প্রতি বছর ১ মে বিশ্বজুড়ে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস বা লেবার ডে (Labour Day) পালিত হয়। এই দিনটি সেসব মানুষকে উৎসর্গ করা হয় যারা তাদের পরিশ্রম ও ঘামের মাধ্যমে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যায় — চাই তা কারখানায় কাজ করা শ্রমিক হোক, ক্ষেতে পরিশ্রম করা কৃষক হোক, স্বাস্থ্যকর্মী হোক অথবা নির্মাণ ক্ষেত্রে কাজ করা শ্রমিক হোক।
১ মে ২০২৫-এও বিশ্বের অনেক দেশে এই দিনটি শ্রদ্ধা ও সম্মানের সাথে পালিত হচ্ছে। এই দিনটির উদ্দেশ্য হলো শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা করা এবং তাদের সম্মান প্রদান করা।
শ্রমিক দিবস কেন পালিত হয়?
শ্রমিক দিবস প্রতি বছর ১ মে পালিত হয়, কিন্তু আপনি কি জানেন এর সূচনা কীভাবে এবং কেন হয়েছিল? এই দিনটির ইতিহাস ১৮৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরের সাথে জড়িত। সেই সময় শ্রমিকদের দিনে ১০ থেকে ১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত ক্রমাগত কাজ করানো হতো। তাদের যথাযথভাবে বিশ্রাম নেওয়ার সময় মিলতো না, বেতন ছিল খুব কম, এবং কাজের স্থানও ছিল নিরাপদ নয়। এতে বিরক্ত হয়ে শ্রমিকরা একটি আন্দোলন শুরু করে, যেখানে তারা ‘৮ ঘণ্টা কাজ, ৮ ঘণ্টা বিশ্রাম এবং ৮ ঘণ্টা নিজের জন্য’ এর দাবি জানায়।
এই আন্দোলনের সময় শিকাগোতে হেমার্কেট নামক স্থানে একটি বড় প্রতিবাদ হয়, যেখানে অনেক শ্রমিকের প্রাণহানি ঘটে। যদিও আন্দোলনকারীদের সেই সময় প্রচুর মূল্য দিতে হয়েছিল, কিন্তু তাদের ত্যাগ ব্যর্থ হয়নি। তাদের প্রচেষ্টার ফলে শ্রমিকদের জন্য কাজের সময় কমে যায় এবং ধীরে ধীরে তাদের অধিকার আইনগতভাবে স্বীকৃতি পেতে শুরু করে।
এই একই সংগ্রামের স্মৃতিতে প্রতি বছর ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস পালিত হয়। এই দিনটি আমাদের শিক্ষা দেয় যে সমাজে প্রতিটি কাজ করা মানুষের গুরুত্ব আছে, এবং সকলকে সম্মান, সুরক্ষা এবং সমতা পাওয়া উচিত।
ভারতে শ্রমিক দিবসের সূচনা
ভারতে শ্রমিক দিবস প্রথম ১ মে ১৯২৩ সালে পালিত হয়েছিল। এর সূচনা চেন্নাই (সেই সময় মাদ্রাজ) এ হয়েছিল, যেখানে সিঙ্গারভেলু চেট্টিয়ার নামক একজন সমাজকর্মী ও নেতা শ্রমিকদের অধিকারের জন্য কথা বলেছিলেন। তিনি দেখেছিলেন যে শ্রমিকদের দীর্ঘ সময় কাজ করানো হচ্ছে কিন্তু তাদের যথাযথ বেতনও পাচ্ছে না এবং ভালো সুযোগ-সুবিধাও পাচ্ছে না। এই কারণে তিনি শ্রমিকদের একত্রিত করে ১ মে-কে একটি বিশেষ দিন হিসেবে পালনের উদ্যোগ নেন।
এই উদ্যোগের সাথে সাথে ভারতেও শ্রমিক দিবস স্বীকৃতি পায় এবং প্রতি বছর এই দিনটি পরিশ্রমী মানুষদের সম্মান জানানোর জন্য পালিত হতে থাকে। তখন থেকে আজ পর্যন্ত ১ মে পুরো দেশে শ্রমিকদের পরিশ্রম, অধিকার এবং অবদান স্মরণ করা হয়। এই দিনটি আমাদের শিক্ষা দেয় যে প্রতিটি শ্রমিক সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং তাকে সম্মান পাওয়া উচিত।
শ্রমিকদের সমাজে অবদান
