২০২৫ সালের নির্জলা একাদশী: পুণ্য, বিধি ও গুরুত্ব

🎧 Listen in Audio
0:00

নির্জলা একাদশী ব্রত পালন করলে ভক্তগণ সারা বছরের সকল একাদশীর সমপরিমাণ পুণ্য লাভ করেন, যার ফলে তাঁরা দীর্ঘায়ু এবং মোক্ষের আশীর্বাদ পান। এই ব্রত পাপমোচন এবং ভগবান বিষ্ণুর কৃপা লাভের পথ। সনাতন ধর্মে একাদশী ব্রতকে অত্যন্ত শুভ ও পুণ্যদায়ক বলে মনে করা হয়। সারা বছরে ২৪টি একাদশী আসে, কিন্তু জ্যৈষ্ঠ মাসে পড়া নির্জলা একাদশীর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।

এই ব্রত ভগবান বিষ্ণুকে উৎসর্গীকৃত এবং একে সবচেয়ে কঠিন একাদশীও বলা হয় কারণ এই দিনে জল পর্যন্ত গ্রহণ করা হয় না। ২০২৫ সালে নির্জলা একাদশী ৬ জুন, শুক্রবার পালিত হবে। এই দিনে অনেক শুভ যোগও হচ্ছে যা ব্রত পালনকারীদের বিশেষ ফল দেবে।

নির্জলা একাদশী ২০২৫: জেনে নিন কেন এই ব্রত সবচেয়ে বিশেষ

নির্জলা একাদশীর ব্রত প্রতি বছর জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্ল পক্ষের একাদশী তিথিতে রাখা হয়। ২০২৫ সালে এটি ৬ জুন, শুক্রবার পড়ছে। এই দিনে অন্ন ও জল ছাড়া ব্রত রাখা হয়, তাই একে ‘নির্জলা’ একাদশী বলা হয়। হিন্দু ধর্মে এই একাদশী অত্যন্ত পুণ্যদায়ক বলে মনে করা হয়। বিশ্বাস করা হয় যে, এই ব্রত পালন করলে সারা বছরের ২৪টি একাদশীর ফল পাওয়া যায়। যারা সারা বছরের সকল একাদশী পালন করতে পারেন না, তারা শুধুমাত্র এই ব্রত পালন করে সকলের পুণ্য লাভ করতে পারেন।

এই দিনে ভগবান বিষ্ণুর বিশেষ পূজা করা হয়। ব্রতীরা সকালে স্নান করে ভগবানকে তুলসী, হলুদ ফুল এবং ফল অর্পণ করেন। সন্ধ্যায় আরতি এবং ব্রতকথা শোনেন। পরের দিন পারণ করে ব্রত ভাঙা হয়। ২০২৫ সালে এই ব্রত আরও বিশেষ হবে কারণ এই দিনে শুভ যোগ হচ্ছে যেমন বরিয়ান যোগ এবং ভদ্রা, যার ফলে ব্রতের ফল বহুগুণ বৃদ্ধি পায়।

নির্জলা একাদশীতে হচ্ছে শুভ যোগ

এই বছর ৬ জুন ২০২৫ তারিখে নির্জলা একাদশীর দিনে অনেক শুভ যোগ হচ্ছে, যা এই ব্রতকে আরও ফলদায়ক করে তুলছে।

  • ভদ্রা যোগ: এই যোগ পাটাল লোকে থাকবে, যা শুভ বলে মনে করা হয়।
  • সময়: সকাল ৩:৩১ টা থেকে পরের দিন সকাল ৪:৪৭ টা পর্যন্ত।
  • বরিয়ান যোগ: এই যোগ ৬ জুন সকাল ১০:১৪ টা থেকে শুরু হবে এবং বিশেষ ফলদায়ক হবে।

এই শুভ যোগে ব্রত ও ভগবান বিষ্ণুর পূজা করলে ব্যক্তি বহুগুণ পুণ্য লাভ করে। মনে করা হয় যে, এই দিনের ব্রত রাখলে সারা বছরের ২৪টি একাদশীর সমান ফল পাওয়া যায় এবং সকল মনোকামনা পূর্ণ হয়।

