লাস গরম পানিতে আধা চা-চামচ লবণ মিশিয়ে দিনে দুবার কুলকুলি করুন। এতে মুখের ব্যাকটেরিয়া নষ্ট হয় এবং প্রদাহও কমে।
শিশুদের ক্যারিয়েস রোধের বিশেষ ব্যবস্থা
শিশুরা মিষ্টি ও টফি বেশি খায়, তাই তাদের দাঁত দ্রুত ক্ষয় হয়। মা-বাবাকে এই বিষয়গুলির দিকে নজর রাখা উচিত:
- শিশুদের মিষ্টি খাওয়ার পর কুলকুলি করান
- দিনে দুবার ব্রাশ করান
- শিশুদের ব্রাশে ফ্লোরাইডযুক্ত টুথপেস্ট ব্যবহার করান (বয়স অনুযায়ী)
- প্রতি ৬ মাস অন্তর দাঁতের চেকআপ করান
- বোতল থেকে খাওয়ানোর পরপরই শিশুদের মুখ পরিষ্কার করুন
কবে ডাক্তারের সাথে দেখা করা উচিত?
যদি আপনার দাঁতে অবিরাম ব্যথা থাকে বা কোন কিছু চিবানোতে অসুবিধা হয়, তাহলে এটি একটি ইঙ্গিত হতে পারে যে আপনার দাঁতে কোন গুরুতর সমস্যা আছে। অনেক সময় লোকেরা দাঁতের হালকা ব্যথা উপেক্ষা করে, কিন্তু পরে এটি বড় দুর্ভোগের কারণ হতে পারে। যদি আপনার দাঁত থেকে রক্ত পড়ে বা মাড়িতে প্রদাহ অনুভব করেন, তাহলে তা হালকাভাবে নেবেন না।
এই ধরনের পরিস্থিতিতে অবিলম্বে কোন ভালো দাঁতের ডাক্তারের সাথে দেখা করা উচিত। সময়মতো চিকিৎসা না করালে সমস্যা আরও গুরুতর হতে পারে, যার ফলে দাঁত উঠিয়ে ফেলার প্রয়োজন হতে পারে। ভালো হবে যদি আপনি প্রাথমিক পর্যায়েই সতর্কতা অবলম্বন করেন এবং ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করেন, যাতে ব্যথা ও ক্ষয় সময়মতো রোধ করা যায়।
দাঁতের ক্ষয় বা ক্যারিয়েস একটি সাধারণ কিন্তু গুরুতর সমস্যা, যা যদি সময়মতো রোধ না করা হয় তাহলে এটি দাঁত হারানোর পর্যন্ত অবস্থায় পৌঁছাতে পারে। ভালো হবে যদি সময়মতো দাঁতের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, খাদ্যাভ্যাস ও ঘরোয়া উপায় অবলম্বন করে এটি রোধ করা যায়। এছাড়াও, দাঁতের ডাক্তারের কাছে নিয়মিত চেকআপ করান যাতে যে কোন সমস্যা প্রাথমিক পর্যায়েই ধরা পড়ে।