আমাদের সমাজের প্রকৃত শক্তি হল সেইসব মানুষ যারা প্রতিদিন পরিশ্রম করে—যেমন কৃষক, নির্মাণ শ্রমিক, কারখানার কর্মী, স্বাস্থ্যকর্মী এবং আরও অনেক শ্রমিক। যদি কৃষকরা ক্ষেতে শস্য উৎপাদন না করে, শ্রমিকরা রাস্তা, সেতু বা বাড়িঘর নির্মাণ না করে এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা শহর পরিষ্কার না রাখে, তাহলে আমাদের জীবন কঠিন হয়ে পড়বে। এই সকল মানুষ এমন কাজ করে যা সাধারণত দেখা যায় না, কিন্তু আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
শ্রমিকরা সমাজের ভিত্তি। তারা অক্লান্তভাবে, অবিরামভাবে তাদের কাজ করে যাতে অন্যরা আরামে জীবনযাপন করতে পারে। চাই তা রোদ হোক বা বৃষ্টি, দিন হোক বা রাত — এই মানুষেরা সবসময় কাজে ব্যস্ত থাকে। দেশের উন্নতি তাদেরই পরিশ্রমের ফলে হয়। আমাদের শ্রমিকদের সম্মান করতে হবে, তাদের অধিকার রক্ষা করতে হবে এবং তাদের উন্নত জীবন দানের জন্য সবসময় পাশে থাকতে হবে। এটাই প্রকৃত সমাজিক ঐক্য ও মানবতাবাদ।
শ্রমিক দিবসের উদ্দেশ্য
শ্রমিক দিবস কেবলমাত্র ছুটির দিন নয়, বরং এর প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো পরিশ্রমী মানুষদের তাদের অধিকার ও সম্মান প্রদান করা। এই দিনটি পালনের অর্থ হলো আমরা শ্রমিকদের পরিশ্রমকে স্বীকৃতি দিই এবং তাদের জীবনকে উন্নত করার জন্য কাজ করি। অনেক শ্রমিক আজও এমন আছেন যারা সময়মতো বেতন পান না, তাদের নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বেশি কাজ করানো হয়, এবং তাদের কাছে যথাযথ থাকার, খাওয়ার বা চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধাও নেই। কিছু কিছুকে তো তাদের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে বিপদজনক কাজ করতে হয়।
শ্রমিক দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে সকল শ্রমিকের নিরাপদ কাজের পরিবেশ পাওয়া উচিত, তাদের পূর্ণ বেতন পাওয়া উচিত, এবং তাদের সাথে কোন ধরনের শোষণ করা উচিত নয়। প্রতিটি শ্রমিকের সমতা, সম্মান এবং মানুষের মতো জীবনযাপনের অধিকার আছে। এই দিনে আমাদের সকলকে একত্রে এই প্রতিজ্ঞা নিতে হবে যে আমরা শ্রমিকদের কণ্ঠস্বর হব এবং তাদের অধিকারের জন্য দাঁড়াব।
শ্রমিক দিবস কীভাবে পালন করবেন?
১ মে শ্রমিক দিবস হিসেবে পালিত হয়, যা সেসব পরিশ্রমী মানুষদের সম্মান জানানোর দিন যারা তাদের পরিশ্রমের মাধ্যমে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যায়। এই দিনটিকে বিশেষ ও স্মরণীয় করে তোলার জন্য আমরা কিছু সহজ কিন্তু কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারি।
আপনি আপনার অফিস, দোকান, কারখানা বা কোনও প্রতিষ্ঠানে কাজ করা শ্রমিক ও কর্মচারীদের জন্য একটি ছোট্ট সম্মানসূচক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারেন। তাদের এক দিনের ছুটি, ভালো খাবার বা কোনও ছোট উপহার দিয়ে তাদের পরিশ্রমের সম্মান করুন।
স্কুল ও কলেজগুলিতে শিশুদের শ্রমিকদের অবদান সম্পর্কে বলুন যাতে তাদের মধ্যেও সম্মানের भावना विकसित হয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় শ্রমিকদের অধিকার, সংগ্রাম এবং সাফল্য সম্পর্কিত তথ্য শেয়ার করুন। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো শ্রমিকদের সাথে কথা বলুন, তাদের সমস্যা শুনুন এবং সমাধান করার চেষ্টা করুন। এটাই এই দিনটির প্রকৃত भावना — ঐক্য ও সম্মান।