শিঁদুর পরার প্রথা ভারতীয় সভ্যতায় অনেক শতাব্দী ধরে চলে আসছে। সর্বপ্রথম কে শিঁদুর পরেছিলেন এবং কীভাবে এই প্রথা শুরু হয়েছিল, সেই সাথে এর ধর্মীয় গুরুত্ব সম্পর্কেও আলোচনা করব। ভারতীয় সংস্কৃতিতে নারীদের জন্য শিঁদুর শুধুমাত্র একটা আলংকারিক জিনিস নয়, বরং এটি তাদের বিবাহ, প্রেম ও সমর্পণের প্রতীক।
বিশেষ করে হিন্দু ধর্মে শিঁদুরকে সুহাগের চিহ্ন হিসেবে মনে করা হয়। বিয়ের পর প্রতিটি হিন্দু নারীর মাথায় শিঁদুর পরা একটি প্রথা, যা অনেক শতাব্দী ধরে পালিত হয়ে আসছে। কিন্তু আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন এই প্রথার সূচনা কখন হয়েছিল এবং সর্বপ্রথম কে শিঁদুর পরেছিলেন?
শিঁদুর কি এবং এর গুরুত্ব
শিঁদুর হল একটি লাল রঙের বস্তু, যা বিবাহিত নারীরা তাদের মাথার মাঙ্গলে পরে থাকেন। এটি শুধুমাত্র আলংকারিক জিনিস নয়, বরং ভারতীয় সংস্কৃতিতে এর ধর্মীয় ও সামাজিক গুরুত্ব অত্যন্ত গভীর। বিশেষ করে হিন্দু ধর্মে শিঁদুরকে সুহাগের সর্ববৃহৎ চিহ্ন হিসেবে মনে করা হয়। যখন কোন নারী বিয়ে করে, তখন তার স্বামী তার মাঙ্গলে শিঁদুর পরে দেন, যা এই ব্যাপারটির প্রতীক যে সে এখন বিবাহিতা।
শিঁদুরকে ‘অখণ্ড সৌভাগ্য’র প্রতীকও বলা হয়। এর অর্থ হল - এমন নারী যার স্বামী জীবিত আছেন এবং তার দাম্পত্য জীবন সুখময় ও নিরাপদ। মনে করা হয় শিঁদুর পরার ফলে স্বামীর আয়ু বৃদ্ধি পায় এবং দাম্পত্য জীবনে প্রেম, সম্মান ও শান্তি বজায় থাকে। এ কারণেই বিবাহিত নারীরা প্রতিদিন পূজা-পাঠের আগে বা সাজতে গেলে শিঁদুর পরেন।
ধর্মগ্রন্থেও শিঁদুরের উল্লেখ পাওয়া যায়। অনেক কাহিনীতে বলা হয়েছে যে শিঁদুর শুধু সাজ-সজ্জার অংশ নয়, বরং আস্থা ও শ্রদ্ধার প্রতীক। এটি স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে দৃঢ় করার একটি প্রথা, যা আজও অনেক নারী শ্রদ্ধার সাথে পালন করেন।
ধর্মীয় শাস্ত্রে শিঁদুরের উল্লেখ
শিঁদুরের গুরুত্ব শুধুমাত্র একটা সৌন্দর্য প্রসাধনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি হিন্দু ধর্মে একটি পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ প্রথার অংশ। আমাদের ধর্মের অনেক প্রাচীন গ্রন্থ ও শাস্ত্রে শিঁদুরের উল্লেখ পাওয়া যায়। বিশেষ করে ঋগ্বেদ ও অথর্ববেদ যেসব প্রাচীন বেদে লেখা আছে যে বিবাহিতা নারীরা শিঁদুর পরতেন এবং এটিকে সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে মনে করা হত।
বেদিক যুগে শিঁদুরকে ‘কুঙ্কুম’ বলা হত। সে সময় এটিকে নারীদের পঞ্চ-সৌভাগ্যের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। পঞ্চ-সৌভাগ্যের অর্থ হল - সেই পাঁচটি জিনিস যা বিবাহিত নারীর সৌভাগ্য ও সুহাগের পরিচয় বহন করে। এই পাঁচটি জিনিসের মধ্যে রয়েছে:
- মাঙ্গলে শিঁদুর
- চুলে ফুল
- গলায় মাঙ্গলসূত্র
- মুখে হলুদ
- পায়ের আঙ্গুলে বিছুঁড়ি
এই সমস্ত জিনিসের উদ্দেশ্য ছিল একজন নারীর বিবাহিত পরিচয় বজায় রাখা এবং তার দাম্পত্য জীবন সুখময় করা। শাস্ত্র অনুসারে, এই প্রতীকগুলি শুধুমাত্র সামাজিকভাবে নারীর অবস্থান বলে না, বরং এটিও দেখায় যে তিনি তার স্বামীর দীর্ঘায়ু ও সুখ-শান্তির জন্য আস্থা ও শ্রদ্ধার সাথে এই প্রথাগুলি পালন করছেন।
সর্বপ্রথম কে শিঁদুর পরার সূচনা করেছিলেন?