নির্জলা একাদশীর ধর্মীয় গুরুত্ব

নির্জলা একাদশী হিন্দু ধর্মে অত্যন্ত পবিত্র ও পুণ্যদায়ক তিথি বলে মনে করা হয়। এই ব্রত বিশেষ করে ভগবান বিষ্ণুকে উৎসর্গীকৃত। এই দিন ব্রতী অন্ন ও জল ছাড়া উপবাস পালন করে, এই কারণেই একে ‘নির্জলা’ একাদশী বলা হয়। বিশ্বাস করা হয় যে, এই ব্রত পুরোপুরি আন্তরিকতা দিয়ে পালন করলে ব্যক্তি সারা বছরের ২৪টি একাদশীর সমান পুণ্য লাভ করে।

পুরাণ অনুসারে, এই দিন ভগবান বিষ্ণু ও মা লক্ষ্মীর পূজা করলে ব্যক্তির জীবনে সুখ-সমৃদ্ধি আসে এবং তার সকল পাপ ধ্বংস হয়। এই ব্রত পালনকারী ব্যক্তি মৃত্যুর পর যমরাজের ন্যায়বিচার থেকে মুক্তি পায় এবং সরাসরি ভগবান বিষ্ণুর ধাম বৈকুণ্ঠে স্থান পায়। পাশাপাশি, এই ব্রত দীর্ঘায়ু এবং মোক্ষ লাভের পথ প্রশস্ত করে। তাই একে আত্মিক শুদ্ধি ও মোক্ষ লাভের জন্য অত্যন্ত ফলদায়ক বলে মনে করা হয়।

ব্রতের বিধি এবং এই দিন কি করবেন

হিন্দু ধর্মে ব্রত রাখা একটি ধর্মীয় ও আত্মিক শুদ্ধির উপায় বলে মনে করা হয়। বিশেষ করে যদি আপনি ভগবান বিষ্ণুর জন্য ব্রত করছেন, তাহলে কিছু বিশেষ নিয়ম ও বিধি মেনে চলা জরুরি। ব্রতের শুরু এভাবে করুন: সকালে তাড়াতাড়ি উঠে স্নান করুন এবং নিজেকে শারীরিক ও মানসিকভাবে শুদ্ধ করুন। এরপর, শান্ত মনে ব্রতের সংকল্প নিন, যার অর্থ হল আপনি পুরো দিন ভগবানের প্রতি আন্তরিকতা ও নিয়ম দিয়ে ব্রত পালন করবেন।

যদি আপনার স্বাস্থ্য ভালো থাকে, তাহলে নির্জল ব্রত রাখুন, অর্থাৎ কিছু না খেয়ে বা না পিয়ে ব্রত করুন। কিন্তু যদি আপনার শারীরিক অবস্থা এর অনুমতি না দেয়, তাহলে আপনি হালকা ফলাহার করতে পারেন, যাতে শরীরে শক্তি থাকে এবং ব্রতের উদ্দেশ্যে কোন বাধা না আসে।

