ভারত একটি এমন দেশ যেখানে আস্থা শুধুমাত্র অনুভূতি নয়, বরং একটি জীবন্ত ঐতিহ্য। এখানে প্রতিটি কোণে কোনও না কোনও মন্দির আছে, যেখানে ভক্তরা তাদের বিশ্বাসের সাথে অর্ঘ্য নিবেদন করেন। এই অর্ঘ্য শুধুমাত্র ভক্তির প্রতীক নয়, বরং অনেক মন্দিরকে দেশের সবচেয়ে ধনী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যেও অন্তর্ভুক্ত করে। কিছু মন্দিরের সম্পত্তি এবং বার্ষিক আয় এত বেশি যে তা কোনও বৃহৎ কর্পোরেট ঘরানাকেও পিছনে ফেলে দিতে পারে। এই প্রতিবেদনে আমরা ভারতের পাঁচটি সবচেয়ে ধনী মন্দির সম্পর্কে জানব, যা শুধুমাত্র আস্থার কেন্দ্র নয়, বরং অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও অত্যন্ত সমৃদ্ধ।
১. পদ্মনাভস্বামী মন্দির, কেরল – রহস্য ও ভব্যতার অনন্য সংমিশ্রণ
কেরলের তিরুবনন্তপুরমে অবস্থিত শ্রী পদ্মনাভস্বামী মন্দির বিশ্বের সবচেয়ে ধনী মন্দির বলে মনে করা হয়। এটি ভগবান বিষ্ণুর ‘পদ্মনাভ’ রূপকে উৎসর্গীকৃত। এই মন্দিরের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল এর ভূগর্ভস্থ কক্ষ, যেখান থেকে অর্ব কোটি টাকার সম্পত্তি পাওয়া গেছে।
- মোট সম্পত্তির অনুমান: ১.২ লক্ষ কোটি টাকা বা তার বেশি
- বৈশিষ্ট্য: মন্দিরের ছয়টি ভূগর্ভস্থ কক্ষের মধ্যে পাঁচটি খোলা হয়েছে, যেখান থেকে টন টন সোনা, হীরা, রত্ন, অমূল্য মূর্তি, স্বর্ণালঙ্কার এবং বিরল বস্তু পাওয়া গেছে।
- বিবাদ ও রহস্য: ‘ভল্ট বি’ নামক একটি ভূগর্ভস্থ কক্ষ এখনও খোলা হয়নি, যার সাথে ধর্মীয় ও তান্ত্রিক বিশ্বাস জড়িত।
এই মন্দির এখনও রাজপরিবারের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এবং এর সুরক্ষা ভারতীয় সেনা ও বিশেষ সুরক্ষা বাহিনীর দ্বারা করা হয়।
২. তিরুপতি বালাজী মন্দির, অন্ধ্রপ্রদেশ – শ্রদ্ধার আদর্শ, সমর্পণের গাথা
তিরুমালা তিরুপতি বেঙ্কটেশ্বর মন্দির, অন্ধ্রপ্রদেশের চিত্তুর জেলায় অবস্থিত। ভগবান বিষ্ণুর বেঙ্কটেশ্বর রূপকে উৎসর্গীকৃত এই মন্দির ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং ধনী মন্দিরগুলির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত।
- বার্ষিক আয়: ১,৫০০ কোটি টাকা বা তার বেশি
- মোট সম্পত্তি: ২.৫ লক্ষ কোটি টাকা (জমি, নগদ, আলঙ্কার সহ)
- বিশেষ অর্ঘ্য: সোনা, নগদ, আলঙ্কার এবং এমনকি কেশদানও হয়।
এখানে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ ভক্ত দর্শন করেন। মন্দির ট্রাস্ট সামাজিক ক্ষেত্রেও অগ্রণী — হাসপাতাল, স্কুল, ধর্মশালা এবং অন্নদানের মতো সেবা পরিচালনা করে।
