পুরুষদের মধ্যে মহিলাদের তুলনায় রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের সমস্যা দ্রুত বেড়ে উঠছে। প্রায় ২০০টি দেশে পরিচালিত গবেষণা থেকে দেখা গেছে যে ভুল খাদ্যাভ্যাস, মানসিক চাপ এবং মদ্যপান-ধূমপানের মতো অভ্যাস এই রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। আজকের দ্রুতগতিসম্পন্ন জীবনে মানুষ নিজের স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রাখতে পারছে না। বিশেষ করে পুরুষদের মধ্যে এই সমস্যা বেশি দেখা যাচ্ছে।
ভুল খাবার, মানসিক চাপ, মদ্যপান-সিগারেটের নেশা এবং চিকিৎসকের কাছ থেকে দূরত্ব তাদের স্বাস্থ্যের উপর ভারী পড়ছে। এর ফলাফল হল - রক্তচাপ (BP), ডায়াবেটিস (শুগার) এবং HIV এর মতো রোগের সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, যাতে বলা হয়েছে যে বিশ্বজুড়ে পুরুষরা এই রোগের বেশি শিকার হচ্ছে এবং মহিলাদের তুলনায় তাদের মৃত্যুর হারও বেশি।
প্রতিবেদনে কী উঠে এসেছে?
সম্প্রতি PLOS মেডিসিন নামক একটি মেডিকেল রিপোর্টে বলা হয়েছে যে বিশ্বের প্রায় ২০০টি দেশে পরিচালিত গবেষণার মতে উচ্চ রক্তচাপ (BP), ডায়াবেটিস (শুগার) এবং HIV এর মতো রোগের ঘটনা মহিলাদের তুলনায় পুরুষদের মধ্যে বেশি দেখা গেছে। এই রোগগুলি গুরুতর এবং যদি সময়মতো মনোযোগ না দেওয়া হয় তবে প্রাণঘাতীও হতে পারে।
প্রতিবেদনে আরও দেখা গেছে যে ১৩১টি দেশে HIV/AIDS-এর কারণে মৃত পুরুষের সংখ্যা মহিলাদের চেয়ে বেশি। একইভাবে, ১০৭টি দেশে উচ্চ রক্তচাপ এবং ১০০টি দেশে ডায়াবেটিসে মৃত্যুবরণকারীদের মধ্যেও পুরুষের সংখ্যা বেশি পাওয়া গেছে। এর অর্থ হল পুরুষরা এই রোগের বেশি শিকার হচ্ছে এবং সঠিক সময়ে চিকিৎসা না নেওয়ার ফলে তাদের মৃত্যুর হারও বেশি।
পুরুষদের মধ্যে কেন রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিসের মতো রোগ বেড়ে উঠছে?
আজকের সময়ে পুরুষদের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ (BP) এবং ডায়াবেটিসের মতো রোগ দ্রুত বেড়ে উঠছে। এর পিছনে কিছু সাধারণ কিন্তু গুরুতর অভ্যাস এবং অবহেলা দায়ী।
- চিকিৎসকের কাছে দেরিতে যাওয়া: প্রায়শই পুরুষরা তাদের স্বাস্থ্য নিয়ে অবহেলা করে। রোগটি যতক্ষণ না গুরুতর হচ্ছে, ততক্ষণ তারা চিকিৎসকের কাছে যায় না। ছোটখাটো সমস্যাগুলিকে উপেক্ষা করা তাদের স্বাস্থ্যকে ধীরে ধীরে দুর্বল করে তোলে।
- ধূমপান এবং মদ্যপানের নেশা: মানসিক চাপ বা ক্লান্তি থেকে বাঁচার জন্য অনেক পুরুষ সিগারেট এবং মদ্যপানের আশ্রয় নেয়। কিন্তু এই অভ্যাসগুলি ধীরে ধীরে তাদের হৃদয়, লিভার এবং রক্তের শর্করার মাত্রার উপর খারাপ প্রভাব ফেলে। দীর্ঘদিন ধরে এর ব্যবহার রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিসের কারণ হতে পারে।
