ঈদ-এ-মিলাদুন্নবী: ইসলামের অন্তিম নবীর জন্মদিনের গুরুত্ব ও পালন

🎧 Listen in Audio
0:00

বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে, ভারত সহ, মুসলিম সম্প্রদায়ের দ্বারা পালিত একটি অত্যন্ত পবিত্র ও ঐতিহাসিক উৎসব হলো—ঈদ-এ-মিলাদুন্নবী, যা মওলিদ-উন-নবী বা বারাওয়ফাত নামেও পরিচিত। এই উৎসব ইসলাম ধর্মের অন্তিম নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মদিন উপলক্ষে পালিত হয়। মুসলমানদের জন্য এটি কেবলমাত্র উৎসব নয়, বরং আধ্যাত্মিক অনুপ্রেরণা, আস্থা, ভক্তি ও জীবনের আদর্শের পুনঃস্মরণের এক অপূর্ব সুযোগ।

ঈদ-এ-মিলাদুন্নবীর ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় গুরুত্ব

ইসলাম ধর্মে হযরত মুহাম্মদ সাহেবকে অন্তিম নবী হিসেবে মেনে নেওয়া হয়, যাঁকে "রহমতুল্লিল আলামিন"— অর্থাৎ সমগ্র সৃষ্টির জন্য রহমত বলা হয়। ৫৭১ খ্রিস্টাব্দে আরব দেশের মক্কা শহরে রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখে তাঁর জন্ম হয়। এই দিনটিকেই মুসলমানরা ঈদ-এ-মিলাদ হিসেবে পালন করে।

হযরত মুহাম্মদ সাহেবের জীবন সত্য, করুণা, সমতা, সততা ও মানবতার অনন্য উদাহরণ। তিনি কেবলমাত্র একজন ধর্মীয় নেতা ছিলেন না, বরং সমাজ সংস্কারক, নীতিনির্মাতা ও একজন প্রকৃত मार्गদর্শক ছিলেন। তিনি তওহিদ (এক ঈশ্বরের উপাসনা), ইনসাফ (ন্যায়) ও খিদমত (সেবা) শিক্ষা দিয়েছেন।

মিলাদুন্নবীর নামকরণ ও অর্থ

"মিলাদ"-এর অর্থ জন্ম এবং "নবী"-এর অর্থ পয়গম্বর। অতএব "মিলাদুন্নবী" অর্থ হলো—নবীর জন্মদিন। একে কিছু স্থানে "মওলিদ"ও বলা হয়, যার শাব্দিক অর্থও জন্ম।

এই উৎসব ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, তুরস্ক, মিশর, ইরাক, ইরান সহ অনেক আফ্রিকান ও ইউরোপীয় দেশে ব্যাপক উৎসাহ ও ভক্তিপূর্ণভাবে পালিত হয়। তবে, কিছু মুসলিম সম্প্রদায় যেমন সালেফী ও ওয়াহাবীরা এটিকে ধর্মীয় উৎসব হিসেবে মনে করেন না, তবুও অধিকাংশ সুন্নি মুসলমান এই দিনটি অত্যন্ত শ্রদ্ধা, সম্মান ও উৎসাহের সাথে পালন করে।

হযরত মুহাম্মদ সাহেবের জীবন: অনুপ্রেরণার উৎস

হযরত মুহাম্মদ সাহেবের জীবন প্রতিটি মানুষের জন্য অনুপ্রেরণাদায়ক। তিনি সর্বদা সত্য কথা বলা, ধৈর্য ধরা ও অন্যদের সাহায্য করার শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি সমাজে বিরাজমান অশ্লীলতা, অন্ধবিশ্বাস ও অসমতাবিরোধী কন্ঠ উঠিয়েছেন এবং মানুষকে সৎ পথে চলার অনুপ্রেরণা দিয়েছেন।

তিনি নারীদের সম্মান, শিশুদের প্রেম ও বৃদ্ধদের आदর করার শিক্ষা দিয়েছেন। তাঁর আদর্শ আজও বিশ্ব মানবতার জন্য मार्गদর্শক।

ঈদ-এ-মিলাদ কীভাবে পালিত হয়?

