বাতাসর বা পাইলস, এমন একটি স্বাস্থ্য সমস্যা যা অত্যন্ত কষ্টদায়ক এবং মানুষকে মানসিক ও শারীরিক উভয় পর্যায়েই বিরক্ত করে। এই রোগ বিশেষ করে আজকের জীবনধারা, অনিয়মিত খাবার এবং কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যার কারণে দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু যোগগুরু বাবা রামদেবের মতে, এই রোগ সম্পূর্ণরূপে নিরাময় করা সম্ভব—তাইও অপারেশন ছাড়াই। তিনি সম্প্রতি জানিয়েছেন যে, একটি বিশেষ সবুজ পাতার সেবন করলে বাতাসরের মূল থেকে পরিষ্কার করা সম্ভব। আসুন জেনে নিই বাতাসরের কারণ, লক্ষণ, প্রতিরোধ এবং এর উপর আয়ুর্বেদের কার্যকর ঘরোয়া প্রতিকার।
বাতাসর কী এবং কেন হয়?
বাতাসর এমন একটি রোগ যেখানে গুদামার্গ বা মলদ্বারের আশেপাশের স্নায়ুতে প্রদাহ হয় এবং সেখানে মসা তৈরি হতে থাকে। এই মসা কখনও কখনও এতটাই ফুলে যায় যে তাতে ব্যথা হতে থাকে এবং মলত্যাগের সময় রক্তপাতও হতে পারে। বাতাসর মূলত দুই প্রকারের হয়। প্রথমত, অভ্যন্তরীণ বাতাসর যেখানে মসা গুদের ভিতরে থাকে। এই প্রকারে প্রায়শই ব্যথা কম হয় কিন্তু মলত্যাগের সময় রক্তপাত সাধারণ ঘটনা। দ্বিতীয়ত, বাহ্যিক বাতাসর যেখানে মসা বাইরের দিকে থাকে এবং এগুলোতে বেশি ব্যথা হয়।
বাতাসর হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হল কোষ্ঠকাঠিন্য। যখন পেট দীর্ঘদিন ধরে ঠিকভাবে পরিষ্কার হয় না, তখন গুদের স্নায়ুতে চাপ বৃদ্ধি পায় যার ফলে এগুলি ফুলে যায়। এছাড়াও, যদি কোন ব্যক্তি ফাইবারযুক্ত খাবার না খায়, কম পানি পান করে এবং বেশি সময় বসে থাকে, তাহলে বাতাসরের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তাই সঠিক খাবার, প্রচুর পানি পান এবং নিয়মিত ব্যায়াম বাতাসর থেকে রক্ষা করার জন্য অপরিহার্য।
বাবা রামদেবের রামবাণ ঘরোয়া প্রতিকার
বাতাসরের সমস্যা অনেকের কাছে কষ্টদায়ক, কিন্তু বাবা রামদেবের মতে, এই রোগের চিকিৎসা সম্পূর্ণরূপে প্রাকৃতিক উপায়ে করা সম্ভব। তিনি জানিয়েছেন যে, নাগদোন পাতা বাতাসরের জন্য অত্যন্ত কার্যকর প্রতিকার। এই পাতাগুলি শুধুমাত্র গুদা অঞ্চলের প্রদাহ কমায় না, বরং রক্তপাতও বন্ধ করে দেয়। এইভাবে এই পাতাগুলি বাতাসরের ব্যথা এবং অসুবিধা মূল থেকে নির্মূল করতে সাহায্য করে। প্রাকৃতিক হওয়ার কারণে এর কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও হয় না, তাই এটি ব্যবহার করা নিরাপদ।
বাতাসর থেকে মুক্তি পেতে প্রতিদিন সকালে খালি পেটে ৩-৪টি তাজা ও সবুজ নাগদোন পাতা চিবিয়ে খেতে হবে। এগুলো চিবিয়ে খাওয়া খুব সহজ এবং এর প্রভাবও দ্রুত দেখা যায়। ক্রমাগত সেবন করলে ৩ থেকে ৭ দিনের মধ্যে বাতাসরের সমস্যায় যথেষ্ট উন্নতি হয়। এই পদ্ধতি গুদা অঞ্চলের প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে এবং রক্তপাত বন্ধ করে দেয়, যার ফলে রোগীকে অনেক আরাম মেলে। এই ঘরোয়া প্রতিকারটি ব্যবহার করে আপনি ওষুধ ছাড়াই আপনার সমস্যা কমাতে পারেন।