- ক্রমাগত মানসিক চাপে থাকা: অফিসের চাপ, পারিবারিক দায়িত্ব এবং ভবিষ্যতের চিন্তা - এগুলি মিলে পুরুষদের মানসিকভাবে ক্লান্ত করে তোলে। যখন মস্তিষ্কে চাপ থাকে, তখন শরীরের উপরও প্রভাব পড়ে। এই চাপ ধীরে ধীরে রক্তচাপ এবং শুগার বাড়ায়।
- শারীরিক পরিশ্রমের অভাব: আজকালের জীবনধারায় মানুষ দিনভর বসে বসে কাজ করে। হাঁটা, ব্যায়াম বা যোগের মতো কাজের জন্য সময় বের করে না। এর ফলে শরীরে চর্বি বেড়ে যায় এবং রক্ত সঞ্চালন খারাপ হয়, যা অনেক রোগের কারণ হয়।
খারাপ খাদ্যাভ্যাস এবং অভ্যাস - রোগের কারণ
আজকাল বেশিরভাগ মানুষ বাইরের খাবার, জাঙ্ক ফুড এবং প্যাকেটজাত খাবার বেশি খায়, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক। এই খাবারগুলি চিনি, চর্বি এবং লবণে ভরা থাকে, যা শরীরে ধীরে ধীরে জমে থাকে। এর ফলে রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিসের মতো রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। বিশেষ করে অতিরিক্ত চিনির পানীয় যেমন কোল্ড ড্রিঙ্কস এবং সফট ড্রিঙ্কসের ফলে শুগারের মাত্রা অনেক বেড়ে যায়, যা শরীরের জন্য ক্ষতিকারক।
এছাড়াও, যদি আপনি দেরিতে খাবার খান, পর্যাপ্ত ঘুম না পান বা ক্ষুধা ছাড়াই খাবার খান, তাহলে এটি আপনার শরীরের মেটাবলিজমকে নষ্ট করে দেয়। এর ফলে শরীরের প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াও প্রভাবিত হয় এবং ধীরে ধীরে এই অভ্যাসগুলি রোগের মূল কারণ হয়ে ওঠে।
রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিস থেকে কীভাবে রক্ষা পাবেন?
আজকের যুগে উচ্চ রক্তচাপ (BP) এবং ডায়াবেটিস (শুগার) সাধারণ রোগ হয়ে উঠেছে। কিন্তু যদি আমরা আমাদের কিছু অভ্যাসে পরিবর্তন করি, তাহলে এগুলি থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।
সময়মতো পরীক্ষা এবং চিকিৎসা করান
অনেক লোক মনে করে যে যতক্ষণ না কোনও সমস্যা হয়, ততক্ষণ চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু এটাই অবহেলা বড় রোগের কারণ হয়ে ওঠে। বিশেষ করে রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিসের মতো রোগ ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে এবং প্রাথমিক পর্যায়ে কোনও বিশেষ লক্ষণ দেখা দেয় না।
যদি আপনার বয়স ৩০ বছরের বেশি হয়, তাহলে প্রতি ৬ মাস অন্তর রক্তচাপ, শুগার এবং কোলেস্টেরলের পরীক্ষা অবশ্যই করান। এবং যদি আপনার পরিবারে কারও এই রোগ হয়, তাহলে আপনাকে আরও বেশি সাবধান থাকার প্রয়োজন।
চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সময়মতো সেবন করা এবং খাদ্যাভ্যাসে উন্নতি করা অত্যন্ত জরুরী। এই ছোট ছোট সতর্কতার মাধ্যমে আপনি বড় রোগ থেকে বাঁচতে পারবেন এবং একটি সুস্থ জীবনযাপন করতে পারবেন।
সুস্থ জীবনযাপন গ্রহণ করুন - সুস্থ থাকার সহজ উপায়
