চোখের ফড়ফড়ানি অর্থাৎ পাতার অনিয়ন্ত্রিত ও অযথাই নাড়াচাড়া খুবই সাধারণ সমস্যা। বেশিরভাগ মানুষ এটিকে নজরবন্দী বা শুভ-অশুভ লক্ষণের সাথে যুক্ত করে। বিশেষ করে ভারতে এ বিষয়ে নানা ধরণের বিশ্বাস প্রচলিত আছে, যেমন ডান চোখের ফড়ফড়ানি শুভ হয় এবং বাম চোখের অশুভ। কিন্তু সত্যিই কি চোখ ফড়ফড়ানোর অর্থ কোন অলৌকিক লক্ষণ? নাকি এটি কোন রোগের লক্ষণ? আসুন জেনে নেই চোখের ফড়ফড়ানির প্রকৃত কারণগুলি, পাশাপাশি এর সঠিক চিকিৎসা ও সতর্কতা।
চোখ ফড়ফড়ানির চিকিৎসা ভাষা — মায়োকিমিয়া
চোখের ফড়ফড়ানিকে চিকিৎসা ভাষায় "মায়োকিমিয়া" বলে। এই অবস্থা তখন হয় যখন চোখের পাতার পেশীগুলি অনিয়ন্ত্রিতভাবে সংকুচিত হতে থাকে। এই ফড়ফড়ানি প্রায়শই উপরের পাতায় হয়, কিন্তু মাঝে মাঝে নিচের পাতাও প্রভাবিত হতে পারে। এই ধরণের ফড়ফড়ানি সাধারণত হালকা ও অস্থায়ী হয়, যা কয়েক সেকেন্ড থেকে কয়েক মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।
কিন্তু যদি ফড়ফড়ানি দীর্ঘ সময় ধরে চলে বা বারবার হয়, তাহলে এটি গুরুতর সমস্যার লক্ষণও হতে পারে। তাই এটিকে উপেক্ষা করা উচিত নয়।
চোখ ফড়ফড়ানোর কারণ — জেনে নিন বিজ্ঞানের ভাষায়
- উদ্বেগ ও চিন্তা: আধুনিক জীবনযাত্রায় উদ্বেগ ও চিন্তা সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে উঠেছে। যখন আমাদের মস্তিষ্ক চাপে থাকে, তখন শরীরের নিউরোট্রান্সমিটারগুলি ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। এতে পেশীতে অনৈচ্ছিক সংকোচন শুরু হয়, যা চোখের ফড়ফড়ানোর প্রধান কারণ। কাজের চাপ, পারিবারিক উদ্বেগ এবং আর্থিক সমস্যা এই অবস্থাকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
- ঘুমের অভাব: পর্যাপ্ত ঘুম না পাওয়া স্নায়ুতন্ত্রের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। ঘুমের অভাবের ফলে শরীরের পেশীগুলি ক্লান্ত ও সংবেদনশীল হয়ে পড়ে, যার ফলে ফড়ফড়ানির সমস্যা বেড়ে যায়। গবেষণা দেখায় যে যারা ৭-৯ ঘন্টার কম ঘুমায় তাদের মধ্যে মায়োকিমিয়ার সমস্যা বেশি দেখা যায়।
- ক্যাফিন ও অ্যালকোহলের অতিরিক্ত সেবন: কফি, চা, এনার্জি ড্রিঙ্কস ইত্যাদিতে থাকা ক্যাফিন ও মদ স্নায়ুতন্ত্রকে উত্তেজিত করে। অতিরিক্ত ক্যাফিন ও অ্যালকোহল গ্রহণের ফলে পেশীগুলি আরও সংবেদনশীল হয়ে পড়ে, যার ফলে চোখ ফড়ফড়ানোর সমস্যা বেড়ে যায়।
- চোখের উপর অত্যধিক চাপ: আজকাল মোবাইল, ল্যাপটপ এবং টিভির স্ক্রিনে অনেক ঘন্টা ধরে তাকিয়ে থাকা চোখের পেশীর উপর চাপ দেয়। দীর্ঘ সময় ধরে স্ক্রিনের সামনে থাকার ফলে চোখের পেশীগুলি ক্লান্ত হয়ে পড়ে, যার ফলে ফড়ফড়ানির অভিযোগ হয়।
- পুষ্টির অভাব: শরীরে ভিটামিন বি১২, ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়ামের মতো প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাবের ফলেও স্নায়ুতন্ত্র দুর্বল হয়। বিশেষ করে শাকাহারীদের মধ্যে ভিটামিন বি১২ এর অভাব সাধারণ, যা চোখের ফড়ফড়ানোর কারণ হতে পারে।
- ড্রাই আইজ ও অ্যালার্জি: বৃদ্ধদের মধ্যে ড্রাই আইজের সমস্যা প্রায়শই দেখা যায়। এটি চোখের জ্বালা ও চুলকানির কারণ হয়, যার ফলে চোখ ঘষার অভ্যাস হয়ে পড়ে। বারবার চোখ ঘষার ফলে হিস্টামিন নির্গত হয়, যা ফড়ফড়ানিকে বাড়িয়ে তোলে। অ্যালার্জিও একই ধরণের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
কখন গুরুতর মনে করা উচিত?
যদি চোখের ফড়ফড়ানি খুব বেশি হয়, দুটি চোখের পাতায় অনিয়ন্ত্রিতভাবে ঝাপসা হতে থাকে বা মুখের অন্যান্য অংশে পেশীর ফড়ফড়ানি হয়, তাহলে তাকে গুরুতর মনে করা হয়। এটি কিছু নিউরোলজিক্যাল রোগের লক্ষণ হতে পারে যেমন:
- ব্লেফারোস্পাজম: এতে দুটি চোখের পাতা হঠাৎ করে ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে বন্ধ হয়ে যায়।
- হেমিফেসিয়াল স্পাজম: মুখের একপাশে পেশীর ক্রমাগত ফড়ফড়ানি।
- মাল্টিপল স্কেলেরোসিস বা পার্কিনসন্স রোগের মতো রোগও এ ধরণের লক্ষণ দেখাতে পারে।
- এই ধরণের ক্ষেত্রে অবিলম্বে বিশেষজ্ঞ নিউরোলজিস্টের সাথে যোগাযোগ করা প্রয়োজন।
চোখ ফড়ফড়ানো থেকে বাঁচার উপায়
- প্রতিদিন অন্তত ৭ থেকে ৮ ঘন্টা ভালো ঘুম পান।
- চাপ কমাতে যোগ, ধ্যান বা মেডিটেশন করুন।
- ক্যাফিন ও অ্যালকোহলের সেবন সীমিত করুন।
- ডিজিটাল স্ক্রিনের সামনে বেশি সময় কাটান না এবং প্রতি ২০-৩০ মিনিট পর বিরতি নিন।
- ভিটামিন বি১২, ম্যাগনেসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার খান, যেমন সবুজ শাকসবজি, বাদাম, শস্য ইত্যাদি।
- যদি ড্রাই আইজের সমস্যা হয়, তাহলে কৃত্রিম অশ্রু ব্যবহার করুন বা ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করুন।
- চোখ বারবার ঘষা থেকে বিরত থাকুন।