মাথাব্যথা: কারণ, নিরাময় ও কখন ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করবেন

🎧 Listen in Audio
0:00

প্রায়ই সকালে ঘুম থেকে উঠেই কি মাথার ভার বোধ করেন? অথবা অফিস থেকে ফিরে কি মাথায় তীব্র ব্যথা শুরু হয়? যদি হ্যাঁ হয়, তাহলে এটি শুধুমাত্র ক্লান্তি অথবা ঘুমের ঘাটতির কারণে নয়, এর পিছনে আরও অনেক কারণ থাকতে পারে। আজকের ব্যস্ত জীবনে মাথাব্যথা (Headache) খুবই সাধারণ সমস্যা হয়ে উঠেছে। কিন্তু প্রায়শই মানুষ এটিকে উপেক্ষা করে এবং পেনকিলার অথবা চা দিয়ে আরাম পাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু বারবার মাথাব্যথা হওয়া আপনার শরীরে কোনও সমস্যার ইঙ্গিতও হতে পারে।

সাইনাসের সমস্যা: মাথাব্যথার একটি সাধারণ কারণ

যদি মাথাব্যথার সাথে সাথে আপনার নাক বন্ধ থাকে, চোখের চারপাশে অথবা গালে ভারীভাব অনুভূত হয়, তাহলে এটি সাইনাস হেডেক হতে পারে। সাইনাস তখন হয় যখন আপনার মাথার ভিতরের বাতাসে ভরা জায়গায় প্রদাহ অথবা সংক্রমণ হয়। এটি সাধারণত ঠান্ডা লাগা, অ্যালার্জি অথবা ঋতু পরিবর্তনের কারণে হয়।

কী করবেন

  • গরম পানির বাষ্প নিন, এতে নাক খুলতে সাহায্য করে
  • গরম পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে ফেলুন
  • ধুলো, মাটি এবং অ্যালার্জির কারণ হতে পারে এমন জিনিসপত্র থেকে দূরে থাকুন
  • প্রয়োজন হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে ঔষধ সেবন করুন

চাপ ও উদ্বেগ

আজকের ব্যস্ত ও উদ্বেগে পরিপূর্ণ জীবনে চাপ (Stress) একটি সাধারণ সমস্যা হয়ে উঠেছে। অফিসের চাপ, ঘরের দায়িত্ব, অর্থের উদ্বেগ অথবা সম্পর্কের জটিলতা – এগুলি মিলে মস্তিষ্কে চাপ সৃষ্টি করে। যখন আমাদের মস্তিষ্ক ক্লান্ত হয় অথবা অতিরিক্ত চিন্তা করে, তখন এর প্রভাব মাথায় পড়ে এবং মাথাব্যথা শুরু হয়। এ ধরণের ব্যথাকে টেনশন হেডেক বলা হয়। এই ব্যথা সাধারণত মাথার দুই পাশে অথবা পিছনে হয় এবং সারাদিন ধরে থাকতে পারে।

কী করবেন

  • প্রতিদিন নিজের জন্য কিছু সময় বের করুন
  • যোগ, ধ্যান অথবা গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের অনুশীলন করুন
  • প্রয়োজন হলে কোনও বিশ্বস্ত বন্ধু অথবা পরিবারের সদস্যের সাথে কথা বলুন
  • পর্যাপ্ত ঘুম নিন এবং খাবারের সময়সূচী ঠিক রাখুন

অতিরিক্ত ক্যাফেইন সেবন অথবা হঠাৎ করে বন্ধ করাও মাথাব্যথার কারণ হতে পারে

যদি আপনি সারাদিন বারবার চা অথবা কফি পান করেন এবং তারপর একদিন হঠাৎ করে বন্ধ করে দেন, তাহলে এর ফলে মাথায় ব্যথা শুরু হতে পারে। একে ক্যাফেইন উইথড্রয়াল বলা হয়। আমাদের শরীর যখন প্রতিদিন ক্যাফেইনের অভ্যাসে অভ্যস্ত হয়ে যায়, তখন তা হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যাওয়া শরীরে ধাক্কা দেয়, যার ফলে মাথাব্যথা, চটচটে মেজাজ অথবা ক্লান্তি অনুভূত হয়।

কী করবেন

  • ধীরে ধীরে ক্যাফেইন কমিয়ে দিন, হঠাৎ করে বন্ধ করবেন না
  • দিনে ১ অথবা ২ কাপের বেশি চা-কফি পান করবেন না
  • এর বিকল্প হিসেবে হার্বাল টি, লেবু পানি অথবা গরম পানি পান করুন