বাতাসরে কোন কোন জিনিস থেকে বিরত থাকা উচিত
বাবা রামদেব জানিয়েছেন যে, কিছু কিছু জিনিস বাতাসরের সমস্যা আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। এই ক্ষেত্রে এগুলো থেকে দূরে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ:
- মশলাযুক্ত এবং ভাজা-ভুনা জিনিসপত্র: বাতাসরের সমস্যায় তেল-মশলাযুক্ত খাবার, যেমন সমোসা, পকোড়া, পুরি, চিপস ইত্যাদি থেকে দূরত্ব বজায় রাখুন। এই জিনিসগুলি পেটে উত্তাপ এবং কোষ্ঠকাঠিন্য বাড়ায়, যার ফলে মসায় জ্বালা এবং ব্যথা হতে পারে।
- অধিক মরিচযুক্ত খাবার: খুব তেঁতুল বা মরিচযুক্ত খাবার খেলে গুদামার্গে জ্বালা এবং প্রদাহ বেড়ে যায়। এতে বাতাসরের লক্ষণ আরও খারাপ হতে পারে, তাই হালকা এবং সাধারণ খাবারই খান।
- ময়দার তৈরি জিনিসপত্র: নুডলস, পিজ্জা, বার্গার এবং বিস্কুটের মতো ময়দার তৈরি জিনিসপত্র হজমে ভারী এবং পেট পরিষ্কার করে না। এতে কোষ্ঠকাঠিন্যের অভিযোগ বৃদ্ধি পায় যা বাতাসরকে আরও খারাপ করে।
- চা, কফি এবং মদ: অধিক পরিমাণে চা এবং কফি পান করলে শরীরে পানির অভাব হয়। একইভাবে মদও হজমকে দুর্বল করে এবং অন্ত্রকে শুষ্ক করে দেয়, যার ফলে বাতাসরে অসুবিধা বৃদ্ধি পায়।
- অধিকক্ষণ বসে থাকা বা দাঁড়িয়ে থাকা: একই অবস্থানে অধিকক্ষণ বসে থাকলে বা দাঁড়িয়ে থাকলে গুদা অঞ্চলে চাপ বৃদ্ধি পায়, যার ফলে মসা এবং ব্যথা বৃদ্ধি পেতে পারে। মাঝে মাঝে হালকা আন্দোলন এবং কিছুটা হাঁটাহাঁটি বাতাসরে উপশম দিতে পারে।
বাতাসরে কী খাওয়া উচিত?
বাবা রামদেব জানান যে, বাতাসর পীড়িত ব্যক্তিকে তার খাদ্যের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। কিছু কিছু জিনিস এই সমস্যা কমাতে অনেক সাহায্য করতে পারে:
- সবুজ পাতাযুক্ত শাকসবজি খান: পালং শাক, মেথি, সহজনা পাতার মতো সবুজ পাতাযুক্ত শাকসবজি বাতাসরে অত্যন্ত উপকারী। এগুলিতে ভিটামিন, খনিজ এবং ফাইবার থাকে যা কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে এবং পেট পরিষ্কার রাখে।
- ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করুন: দলিয়া, ওটস এবং ব্রাউন রাইসের মতো ফাইবারযুক্ত শস্য খাওয়া উচিত। এই জিনিসগুলি হজমকে উন্নত করে এবং মলকে নরম রাখে, যার ফলে বাতাসরে ব্যথা এবং রক্তপাতের সমস্যা কমে যায়।
- প্রতিদিন সকালে লাউয়ের রস পান করুন: লাউয়ের রস পেটকে ঠান্ডা করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে। প্রতিদিন সকালে খালি পেটে এক গ্লাস লাউয়ের রস পান করা বাতাসরের জন্য অত্যন্ত উপকারী।
- ত্রিফলা চূর্ণ সেবন করুন: রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে এক চা-চামচ ত্রিফলা চূর্ণ গরম পানির সাথে নিন। ত্রিফলা হজম ক্রিয়াকে উন্নত করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে রক্ষা করে, যার ফলে বাতাসরের সমস্যায় উপশম মেলে।