আজকের ব্যস্ত জীবনে স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখা অত্যন্ত জরুরী হয়ে উঠেছে। সুস্থ জীবনযাপন অর্থাৎ সুস্থ অভ্যাসই আপনাকে রোগ থেকে দূরে রাখতে পারে। এর জন্য খুব বড় বড় জিনিস করার প্রয়োজন নেই, শুধু কিছু সহজ পরিবর্তন যথেষ্ট।
প্রতিদিন সকালে বা সন্ধ্যায় অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটুন। যদি সম্ভব হয় তাহলে হালকা ব্যায়াম বা যোগ করুন। এর ফলে শরীর সক্রিয় থাকে এবং রক্ত সঞ্চালনও ঠিক থাকে।
খাওয়া-দাওয়ার অভ্যাসেও উন্নতি করুন। বাইরের তলা-ভাজা, জাঙ্ক ফুড, অতিরিক্ত মিষ্টি এবং প্রসেস করা জিনিসপত্র খাওয়া থেকে বিরত থাকুন। চেষ্টা করুন যতটা সম্ভব ঘরে তৈরি তাজা এবং হালকা খাবার খান।
এছাড়াও, দিনভর ৭-৮ গ্লাস পানি অবশ্যই পান করুন এবং রাতে পর্যাপ্ত ঘুম নিন। এই ছোট ছোট অভ্যাস মিলেমিশে আপনাকে রক্তচাপ, ডায়াবেটিসের মতো বড় রোগ থেকে রক্ষা করতে পারে।
মানসিক চাপ থেকে দূরে থাকুন
আজকালের দ্রুতগতির জীবনে মানসিক চাপ বা স্ট্রেস সাধারণ ঘটনা হয়ে উঠেছে। কিন্তু কি আপনি জানেন যে এই চাপই উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিসের মতো রোগের একটি বড় কারণ? যখন আমরা ক্রমাগত চিন্তায় থাকি, তখন আমাদের শরীরে কিছু এমন হরমোন তৈরি হতে থাকে যা স্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
চাপ কম করার জন্য সবচেয়ে জরুরী হল - নিজেকে সময় দেওয়া। প্রতিদিন অন্তত ১৫ থেকে ৩০ মিনিট নিজের জন্য বের করুন। এই সময়ে আপনি এমন কিছু করুন যা আপনাকে আনন্দ দেয় - যেমন সঙ্গীত শোনা, বই পড়া, বাগান করা বা যোগ করা।
যদি চাপ খুব বেশি হয় এবং আপনার ঘুম না আসে বা বারবার चिड़चिड़ापन হয়, তাহলে কোনও ভালো চিকিৎসক বা কাউন্সেলরের সাথে কথা অবশ্যই বলুন। এতে লজ্জা বা ভয় পাওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই।
ধূমপান এবং মদ্যপান ত্যাগ করুন - স্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ
সিগারেট পান করা এবং মদ্যপান করা আজকের সময়ে অনেকের অভ্যাস হয়ে উঠেছে, কিন্তু এই অভ্যাসগুলি ধীরে ধীরে শরীরকে ভেতর থেকে দুর্বল করে তোলে। বিশেষ করে পুরুষদের মধ্যে এই নেশা উচ্চ রক্তচাপ (BP) এবং ডায়াবেটিসের মতো রোগকে আরও বেশি বাড়িয়ে তোলে।
যখন আপনি ধূমপান করেন বা মদ্যপান করেন, তখন এর ফলে হৃদয়, লিভার এবং কিডনির উপর খারাপ প্রভাব পড়ে। এই অভ্যাসগুলির ফলে শরীরের রক্তচাপ অসমতুলিত হয়ে যায় এবং রক্তের শর্করাও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। ধীরে ধীরে এই রোগগুলি গুরুতর আকার ধারণ করে।
যদি আপনার এই অভ্যাসগুলি ত্যাগ করতে অসুবিধা হয়, তাহলে কোনও চিকিৎসক বা কাউন্সেলরের সাথে কথা বলুন। শুরুতে ধীরে ধীরে পরিমাণ কমিয়ে আনুন এবং তারপর সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দিন। এটি আপনার এবং আপনার পরিবারের জন্য উপকারী হবে।
```