মোবাইল ও ল্যাপটপের অতিরিক্ত ব্যবহারও মাথাব্যথা দেয়

আজকাল বেশিরভাগ মানুষ সারাদিন মোবাইল, ল্যাপটপ অথবা টিভি স্ক্রিনের সামনে থাকে – চাহি কাজের জন্য হোক অথবা বিনোদনের জন্য। কিন্তু আপনি কি জানেন যে স্ক্রিনে অতিরিক্ত সময় কাটানোর ফলে আপনার চোখে অনেক চাপ পড়ে? একে আই-স্ট্রেইন বলা হয়, এবং এটি পরবর্তীতে মাথাব্যথার একটি সাধারণ কারণ হয়ে ওঠে।

যখন আমরা ক্রমাগত বিরতি ছাড়া স্ক্রিন দেখি, তখন চোখ ক্লান্ত হয়ে যায়। এর ফলে চোখে জ্বালা, অস্পষ্ট দৃষ্টি এবং মাথার পিছনে অথবা কপালে ব্যথা অনুভূত হতে পারে। অনেক সময় এই ব্যথা সারাদিন ধরে থাকে অথবা সন্ধ্যায় তীব্র হয়ে ওঠে।

মাথাব্যথা থেকে বাঁচার জন্য কী করবেন

  • প্রতি ২০ মিনিট পর ২০ সেকেন্ডের জন্য কোনও দূরের বস্তুর দিকে তাকান – একে ২০-২০-২০ রুল বলা হয়
  • স্ক্রিনের উজ্জ্বলতা কম রাখুন এবং অতিরিক্ত উজ্জ্বল আলো থেকে দূরে থাকুন
  • অ্যান্টি-গ্লেয়ার চশমা পরুন, বিশেষ করে যদি আপনি চশমা পরেন
  • মোবাইল ও ল্যাপটপ চোখের খুব কাছে রাখবেন না
  • স্ক্রিন টাইম সীমিত করুন এবং মাঝে মাঝে বিরতি নিন

মাইগ্রেন: মাথাব্যথার একটি বিশেষ এবং কষ্টদায়ক কারণ

মাইগ্রেন একটি সাধারণ কিন্তু গুরুতর মাথাব্যথা, যা প্রায়শই মাথার একপাশে হয়। এই ব্যথা হালকা থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে খুব তীব্র এবং ধড়ফড়ানোর মতো হতে পারে। মাইগ্রেনের ব্যথা কয়েক ঘন্টা থেকে কয়েক দিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। এর সাথে প্রায়শই বমিভাব, বমি হওয়ার অনুভূতি, তীব্র আলো, তীব্র শব্দ অথবা তীব্র গন্ধে অস্বস্তি অনুভবের মতো লক্ষণ দেখা যায়। কিছু মানুষের মাইগ্রেন হওয়ার আগেই কিছু লক্ষণ দেখা দেয়, যেমন চোখের সামনে আলোর ঝলকানি, মাথা ঘোরা অথবা অসাড়তা। এই অবস্থাকে মাইগ্রেন উইথ অরা বলা হয়।

মাইগ্রেন থেকে মুক্তির জন্য কী করবেন

  • তীব্র আলো, শব্দ এবং জনবহুল স্থান থেকে দূরে থাকুন
  • সঠিক সময়ে খাবার খান, খালি পেটে থাকলে মাইগ্রেন বাড়তে পারে
  • পর্যাপ্ত ঘুম নিন, ঘুমের ঘাটতি অথবা অতিরিক্ত ঘুম – উভয়ই মাইগ্রেন ট্রিগার করতে পারে
  • চাপ এড়িয়ে চলুন, প্রতিদিন যোগ অথবা ধ্যান করুন
  • মাইগ্রেনের ঔষধ সর্বদা ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে নিন

পানির অভাব (ডিহাইড্রেশন) থেকে হওয়া মাথাব্যথা

যদি আপনার বারবার মাথাব্যথা হয়, তাহলে এর একটি বড় কারণ ডিহাইড্রেশন অর্থাৎ পানির অভাবও হতে পারে। যখন শরীরে পানির অভাব হয়, তখন আমাদের মস্তিষ্কে রক্ত পৌঁছানোর প্রক্রিয়া ধীর হয়ে যায়। এর ফলে মস্তিষ্কে পর্যাপ্ত অক্সিজেন পৌঁছায় না এবং মাথায় ভারীভাব অথবা তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়। গ্রীষ্মকালে এই সমস্যা আরও বেড়ে যায়, কারণ ঘামের মাধ্যমে শরীর থেকে অনেক পানি বেরিয়ে যায়।

অনেক মানুষ সারাদিনের ব্যস্ততায় পানি পান করা ভুলে যায় অথবা পিপাসা পেলেই পানি পান করে, যা সঠিক নয়। ডিহাইড্রেশনের ফলে শুধুমাত্র মাথাব্যথা হয় না, বরং ক্লান্তি, মাথা ঘোরা, মুখ শুষ্ক হওয়া এবং প্রস্রাবের রঙ গাঢ় হওয়া ইত্যাদি লক্ষণও দেখা যায়।

