মহাভারত কেবলমাত্র একটি যুদ্ধের কাহিনী নয়, বরং এটি এমন একটি গ্রন্থ যেখান থেকে আমরা জীবনের অনেক শিক্ষা পাই। একদিকে এতে শুভ ও অশুভের সংগ্রাম দেখা যায়, অন্যদিকে দয়া, দান, নীতি ও মানবতার মতো অমূল্য গুণাবলীও বিদ্যমান। মহাভারতের প্রতিটি ঘটনার পিছনেই লুকিয়ে আছে কোনো না কোনো গভীর তাৎপর্য।
আজ আমরা আপনাদের এমন একজন প্রকৃত দানবীরের কাহিনী বলবো, যিনি মৃত্যুর সময় পর্যন্ত দান করা বন্ধ করেননি। সেই মহান ব্যক্তির নাম কর্ণ। কর্ণের দানবীরতার কাহিনী এতটাই অদ্বিতীয় যে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজের চোখে দেখেও বিস্মিত হয়েছিলেন।
কর্ণ – একজন অসাধারণ যোদ্ধা ও মহাদানবীর
কর্ণ মহাভারতের এমন এক চরিত্র, যিনি সর্বদা আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন। তিনি সূর্যপুত্র ছিলেন, কিন্তু তার জীবন সংগ্রামে পরিপূর্ণ ছিল। সমাজ তাকে সূতপুত্র বলে অপমান করেছে, কিন্তু কর্ণ কখনো হার মানেননি। দুর্যোধন তাকে সম্মান ও মর্যাদা দিয়েছিলেন, তাই কর্ণ জীবনভর দুর্যোধনের বন্ধুত্ব পালন করেছেন, ধর্মের পথে হোক বা অধর্মের পথে।
কর্ণ কৌরবপক্ষে যুদ্ধ করেছিলেন, তবুও তার দানশীলতা, সততা ও নীতিবোধের জন্য তিনি সকলের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ থেকে শুরু করে অর্জুন পর্যন্ত সকলেই তার বীরত্ব ও দানবীরতার মুগ্ধ ছিলেন, যদিও তাদের পথ ভিন্ন ছিল।
যুদ্ধের সেই দিন যখন অর্জুনের সাথে মুখোমুখি হয়েছিলেন কর্ণ
মহাভারতের যুদ্ধে একদিন এমন সময় এসেছিল যখন কর্ণ ও অর্জুন মুখোমুখি হয়েছিলেন। উভয়েই মহান ধনুর্ধর ছিলেন এবং কাউকেই কম বলে মনে করা যায়নি। কিন্তু সেদিন যুদ্ধের ভাগ্য অর্জুনের পক্ষে ছিল। অর্জুন তার বাণে কর্ণকে মারাত্মকভাবে আহত করেছিলেন।
কর্ণ মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিলেন, তার অবস্থা গুরুতর ছিল। কিন্তু তবুও তিনি শান্ত ও ধৈর্যশীল ছিলেন। তখন শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের দিকে তাকিয়ে বললেন – ‘কর্ণকে তার বীরত্ব ও দানবীরতার জন্য যুগ যুগ ধরে স্মরণ করা হবে।’
এটা শুনে অর্জুন অবাক হয়ে গেলেন। তিনি প্রশ্ন করেছিলেন – ‘কর্ণ কিভাবে সর্বশ্রেষ্ঠ দানবীর হতে পারেন? তিনি তো অধর্মের পক্ষে যুদ্ধ করছিলেন।’
শ্রীকৃষ্ণ ব্রাহ্মণের বেশ ধারণ করেছিলেন
অর্জুনের সন্দেহ দূর করার জন্য শ্রীকৃষ্ণ একটি পরিকল্পনা করেছিলেন। তিনি ব্রাহ্মণের বেশ ধারণ করে আহত কর্ণের কাছে গেলেন। কর্ণ সেই সময়ও যন্ত্রণায় ছিলেন, কিন্তু একজন ব্রাহ্মণকে আসতে দেখে তিনি শ্রদ্ধার সাথে প্রণাম করেছিলেন।
ব্রাহ্মণ বললেন, ‘আমি আপনার কাছ থেকে কিছু দান চাইতে এসেছি, কিন্তু আপনার অবস্থা দেখে এখন কিছু চাওয়া উচিত নয়। আপনি তো মৃত্যুর কাছাকাছি, এমন অবস্থায় আপনি কি দিতে পারবেন?’
কর্ণ তার সোনার দাঁত ভেঙে দিয়েছিলেন
কর্ণ হেসে বললেন – ‘দানের অর্থ কেবল শারীরিক অবস্থা নয়, বরং মনের অনুভূতি। যদি আমার কাছে কিছু বাকি থাকে, তাহলেও আমি দান করবো।’
তারপর তিনি একটি পাথর তুলে, নিজের মুখ থেকে সোনার দাঁত ভেঙে সেই ব্রাহ্মণকে দান করে দিলেন। এটা দেখে সেখানে উপস্থিত সকলেই অবাক হয়ে গেলেন। যন্ত্রণার মধ্যেও কর্ণের দানশীলতায় কোনো ঘাটতি ছিল না।
শ্রীকৃষ্ণ দর্শন দিয়েছিলেন, কর্ণ বর পাওয়া করেছিলেন
কর্ণ যখন সোনার দাঁত ব্রাহ্মণকে দিলেন, তখন সেই ব্রাহ্মণ তার আসল রূপে প্রকাশিত হলেন। তিনি আর কেউ নন, নিজেই শ্রীকৃষ্ণ। শ্রীকৃষ্ণ বললেন – ‘হে কর্ণ! মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও তুমি তোমার দানশীলতা ছাড়োনি। তুমি সত্যিই সর্বশ্রেষ্ঠ দানবীর।’
শ্রীকৃষ্ণ কর্ণকে বর চাইতে বললেন। কর্ণ নম্রতার সাথে উত্তর দিলেন – ‘হে মধুসূদন! আমার শেষ ইচ্ছা হলো আপনি নিজেই আমার শেষকৃত্য সম্পন্ন করবেন এবং আমার মতো লোকদের কল্যাণ করবেন।’
এই কাহিনী থেকে আমরা কি শিক্ষা পাই?
এই কাহিনী আমাদের শিক্ষা দেয় যে, প্রকৃত মূল্য কোনো পক্ষ বা পরিস্থিতি দ্বারা নির্ধারিত হয় না, বরং ব্যক্তির কর্ম ও অনুভূতি দ্বারা নির্ধারিত হয়। কর্ণ অধর্মের পক্ষে যুদ্ধ করেছিলেন, কিন্তু তার ভেতরের মানবিক গুণাবলী – দয়া, দান, ত্যাগ – তাকে একজন মহান ব্যক্তি করে তুলেছে।
দানের প্রকৃত অর্থ হলো যা কর্ণ দেখিয়েছিলেন – কোনো প্রত্যাশা ছাড়াই, এমনকি যন্ত্রণার মধ্যেও অন্যদের দান করার भाव।