শিঁদুর পরার প্রথা অত্যন্ত প্রাচীন এবং এর পিছনে একটি সুন্দর ধর্মীয় কাহিনী জড়িত। শিবপুরাণ অনুসারে, সর্বপ্রথম মা পার্বতী শিঁদুর পরেছিলেন। যখন তিনি ভগবান শিবকে নিজের স্বামী হিসেবে পেতে বহু বছর কঠোর তপস্যা করেছিলেন, তখন ভগবান শিব তার তপস্যায় প্রসন্ন হয়ে তাকে নিজের স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। বিয়ের পর মা পার্বতী নিজের প্রেম ও সুহাগের প্রতীক হিসেবে নিজের মাঙ্গলে শিঁদুর পরেছিলেন। এই পবিত্র মুহূর্তকে শিঁদুর পরার সূচনা বলে মনে করা হয়।
এই সাথে মা পার্বতী এও বলেছিলেন যে, যে নারী শ্রদ্ধা ও আস্থার সাথে মাঙ্গলে শিঁদুর পরবে, তার স্বামীর দীর্ঘায়ু ও সৌভাগ্য লাভ হবে। তাই আজও বিবাহিত নারীরা মাঙ্গলে শিঁদুর পরে নিজের স্বামীর দীর্ঘায়ু ও দাম্পত্য সুখের কামনা করেন। এই প্রথা শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় রীতিনীতি নয়, বরং স্বামী-স্ত্রীর প্রেম ও সমর্পণের প্রতীক। মা পার্বতীর এই কাজ দেখেই শিঁদুর পরার প্রথা শুরু হয়েছিল, যা আজও আদর ও বিশ্বাসের সাথে পালিত হয়ে আসছে।
ত্রেতাযুগে শিঁদুর: একটি পবিত্র প্রথা
রামায়ণ কালের একটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও আবেগঘন কাহিনী আছে, যা শিঁদুরের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে। একবার হনুমান দেখলেন মা সীতা তার মাঙ্গলে শিঁদুর পরছেন। হনুমান এটা দেখে অবাক হলেন, কারণ তিনি জানতেন না এর গুরুত্ব কি। তিনি শ্রদ্ধার সাথে মা সীতাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মা, আপনি এই লাল রঙ আপনার মাঙ্গলে কেন পরেন?’ এতে মা সীতা হাসিমুখে উত্তর দিলেন, ‘আমি এই শিঁদুর আমার স্বামী শ্রীরামের দীর্ঘায়ু ও সুখের জন্য পরি।’
সীতা দেবীর এই কথা শুনে হনুমান অত্যন্ত আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন। তিনি ভাবলেন, যদি একটু শিঁদুর শ্রীরামকে দীর্ঘজীবী করতে পারে, তাহলে আমি কেন আমার পুরো শরীরে শিঁদুর পরব না। এমন ভেবে তিনি পুরো শরীরে শিঁদুর পরে ভগবান রামের প্রতি নিজের ভক্তি ও প্রেম প্রকাশ করলেন। সেই থেকেই এই বিশ্বাস তৈরি হল যে হনুমানের কাছে শিঁদুর অত্যন্ত প্রিয়।
আজও মন্দিরে হনুমানের মূর্তিতে শিঁদুর অর্পণ করা হয়, এবং ভক্তগণ শ্রদ্ধার সাথে তাকে শিঁদুর অর্পণ করেন। এই কাহিনী আমাদের শেখায় যে শিঁদুর শুধুমাত্র একটি প্রথা নয়, বরং প্রেম, ভক্তি ও সমর্পণের প্রতীক।
দ্বাপর যুগে শিঁদুরের প্রথা
দ্বাপর যুগ, অর্থাৎ মহাভারতের সময়, শিঁদুরের প্রথাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার যুগ বলে মনে করা হয়। স্কন্দ পুরাণে এর বিশেষ উল্লেখ আছে যে সে সময়ের মূল চরিত্র দ্রৌপদীও তার মাঙ্গলে শিঁদুর পরতেন। দ্রৌপদী পাঁচ পান্ডবের স্ত্রী ছিলেন এবং তিনিও শিঁদুরকে নিজের সৌভাগ্য ও স্বামীর দীর্ঘায়ু ও সুখের প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। এতে স্পষ্ট হয় যে শিঁদুরের প্রথা শুধুমাত্র ত্রেতা যুগ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং দ্বাপর যুগেও এর গুরুত্ব অক্ষুণ্ণ ছিল।