মাথাব্যথা থেকে বাঁচার জন্য কী করবেন

  • দিনে কমপক্ষে ৮-১০ গ্লাস পানি অবশ্যই পান করুন
  • সকালে ঘুম থেকে উঠেই প্রথমে ১-২ গ্লাস পানি পান করুন
  • লেবু পানি, নারকেল পানি অথবা ছাছের মতো স্বাস্থ্যকর পানীয় অন্তর্ভুক্ত করুন
  • অতিরিক্ত চা-কফি থেকে বিরত থাকুন, কারণ এগুলি শরীরকে আরও বেশি ডিহাইড্রেট করতে পারে
  • সর্বদা আপনার কাছে একটি পানির বোতল রাখুন এবং সময় সময় পান করুন

ঘুমের ঘাটতি অথবা অতিরিক্ত ঘুমও মাথাব্যথার কারণ হতে পারে

আমাদের শরীর সঠিকভাবে কাজ করার জন্য ঘুম অত্যন্ত প্রয়োজন। যদি আপনি প্রতিদিন খুব কম ঘুমান অথবা প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ঘুমান, তাহলে এর ফলে মাথাব্যথা হওয়া সাধারণ ব্যাপার। ঘুমের ঘাটতির ফলে শরীর ক্লান্ত হয়ে যায়, মস্তিষ্ক আরাম পায় না এবং এর সরাসরি প্রভাব আমাদের মাথায় পড়ে।

একইভাবে, যখন আমরা অতিরিক্ত ঘুমাই, তখন মস্তিষ্কে রাসায়নিকের ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে, যার ফলে সকালে উঠলে মাথা ভারী অথবা ব্যথায় ভরা অনুভূত হতে পারে। ঘুমের অসমতা শরীরের জৈবিক ঘড়ি অথবা বডি ক্লককেও নষ্ট করে, যা মাথাব্যথাকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।

মাথাব্যথা থেকে বাঁচার জন্য কী করবেন

  • প্রতিদিন ৭ থেকে ৮ ঘন্টা ঘুমানোর অভ্যাস করুন
  • ঘুমানো এবং উঠার একটি নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করুন এবং তা মেনে চলুন
  • ঘুমানোর আগে মোবাইল, ল্যাপটপ অথবা টিভি থেকে দূরত্ব বজায় রাখুন
  • রাতে ক্যাফেইন অথবা ভারী খাবার খাবেন না, এগুলি ঘুমে বাধা দেয়
  • ঘুমানোর পরিবেশ শান্ত ও আরামদায়ক রাখুন

কখন ডাক্তারের সাথে দেখা করবেন?

যদি আপনার মাথাব্যথা ক্রমাগত থাকে, সাধারণ ঔষধ দিয়েও ठিক হয় না, অথবা দিন দিন তীব্র হতে থাকে, তাহলে এটিকে হালকা ভাববেন না এবং অবিলম্বে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন। বিশেষ করে যখন মাথাব্যথার সাথে বমি হওয়া, বমিভাব, কথা বলতে অসুবিধা, অস্পষ্ট দৃষ্টি অথবা শরীরের কোনও অংশে দুর্বলতা ইত্যাদি সমস্যাও হচ্ছে। এছাড়াও, যদি মাথায় আঘাত লাগার পর ব্যথা শুরু হয় এবং তা ক্রমাগত থাকে, তাহলে এটি কোনও গুরুতর সমস্যার ইঙ্গিত হতে পারে। এই ধরণের লক্ষণ উপেক্ষা করা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে, তাই সঠিক সময়ে ডাক্তারের কাছে পরীক্ষা করা জরুরী।

মাথাব্যথা যদি বারবার হয়, তাহলে তা উপেক্ষা করা ঠিক নয়। এটি আপনার শরীরে চলমান কোনও গুরুতর সমস্যার সতর্কতাও হতে পারে। উপরে বর্ণিত কারণগুলি চিহ্নিত করুন এবং জীবনধারায় সামান্য পরিবর্তন আনার মাধ্যমে আরাম পান। যদি আপনি দীর্ঘদিন ধরে মাথাব্যথায় ভোগেন, তাহলে দেরি না করে – কোনও যোগ্য নিউরোলজিস্ট অথবা সাধারণ চিকিৎসকের কাছে পরীক্ষা করান। স্বাস্থ্যের সাথে আপোষ করবেন না, কারণ সুস্থ মস্তিষ্কই সুস্থ জীবনের চাবিকাঠি।

Leave a comment