৩. স্বর্ণ মন্দির (হরিমন্দির সাহেব), পাঞ্জাব – সেবা, শ্রদ্ধা ও সমর্পণের প্রতীক
অমৃতসরে অবস্থিত স্বর্ণ মন্দির, যাকে শিখ ধর্মের পবিত্রতম স্থল হরিমন্দির সাহেব নামেও পরিচিত, তার নির্মল সেবা ঐতিহ্য, ভব্য স্থাপত্য এবং ভক্তদের নিঃস্বার্থ সেবার জন্য বিখ্যাত।
- বার্ষিক আয়: প্রায় ৫০০ কোটি টাকা
- বৈশিষ্ট্য: এর উপরিভাগ বিশুদ্ধ সোনার মোড়ানো।
- লঙ্গর সেবা: প্রতিদিন প্রায় ১ লক্ষ মানুষকে বিনামূল্যে খাবার দেওয়া হয়।
স্বর্ণ মন্দিরের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল এখানে কোনও বৈষম্য হয় না — ধর্ম, জাতি, বর্ণ বা শ্রেণীর বাইরে সকলকে সমানভাবে সেবা ও সম্মান করা হয়।
৪. বৈষ্ণো দেবী মন্দির, জম্মু-কাশ্মীর – আস্থার আরোহণ, শ্রদ্ধার উচ্চতা
ত্রিকুটা পর্বতের উচ্চতায় অবস্থিত মাতা বৈষ্ণো দেবী মন্দির ভারতের সবচেয়ে বিখ্যাত শক্তিপীঠগুলির মধ্যে একটি। এখানে আসার জন্য ভক্তদের ১২ কিলোমিটারের কঠিন আরোহণ করতে হয়, যা তারা সম্পূর্ণ শ্রদ্ধার সাথে সম্পন্ন করেন।
- বার্ষিক আয়: ৫০০ কোটি টাকা বা তার বেশি
- মোট সম্পত্তি: প্রায় ৫০০ কোটি টাকা
- বার্ষিক ভক্ত সংখ্যা: প্রায় ১ কোটি বা তার বেশি
মন্দির ট্রাস্ট দ্বারা অর্জিত অর্থ ধর্মীয় হাসপাতাল, ট্রমা সেন্টার, পানির সরবরাহ, লঙ্গর সেবা এবং তীর্থযাত্রীদের সুবিধা বৃদ্ধিতে ব্যবহার করা হয়।
৫. শিরডি সাই বাবা মন্দির, মহারাষ্ট্র – শ্রদ্ধা ও ধৈর্য্যের অনন্য স্থান
শিরডি সাই বাবা মন্দির, মহারাষ্ট্রের আহমদনগর জেলায় অবস্থিত। এই মন্দির সকল ধর্মের মানুষের আস্থার কেন্দ্র এবং সন্ত সাই বাবাকে উৎসর্গীকৃত, যিনি মানবতা, সত্যতা এবং সেবার বার্তা দিয়েছিলেন।
- বার্ষিক আয়: ৪০০ কোটি টাকা বা তার বেশি
- মোট সম্পত্তি: ১,৮০০ কোটি টাকা বা তার বেশি
- দান রূপে: নগদ, সোনা, রুপো, আলঙ্কার এবং জমি
শিরডি ট্রাস্ট দেশের সবচেয়ে সংগঠিত মন্দির ট্রাস্টগুলির মধ্যে একটি, যা ধর্মীয় হাসপাতাল, স্কুল, ভোজনালয় এবং অগণিত জনকল্যাণ পরিকল্পনা পরিচালনা করে।
ভারতের এই মন্দিরগুলি শুধুমাত্র ধর্মীয় স্থান নয়, বরং সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। যেখানে একদিকে ভক্তরা তাদের শ্রদ্ধা থেকে কোটি কোটি টাকা দান করেন, অন্যদিকে এই মন্দিরগুলির ট্রাস্ট সামাজিক সেবায়ও আদর্শ উপস্থাপন করে। শিক্ষা, চিকিৎসা, দারিদ্র্য নিরসন এবং পরিবেশ সংরক্ষণের মতো ক্ষেত্রে এই মন্দিরগুলির অবদান প্রশংসনীয়।