দ্রৌপদীর মতো আদর্শ ও জ্ঞানী স্ত্রীর দ্বারা শিঁদুর পরা এই প্রথাকে আরও পবিত্র করে তুলেছিল। এটি শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় রীতিনীতি নয়, বরং নারীদের আত্ম-সম্মান, আস্থা ও দাম্পত্য প্রেমের প্রতীক হিসেবে পরিণত হয়েছিল। এইভাবে আমরা বলতে পারি যে শিঁদুর পরার প্রথা হাজার হাজার বছর ধরে ভারতীয় সংস্কৃতিতে বদ্ধমূল এবং আজও ততটাই শ্রদ্ধার সাথে পালিত হয়।
সিন্ধু সভ্যতায় শিঁদুরের প্রথা
শিঁদুর পরার প্রথা শুধুমাত্র ধর্মীয় কাহিনীতেই সীমাবদ্ধ নয়, এর ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন। সিন্ধু সভ্যতা, যা বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন সভ্যতা হিসেবে মনে করা হয়, সেখান থেকেও শিঁদুর পরার প্রমাণ পাওয়া গেছে। পুরাতাত্ত্বিক খননে কিছু এমন নারীর মূর্তি পাওয়া গেছে যাদের মাঙ্গলে লাল রঙের সোজা রেখা আঁকা আছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি কোনো আলংকারিক জিনিস নয়, বরং শিঁদুরই। এটি এই ব্যাপারটির ইঙ্গিত দেয় যে সে সময়ের নারীরাও মাঙ্গলে শিঁদুর পরতেন এবং এই প্রথা হাজার হাজার বছর পুরোনো। পুরাতত্ত্ববিদদের মতে, সিন্ধু সভ্যতার এই মূর্তিগুলি প্রায় ৫০০০ বছর পুরোনো। এর অর্থ হল শিঁদুর পরার প্রথা শুধুমাত্র ধর্মের সাথে জড়িত নয়, বরং এটি আমাদের সংস্কৃতি ও সভ্যতার অংশ।
এতে এটাও বোঝা যায় যে সে সময়ের নারীরাও সৌভাগ্য, দাম্পত্য জীবন ও আস্থার প্রতীক হিসেবে শিঁদুরকে গুরুত্ব দিতেন। আজও এই প্রথা তেমনিভাবে জীবন্ত এবং প্রতিটি বিবাহিতা নারীর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। শিঁদুর শুধুমাত্র একটি রঙ নয়, বরং আমাদের সংস্কৃতির একটি গভীর পরিচয়।
আজকের সময়ে শিঁদুরের গুরুত্ব
আজকের যুগেও শিঁদুরের স্থান ভারতীয় সংস্কৃতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে যখন কারও বিয়ে হয়, তখন “শিঁদুরদান” -এর রীতিকে অত্যন্ত পবিত্র মনে করা হয়। এটি সেই মুহূর্ত যখন বর তার কনে-র মাঙ্গলে শিঁদুর পরে দেন এবং এই কাজের মাধ্যমে তাদের দাম্পত্য জীবনের সূচনা হয়। এই রীতি দেখায় যে কনে এখন বিবাহিতা এবং তিনি নিজের জীবনসঙ্গীকে গ্রহণ করেছেন। ভারতের গ্রাম, শহর এবং ঐতিহ্যবাহী পরিবারে আজও এই প্রথা পুরো শ্রদ্ধা ও আবেগের সাথে পালিত হয়।
যদিও, পরিবর্তিত সময়ের সাথে সাথে শহর এবং কিছু আধুনিক চিন্তাধারার পরিবারে এই প্রথা কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে। কিছু নারী এখন শিঁদুর পরাকে জরুরি মনে করেন না এবং নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী এটি গ্রহণ করেন। কিন্তু আজও অনেক নারী আছেন যারা এটিকে তাদের প্রেম, সম্পর্কের পরিচয় ও শ্রদ্ধার সাথে জুড়ে প্রতিদিন শিঁদুর পরেন।
তাদের কাছে শিঁদুর শুধুমাত্র আলংকারিক জিনিস নয়, বরং নিজের স্বামীর প্রতি সম্মান, সুরক্ষা ও প্রেমের প্রতীক। এইভাবে দেখা যায় যে শিঁদুরের প্রথা সময়ের সাথে সাথে রূপ বদলেছে, কিন্তু তার আবেগ আজও ততটাই গভীর। শিঁদুর শুধুমাত্র একটি রঙ নয়, বরং ভারতীয় সংস্কৃতি, আস্থা ও প্রথার গভীর অংশ। মা পার্বতী থেকে শুরু করে সীতা ও দ্রৌপদী পর্যন্ত, শিঁদুর সবসময় ভারতীয় নারীদের জীবনে বিশেষ স্থান করে নিয়েছে।
ধর্মীয় শাস্ত্র এবং ইতিহাসে লিপিবদ্ধ ঘটনা থেকে স্পষ্ট যে শিঁদুর পরার প্রথা হাজার হাজার বছর পুরোনো এবং এর সম্পর্ক শুধুমাত্র সাজসজ্জার সাথে নয়, বরং নারীর আবেগ, প্রেম ও দাম্পত্য জীবনের সাফল্যের সাথেও গভীরভাবে জড়িত।