অবশেষে নন্দী কিভাবে ভগবান শিবের বাহন হলেন? আসুন এর পেছনের আকর্ষণীয় গল্পটি পাঠকদের জানাই।
হিন্দুধর্মে প্রায় সকল দেব-দেবীরই কোনো না কোনো জীবজন্তু বাহন হিসেবে রয়েছে। তেমনই শিবের বাহন হলেন নন্দী। প্রায়শই দেখা যায় শিবের মূর্তির সামনে বা মন্দিরের বাইরে নন্দীর মূর্তি স্থাপন করা থাকে।
পুরাণেও নন্দী বলদকে বিশেষ স্থান দেওয়া হয়েছে। নন্দী শুধু শিবের বাহনই নন, তিনি তাঁর পরম ভক্ত হওয়ার পাশাপাশি তাঁর অনুচরদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ এবং তাঁর বন্ধুও। কিন্তু, আপনারা কি কখনো ভেবে দেখেছেন যে, নন্দী কিভাবে ভগবান শিবের বাহন হলেন?
নন্দীর কানে মনের ইচ্ছা প্রকাশ করলে ভগবান শিব তা পূরণ করেন।
তখনকার কথা, যখন ভগবান শিবের কোনো বাহন ছিল না। তাঁকে পায়ে হেঁটে জঙ্গল-পাহাড়ে ভ্রমণ করতে হত। এটি দেখে একদিন মা পার্বতী তাঁকে বললেন, আপনি তো সারা বিশ্বের স্বামী, আপনার কি পায়ে হেঁটে ভ্রমণ করা শোভা পায়? শিব হেসে বললেন, দেবী, আমি তো ভবঘুরে, আমার আবার বাহনের কি প্রয়োজন। কোনো সাধু কি কখনো বাহনে চড়ে?
পার্বতী চোখে জল ভরে বললেন, যখন আপনি শরীরে ভস্ম মেখে, মাথায় জটা বেঁধে খালি পায়ে কাঁটা ভরা পথে হাঁটেন, তখন আমার খুব কষ্ট হয়। শিব তাঁকে বার বার বোঝানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু তিনি নিজের জেদে অটল রইলেন। তিনি বললেন, কোনো সুবিধা ছাড়াই জঙ্গলে থাকতে আমি রাজি, তবে তোমার জন্য বাহন চাই।
তখন মহাদেব চিন্তিত হলেন, কাকে তিনি নিজের বাহন বানাবেন? তিনি সকল দেবতাকে ডাকলেন। নারদ মুনি শিবের বার্তা সকল দেবতার কাছে পৌঁছে দিলেন। এটি শুনে সকল দেবতা ভয় পেয়ে গেলেন, না জানি শিব কার বাহন নিয়ে নেন। তাই সকল দেবতাই কোনো না কোনো অজুহাত দেখিয়ে নিজেদের প্রাসাদে বসে রইলেন।
পার্বতী এই কথা জেনে খুবই দুঃখ পেলেন। শিব দেখলেন যখন কোনো দেবতাই এলেন না, তখন তিনি হুঙ্কার দিলেন, আর এতেই বনের সমস্ত পশু এসে হাজির হল।
শিব তাদের বললেন, তোমাদের মা পার্বতী চান যে, আমার একটি বাহন থাকুক। বলো, তোমরা কে আমার বাহন হবে? এটি শুনে সকল পশু আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল। একটি ছোট্ট খরগোশ লাফিয়ে এগিয়ে এসে বলল, ভগবান, আমাকে আপনার বাহন করুন। আমি খুব নরম ও কোমল। সকল পশু একসাথে হেসে উঠল। তখনই সিংহ গর্জন করে বলল, বোকা খরগোশ, আমার থাকতে তোর এত সাহস, যে তুই এগিয়ে এসেছিস? বেচারা খরগোশ ভয়ে চুপ করে এক কোণে বসে গাজর খেতে লাগল।
এবার সিংহ হাত জোড় করে এগিয়ে এসে বলল, প্রভু, আমি বনের রাজা। শক্তিতে আমার সাথে কেউ পাল্লা দিতে পারবে না। আপনি আমাকে আপনার বাহন করুন। সিংহের কথা শেষ হওয়ার আগেই হাতি মাঝখানে বলে উঠল, এই কাজের জন্য আমি ছাড়া আর কেউ উপযুক্ত নয়। আমি গরমের দিনে আমার শুঁড়ে জল ভরে মহাদেবকে স্নান করাব। বুনো শুয়োরই বা কম কিসে? সেও তার থুতনি নাড়িয়ে বলতে লাগল, শিবজি, আমাকে আপনার বাহন করুন। আমি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকার চেষ্টা করব। এই বলে সে তার শরীরের কাদা চাটতে লাগল।
এবার কস্তুরী হরিণের পালা। কস্তুরী হরিণ নাকে হাত দিয়ে বলল, ছিঃ, কি বিশ্রী গন্ধ। দূর হও এখান থেকে। আমার পিঠে শিবজি চড়বেন। এভাবেই সকল পশু নিজেদের দাবি জানাতে লাগল। তখন শিব সবাইকে শান্ত করে বললেন, আমি কিছু দিন পর সকল পশুর কাছে একটি জিনিস চাইব। যে পশু আমাকে সেই জিনিস এনে দেবে, সেই হবে আমার বাহন।
ভগবান শিবের বাহন নন্দী পরিশ্রমের প্রতীক।
নন্দী বলদও সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল। সেই দিনের পর থেকে সে লুকিয়ে লুকিয়ে মহাদেব ও পার্বতীর কথা শুনতে লাগল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সে ক্ষুধা-পিপাসার তোয়াক্কা না করে লুকিয়ে থাকত। একদিন সে জানতে পারল যে, শিব বর্ষার সময় শুকনো কাঠ চাইবেন। সেই দিন থেকে সে জঙ্গল থেকে শুকনো কাঠ সংগ্রহ করতে লাগল। বর্ষা আসার আগেই সে সমস্ত প্রস্তুতি সেরে ফেলল।
বর্ষাকাল এল, পুরো জঙ্গল জলে ভরে গেল। এমন সময় শিব সকল পশুকে ডাকলেন এবং তাদের কাছে শুকনো কাঠ চাইলেন। তখন সকল পশু একে অপরের মুখের দিকে তাকাতে লাগল। তখন নন্দী (বলদ) সেখানে এল এবং অনেক শুকনো কাঠের বোঝা নিয়ে এল। এটি দেখে ভগবান শিব খুব খুশি হলেন। তিনি জানতেন যে, নন্দী তাঁর কথা শুনেছে, তবুও তিনি নন্দী বলদকে নিজের বাহন হিসেবে বেছে নিলেন।
সমস্ত পশু তাঁদের এবং মা পার্বতীর জয়ধ্বনি করতে করতে ফিরে গেল।