নির্গুণ্ডী: গাঠি, সায়টিকা ও স্লিপ ডিস্কের প্রাকৃতিক চিকিৎসা

🎧 Listen in Audio
0:00

আজকাল যৌথব্যাথা, সায়টিকা, স্লিপ ডিস্ক এবং গাঠির মতো সমস্যাগুলি বেশ সাধারণ হয়ে উঠছে। জীবনযাত্রার পরিবর্তন, দীর্ঘক্ষণ বসে কাজ করা এবং শারীরিক কার্যকলাপের অভাব এর প্রধান কারণ। এই সমস্ত রোগের জন্য ঔষধ, থেরাপি এবং অনেক সময় সার্জারিরও প্রয়োজন হয়, কিন্তু জানেন কি আয়ুর্বেদে এমন একটি ছোটো গাছ আছে যা এই গুরুতর সমস্যাগুলির ক্ষেত্রে খুবই কার্যকর হতে পারে? আমরা বলছি নির্গুণ্ডীর কথা।

এটি দেখতে যদিও সাধারণ একটা झাড়ির মতো, কিন্তু এর ঔষধি গুণ এতটাই কার্যকর যে আয়ুর্বেদে একে ‘বাতহর’ অর্থাৎ বাত নিরাময়কারী উদ্ভিদ বলা হয়। বিশেষত্ব হল, এই গাছটি ভারতের প্রায় সর্বত্রই সহজলভ্য।

কী নির্গুণ্ডী?

নির্গুণ্ডী (Vitex Negundo) একটি झাড়ি জাতীয় ঔষধি উদ্ভিদ যা ভারতে প্রাচীনকাল থেকেই ব্যবহার হয়ে আসছে। সংস্কৃতে একে ‘সিন্দুবার’, ‘নিরগুণ্ডী’ এবং ‘সর্বজ্বরহর’ নামেও জানা যায়। এই উদ্ভিদটি বেশিরভাগ আর্দ্র এলাকায় পাওয়া যায় এবং বিশেষ করে ক্ষেতের ধারে বা ফাঁকা জমিতে জন্মায়।

গাঠি এবং সায়টিকায় কেন উপকারী?

গাঠিতে (Arthritis) আরাম: গাঠি একটি প্রদাহজনিত রোগ যা বিশেষ করে যৌথগুলিকে প্রভাবিত করে। নির্গুণ্ডীর পাতায় অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি (প্রদাহ কমাতে সাহায্যকারী) উপাদান রয়েছে যা যৌথের প্রদাহ এবং ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। এর জন্য নির্গুণ্ডীর পাতার চূর্ণ গরম জলের সাথে খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। তদুপরি, পাতা তেলে ভেজে প্রভাবিত অংশে মালিশ করলেও বেশ উপকার পাওয়া যায়।

সায়টিকায় (Sciatica) উপশম: সায়টিকার সমস্যায় কোমর থেকে পা পর্যন্ত নার্ভে অসহ্য ব্যথা হয়। এই ব্যথা বসা, উঠা বা হাঁটার সময় অসুবিধা সৃষ্টি করে। এই অবস্থায় নির্গুণ্ডীর পাতার বাষ্প সেকানো অথবা এর পেস্ট গরম করে ব্যথা যেখানে আছে সেখানে লাগালে অনেক আরাম পাওয়া যায়। এই প্রয়োগ দৈনিক করলে কিছু দিনের মধ্যেই ফারাক দেখা যাবে।

স্লিপ ডিস্কে কীভাবে কাজ করে?