  • ভগবান বিষ্ণুর পূজা করুন: ভগবান বিষ্ণুর পূজা শুরু করার জন্য প্রথমে ঘরের মন্দিরে বা কোনো পরিষ্কার স্থানে ভগবান বিষ্ণুর প্রতিমা বা ছবি স্থাপন করুন। এরপর প্রদীপ জ্বালান এবং আন্তরিকভাবে কুমকুম, অক্ষত (চাল), ফুল এবং তুলসী পাতা ভগবানকে অর্পণ করুন। তুলসী পাতা ভগবান বিষ্ণুকে বিশেষ প্রিয়, তাই অবশ্যই তা অর্পণ করুন। পূজার শেষে ভগবানকে ভোগ দিন যাতে ফল, মিষ্টি বা ব্রত অনুযায়ী ফলাহারের জিনিসপত্র থাকতে পারে। এই পুরো প্রক্রিয়াটি আন্তরিক মনে ও ভক্তি সহকারে করুন।
  • মন্ত্র জপ করুন: ভগবান বিষ্ণুকে প্রসন্ন করার জন্য ‘ॐ नमो भगवते वासुदेवाय’ মন্ত্র জপ করুন। এই মন্ত্র অত্যন্ত শক্তিশালী বলে মনে করা হয় এবং এটি মনে শান্তি দেয়। নিয়মিতভাবে এই মন্ত্র জপ করলে মানসিক অবস্থার উন্নতি হয় এবং ইতিবাচক শক্তির সঞ্চার হয়। যদি আপনার সময় ও আন্তরিকতা থাকে, তাহলে আপনি বিষ্ণুসহস্রনামের পাঠও করতে পারেন। ভগবানের ১০০০ নামের জপ করলে ভক্তিভাব ও দিব্যশক্তি বৃদ্ধি পায়, যা জীবনে সুখ ও সমৃদ্ধি আনে।
  • সন্ধ্যায় আরতি এবং ফলাহার: সন্ধ্যায় ব্রতের সমাপ্তির সময় প্রদীপ জ্বালিয়ে ভগবানের আরতি করুন। এই আরতি ভগবানের প্রতি আন্তরিকতা ও ভক্তি প্রকাশ করার একটি সুন্দর উপায়। যদি আপনি নির্জল ব্রত রাখতে না পারেন, তাহলে পূজার পর ফল, দুধ বা সাবুদানা ইত্যাদির ফলাহার করুন। ব্রতের উদ্দেশ্য শরীরকে কষ্ট দেওয়া নয়, বরং মনকে একাগ্র করে ঈশ্বরের ভক্তিতে নিবেদিত করা। ফলাহারে শরীর পুষ্টি পায় এবং মন সন্তুষ্টি পায়, যার ফলে ব্রতের আধ্যাত্মিক লাভ পুরোপুরি পাওয়া যায়।

ব্রত করার লাভ

নির্জলা একাদশী ব্রত করলে সারা বছরের সকল একাদশীর পুণ্য একসাথে পাওয়া যায়। এই ব্রত পাপ ধ্বংস করে ব্যক্তিকে মোক্ষ লাভের পথ উন্মোচন করে। ব্রতী ভগবান বিষ্ণুর কৃপায় নিজের জীবনে সুখ, শান্তি এবং সমৃদ্ধি লাভ করেন। এছাড়াও, এই ব্রত মৃত্যুর পর যমরাজের ন্যায়বিচার থেকে মুক্তি দেয় এবং সরাসরি বিষ্ণুলোকে (বৈকুণ্ঠে) স্থান লাভ হয়। এইভাবে এই ব্রত শুধুমাত্র ধর্মীয় নয় জীবনকে শান্তি ও কল্যাণের দিকেও নিয়ে যায়।

নির্জলা একাদশী ব্রতের কথা

নির্জলা একাদশীর কথা অত্যন্ত প্রসিদ্ধ এবং এটি আমাদের উপবাস ও ব্রতের গুরুত্ব বুঝিয়ে দেয়। এক সময় মহর্ষি মার্কণ্ডেয় ভগবান বিষ্ণুর কাছে জিজ্ঞাসা করেছিলেন একাদশী ব্রতের গুরুত্ব কি এবং কোন একাদশী ব্রত সবচেয়ে কার্যকর। ভগবান বিষ্ণু তাকে বলেছিলেন যে জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্ল পক্ষের নির্জলা একাদশী ব্রত সর্বোত্তম।

কথানুসারে, এক সময় পান্ডবদের মধ্যে ভীমসেন এই ব্রত পালন করেছিলেন। ভীমসেনের খুব ক্ষুধা ও তৃষ্ণা লেগেছিল, কিন্তু তিনি নির্জলা একাদশীর ব্রত পুরো আন্তরিকতা দিয়ে পালন করেছিলেন। এই ব্রতের প্রভাবে তিনি ভগবান বিষ্ণুর কৃপা লাভ করেছিলেন এবং অসম্ভব শক্তি লাভ করেছিলেন।

ভগবান বিষ্ণু তাকে আশীর্বাদ করেছিলেন যে, যে কেউ এই দিন উপবাস করে ব্রত পালন করবে, সে সকল পাপ থেকে মুক্তি পাবে এবং স্বর্গে যাওয়ার যোগ্য হবে। এইভাবে নির্জলা একাদশী ব্রত পালন করলে পাপ ধ্বংস হয় এবং জীবনে সুখ-সমৃদ্ধি আসে।

Leave a comment