- প্রয়োজনীয় পরিমাণে পানি পান করুন: দিনে কমপক্ষে ৩ থেকে ৪ লিটার পানি পান করা উচিত। পানি শরীরকে জলবদ্ধ রাখে এবং মলকে নরম করে, যার ফলে মলত্যাগ সহজ হয় এবং বাতাসরের অসুবিধা কমে।
যোগ এবং একুপ্রেশার থেকেও উপকার পাওয়া যাবে
- উপকারী যোগাসন: বাবা রামদেব জানিয়েছেন যে, কিছু বিশেষ যোগাসন বাতাসরের সমস্যায় আরাম দেয়। পবনমুক্তাসন, বজ্রাসন (বিশেষ করে খাবার পর), মলাসন, কপালভাতি এবং অনুলোম-বিলোম প্রাণায়াম এই যোগাসনগুলির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। এই যোগাসনগুলি হজমতন্ত্রকে শক্তিশালী করে এবং অন্ত্র পরিষ্কার করতে সাহায্য করে, যার ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য এবং বাতাসরের সমস্যা কমে।
- একুপ্রেশার প্রতিকার: বাতাসরে একুপ্রেশারও উপকারী। হাতের কব্জির উপরে, বাইরের দিকে একটি বিশেষ বিন্দু থাকে যা হালকাভাবে চেপে ধরলে বাতাসরে আরাম মেলে। এই বিন্দুটি দিনে দুই থেকে তিনবার ২-৩ মিনিট ধরে চেপে ধরতে হবে।
- কিভাবে অনুশীলন করবেন: যোগাসন এবং একুপ্রেশারের অনুশীলন নিয়মিতভাবে করতে হবে যাতে হজম ভালো হয় এবং গুদা অঞ্চলের প্রদাহ কমে। এতে বাতাসরের সমস্যা দ্রুত সারে এবং ব্যক্তি আরাম পায়।
বাতাসর থেকে রক্ষা করার প্রয়োজনীয় উপায়
বাতাসর থেকে মুক্তি পেতে চিকিৎসার সাথে সাথে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করাও জরুরী:
- খাবার খাওয়ার পর তৎক্ষণাৎ পানি পান করবেন না: খাবার খাওয়ার পর তৎক্ষণাৎ পানি পান করতে না। কমপক্ষে আধা ঘন্টার ব্যবধান রাখুন। এভাবে করলে আপনার হজম ভালো হয় এবং কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা কমে, যার ফলে বাতাসরের সম্ভাবনা কমে যায়।
- গরম পানিতে Sitz Bath নিন: দিনে একবার গরম পানিতে বসে থাকা অত্যন্ত উপকারী, একে Sitz Bath বলা হয়। এতে গুদা অঞ্চলের প্রদাহ কমে এবং ব্যথায় আরাম মেলে। বাতাসরে উপশম পাওয়ার এটি একটি সহজ এবং কার্যকর উপায়।
- মলত্যাগের সময় জোর দেওয়া থেকে বিরত থাকুন: মলত্যাগের সময় অধিক জোর দিলে গুদের স্নায়ুতে চাপ পড়ে, যা বাতাসরকে বাড়িয়ে তুলতে পারে। তাই চেষ্টা করুন যাতে মলত্যাগ স্বাভাবিকভাবে এবং আরামে হয়, কোন জোর-জবরদস্তি ছাড়াই।
- নিয়মিত এবং সময়মতো টয়লেট যান: মলকে রোধ করা বা দেরিতে টয়লেট যাওয়া বাতাসরের সমস্যা বাড়িয়ে তুলতে পারে। তাই আপনার শরীরের সংকেতগুলি বুঝুন এবং যখনই ইচ্ছা হয়, তখনই টয়লেট যান। এতে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যাও দূর থাকে।
বাতাসর কোন অসারোগ্য রোগ নয়, বরং সামান্য সচেতনতা, আয়ুর্বেদিক প্রতিকার এবং জীবনধারায় পরিবর্তন আনলে এটি মূল থেকে নির্মূল করা সম্ভব। বাবা রামদেব কর্তৃক পরামর্শিত নাগদোন পাতা একটি প্রাকৃতিক এবং সস্তা প্রতিকার যা অনেককে উপকৃত করেছে। এর সাথে যদি আপনি সঠিক খাদ্য, যোগ এবং প্রাণায়াম গ্রহণ করেন তাহলে বাতাসরের অসুবিধা থেকে খুব দ্রুত মুক্তি পাওয়া যায়।
```