স্লিপ ডিস্ক অর্থাৎ মেরুদণ্ডের মাঝখানের স্নায়ু খসে যাওয়া একটি বেদনাদায়ক সমস্যা। এতে পিঠের নিচের দিকে তীব্র ব্যথা হয় এবং হাঁটতে অসুবিধা হয়। নির্গুণ্ডীর পাতা দিয়ে তৈরি বিশেষ কাড়া বা হালুয়া এই ব্যথা কমাতে কার্যকর। একটি সহজ রেসিপি হল – ২৫০ গ্রাম নির্গুণ্ডীর পাতা ১.৫ লিটার জলে ফুটিয়ে নিন, যখন জল অর্ধেক থাকে, তখন তাতে গমের আটা দিয়ে হালুয়া তৈরি করে প্রতিদিন সকালে খালি পেটে খান। এই পদ্ধতি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক এবং শরীরে কোনও ধরণের প্রতিক্রিয়া করে না।

অন্যান্য উপকারী গুণ

ত্বক রোগে উপকার: নির্গুণ্ডীর পাতা দিয়ে তৈরি তেল ত্বকের অ্যালার্জি, চুলকানি এবং সংক্রমণে উপকারী। এটি নারকেল বা তিলের তেলে মিশিয়ে সরাসরি ত্বকে লাগালে উপশম পাওয়া যায়। এটি ত্বককে পুষ্ট করে এবং রক্ত ​​শুদ্ধ করে।

চুলের জন্য বরদান: যদি আপনার চুল সময়ের আগেই সাদা হচ্ছে অথবা ড্যান্ড্রাফের সমস্যা হয়, তাহলে নির্গুণ্ডীর পাতার তেল উপকারী হতে পারে। এটি তিলের তেলে ভেজে মাথায় লাগান। এটি স্ক্যাল্পকে ঠাণ্ডা রাখে এবং চুলের গোড়া মজবুত করে।

সর্দি-কাশি এবং মাথাব্যথায় উপশম: নির্গুণ্ডীর কাড়া সর্দি-কাশি, মাথাব্যথা, জ্বর এবং নাক দিয়ে পানি পড়ায়ও কার্যকর। এর জন্য কিছু পাতা জলে ফুটিয়ে তাতে আদা, দারচিনি এবং লবঙ্গ মিশিয়ে কাড়া তৈরি করুন। প্রতিদিন এটি সেবন করলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।

ব্যবহারের প্রণালী:

  • বাষ্পের জন্য: নির্গুণ্ডীর পাতা জলে ফুটিয়ে তার বাষ্প সেক করুন।
  • তেল রূপে: পাতা তিল বা নারকেল তেলে ভেজে ব্যবহার করুন।
  • কাড়া: পাতা জলে ফুটিয়ে কাড়া তৈরি করুন, তাতে লবঙ্গ বা আদা মেশাতে পারেন।
  • হালুয়া: ফোটানো নির্গুণ্ডীর জলে আটা দিয়ে হালুয়া তৈরি করে সকালে খালি পেটে খান।
  • পেস্ট: তাঁজা পাতার পেস্ট তৈরি করে গরম করে প্রভাবিত স্থানে লাগান।

সাবধানতা অপরিহার্য

যদিও নির্গুণ্ডী একটি প্রাকৃতিক এবং আয়ুর্বেদিক ঔষধ, কিন্তু এটি ব্যবহার করার সময় কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। যদি কোনও ব্যক্তির উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা থাকে, সে গর্ভবতী হয় অথবা তার শরীরে পিত্ত বৃদ্ধির অভিযোগ থাকে, তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া এটি সেবন বা বহিরাগত ব্যবহার করা উচিত নয়। কারণ কিছু ক্ষেত্রে এই ঔষধ শরীরে তাপ বৃদ্ধি করতে পারে অথবা পূর্ববর্তী রোগকে প্রভাবিত করতে পারে। তাই নিরাপদ এবং সঠিক ব্যবহারের জন্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।

আয়ুর্বেদে বর্ণিত এই ছোটো গাছ ‘নির্গুণ্ডী’ আজকের অনেক বড় বড় রোগে রামবাণের কাজ করতে পারে। এর নিয়মিত, সংযত এবং সঠিক ব্যবহার আপনাকে ঔষধ ছাড়াই গাঠি, স্লিপ ডিস্ক এবং সায়টিকার মতো সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে পারে। যদি আপনি প্রাকৃতিক এবং পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া মুক্ত চিকিৎসার সন্ধানে থাকেন, তাহলে নির্গুণ্ডী অবশ্যই চেষ্টা করুন।

Leave a comment