২০২৫ সালের নির্জলা একাদশী: ব্রতবিধি, গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতা

🎧 Listen in Audio
0:00

নির্জলা একাদশী হিন্দু ধর্মে এক অত্যন্ত পুণ্যময় এবং কঠিন ব্রত হিসেবে পরিচিত, যা ২০২৫ সালের ১৮ জুন পালিত হবে। এই একাদশী জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্ল পক্ষে পড়ে এবং এর নিয়ম হলো পুরো দিন জল গ্রহণ না করে উপবাস করা। বিশ্বাস করা হয় যে, এই ব্রত একাধিক বছরের সকল একাদশীর ফল প্রদান করে। এই প্রবন্ধে আমরা নির্জলা একাদশীর পৌরাণিক কথা, ব্রতবিধি, ধর্মীয় ও বৈজ্ঞানিক গুরুত্ব, আধুনিক জীবনে এর প্রাসঙ্গিকতা এবং কিভাবে এই উপবাস থেকে আত্মিক উন্নতি লাভ করা যায় সে সম্পর্কে জানবো।

নির্জলা একাদশীর পরিচয়

নির্জলা একাদশীকে সকল একাদশীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং সবচেয়ে কঠিন বলে মনে করা হয়। এই উপবাস জল গ্রহণ না করে রাখা হয়, তাই একে ‘নির্জলা’ বলা হয়। একে ভীম একাদশীও বলা হয় কারণ পৌরাণিক বিশ্বাস অনুযায়ী পান্ডবদের মধ্যে ভীম প্রথম এই উপবাস পালন করেছিলেন।

নির্জলা একাদশী ব্রত পালন করলে সকল পাপ ধ্বংস হয় এবং ব্যক্তি মোক্ষ লাভ করে। এই ব্রত কেবলমাত্র আত্মশুদ্ধিই নয়, বরং আত্মসংযম এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির পথও।

পৌরাণিক কথা: ভীমসেন এবং মহর্ষি ব্যাসের সংলাপ

মহাভারত কালের কথানুযায়ী, পান্ডবদের মধ্যে ভীম বলশালী ছিলেন, কিন্তু খাবার ছাড়া একদিনও থাকতে পারতেন না। তাঁর চার ভাই – যুধিষ্ঠির, অর্জুন, নকুল এবং সহদেব – শ্রদ্ধাপূর্বক সকল একাদশী ব্রত পালন করতেন।

ভীম একদিন মহর্ষি ব্যাসকে জিজ্ঞাসা করলেন যে, কি কোনো উপায় আছে যার দ্বারা তিনি বছরের সকল একাদশীর ফল একসাথে পেতে পারেন? তখন ব্যাসদেব তাঁকে নির্জলা একাদশী ব্রত পালনের পরামর্শ দিলেন, যেখানে একদিনের জন্য জল পর্যন্ত গ্রহণ করা যায় না।

ভীম সাহসের সাথে এই ব্রত পালন করেন এবং তখন থেকেই একে ‘ভীম একাদশী’ও বলা হয়। এই একাদশী আত্মসংযম এবং ভগবান বিষ্ণুর প্রতি সমর্পণের প্রতীক হিসেবে ধরা হয়।

ব্রতবিধি: কিভাবে নির্জলা একাদশী পালন করবেন

নির্জলা একাদশী ব্রত কঠিন অবশ্যই, কিন্তু এর বিধি শ্রদ্ধা এবং আস্থার সাথে পালন করলে সহজ মনে হয়। এই দিন সূর্যোদয়ের পূর্বে উঠে পবিত্র স্নান করে ব্রতের সংকল্প করুন।

ব্রত পালনের বিধি

সংকল্প করার পর পুরো দিন জল ও খাবার গ্রহণ করবেন না।

পুরো দিন ভগবান বিষ্ণুর পূজা করুন।

শ্রী বিষ্ণুসহস্রনাম, গীতা পাঠ, অথবা "ॐ नमो भगवते वासुदेवाय" মন্ত্র জপ করুন।

রাতেও ব্রত চালু রাখুন (জাগ্রত থাকলে অধিক পুণ্য হয় বলে মনে করা হয়)।

পরের দিন দ্বাদশী তিথিতে সূর্যোদয়ের পর ব্রত ভঙ্গ করুন এবং জল গ্রহণ করুন।

যদি স্বাস্থ্যগত কারণে কেউ নির্জল ব্রত করতে না পারে, তাহলে ফলাহার অথবা কেবল জলের সাথে ব্রত করতে পারে, কিন্তু তা একই শ্রদ্ধার সাথে করতে হবে।

নির্জলা একাদশীর ধর্মীয় গুরুত্ব

হিন্দু ধর্মে একাদশীর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। পুরাণ অনুযায়ী, একাদশী ব্রত পালন করলে মানুষের সকল পাপ ধ্বংস হয় এবং সে ভগবান বিষ্ণুর কৃপা লাভ করে। কিন্তু নির্জলা একাদশী অন্যান্য একাদশী থেকে আলাদা।

এই ব্রতের প্রধান লাভ

সারা বছরের সকল একাদশীর পুণ্যফল একাধিকে পাওয়া যায়।

পাপের ক্ষয় হয় এবং মৃত্যুর পর মোক্ষ লাভ হয়।

মানসিক ও আত্মিক শুদ্ধি হয়।

রোগ, ভয় এবং ক্লেশ থেকে মুক্তি মেলে।

এই দিন করা দান-পুণ্যেরও বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। জল, অন্ন, বস্ত্র এবং ছাতার দান করলে ব্যক্তি অপার পুণ্য লাভ করে।

বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে নির্জলা ব্রত

এই ব্রত যেখানে ধর্মীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়, সেখানে এর পিছনে বৈজ্ঞানিক কারণও লুকিয়ে আছে। উপবাস করলে শরীরে জমে থাকা ক্ষতিকারক উপাদান বের হয়ে যায় এবং পাচনতন্ত্র বিশ্রাম পায়, যার ফলে স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়।

নির্জলা উপবাসের লাভ

শরীরের জল-নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা (hydration mechanism) শক্তিশালী হয়।

আত্মসংযমের ক্ষমতা বিকশিত হয়।

মানসিক একাগ্রতা বৃদ্ধি পায়।

দিনভর সংযম ও ধ্যানে থাকার ফলে মানসিক শান্তি মেলে।

তবে, এই ব্রত শারীরিকভাবে দুর্বল, অসুস্থ, বৃদ্ধ বা গর্ভবতী মহিলাদের জন্য উপযুক্ত নয়। এই ধরণের ব্যক্তিদের চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া উপবাস করা উচিত নয়।

নির্জলা একাদশী সংক্রান্ত বিশেষ বিশ্বাস

বিশ্বাস করা হয় যে, এই দিন ব্রত পালনকারী ব্যক্তি পরবর্তী জন্মেও উত্তম জীবন লাভ করে।

গঙ্গাস্নান, তীর্থযাত্রা এবং দরিদ্রদের জল দান করলে পুণ্য অনেক গুণ বেড়ে যায়।

Leave a comment