এই পবিত্র দিনের সূচনায় লোকেরা বিশেষ নামাজ আদায় করে, পাশাপাশি পয়গম্বর মুহাম্মদ সাহেবের শানে দরুদ ও সালাম পাঠ করে। মসজিদগুলো সুন্দরভাবে সজ্জিত করা হয়, ঘরে ঘরে আলোকসজ্জা করা হয় এবং অনেক স্থানে ভক্তরা বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করে, যেখানে তারা পয়গম্বরের শিক্ষার প্রশংসা করে।

  1. মসজিদ ও ঘরবাড়ির সাজসজ্জা

এই দিন মসজিদগুলো সবুজ আলো ও ব্যানার দিয়ে সজ্জিত করা হয়, কারণ সবুজ রং ইসলামে শুভ বলে মনে করা হয়। ঘরবাড়িতেও প্রদীপ ও আলোকসজ্জা করা হয়।

  1. জুলুস-এ-মুহাম্মদী

অনেক স্থানে জুলুস-এ-মুহাম্মদী বের করা হয়, যেখানে লোকেরা পতাকা নিয়ে পয়গম্বর সাহেবের শানে নাত (ভজনের মতো গান) পাঠ করে চলে। এতে শিশু, বৃদ্ধ, নারী সকলেই অংশগ্রহণ করে।

  1. নাত শরিফ ও মাহফিল

এই দিন বিশেষ নাত শরিফ (পয়গম্বরের শানে কবিতা) পাঠ করা হয়। বিভিন্ন স্থানে মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়, যেখানে পয়গম্বরের জীবন ও শিক্ষা নিয়ে আলোচনা হয়।

  1. দান ও সেবা

ঈদ-এ-মিলাদের দিন লোকেরা গরীব ও দরিদ্রদের খাবার, পোশাক ও টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করে। এই দিন খিদমত-এ-খালক (মানব সেবা)কে সবচেয়ে বড় ইবাদত বলে মনে করা হয়।

  1. বিশেষ ভোজ ও মিষ্টান্ন

এই দিন অনেক স্থানে সম্মিলিত ভোজের আয়োজন করা হয়, যাকে 'নিয়াজ' বলা হয়। সেঁইয়াই, খির, বিরিয়ানি ও হালুয়া ইত্যাদি ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্ন তৈরি করা হয়।

ঈদ-এ-মিলাদের উপলক্ষে পাঠিত দোয়া ও দরুদ

এই দিন লোকেরা হযরত মুহাম্মদ সাহেবের শানে দরুদ শরিফ পাঠ করে:

"اللهم صل على محمد وعلى آل محمد"

এর অর্থ: "হে আল্লাহ! মুহাম্মদ ও তাঁর পরিবারের উপর আপনার রহমত ও শান্তি নাযিল করুন।"

আজকের যুগে মিলাদুন্নবীর গুরুত্ব

আজ যখন পুরো বিশ্ব সন্ত্রাস, বৈষম্য ও অসহিষ্ণুতায় জর্জরিত, তখন হযরত মুহাম্মদ সাহেবের শিক্ষা আগের চেয়েও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। তিনি সর্বদা প্রেম, সংযম, ক্ষমা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের কথা বলেছেন।

তাঁর জীবন আমাদের শেখায় যে ধর্মের প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো:

  • মানবতার সেবা করা
  • সত্য কথা বলা
  • দরিদ্রদের সাহায্য করা
  • শান্তি ও ভ্রাতৃত্ব ছড়িয়ে দেওয়া
  • মিলাদুন্নবী ও শিশুদের অংশগ্রহণ

এই উৎসবের মাধ্যমে শিশুদের নৈতিক শিক্ষা, ধর্মীয় সংস্কার ও শৃঙ্খলা শেখানোর সুযোগ পাওয়া যায়। স্কুল, মাদ্রাসা ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানে প্রতিযোগিতা, বক্তৃতা, নাত পাঠ ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হয়।

শিশুদের বলা হয় যে, নবীর শিক্ষা কেবলমাত্র ধর্মীয় নয়, বরং একজন ভালো মানুষ হওয়ার পথ।

ঈদ-এ-মিলাদ ও বিশ্বব্যাপী ভ্রাতৃত্ব

ঈদ-এ-মিলাদ ইসলাম ধর্মের সার্বজনীন মূল্যবোধ—শান্তি, সহিষ্ণুতা ও ন্যায়বিচার—কে উন্মোচিত করে। এই দিন বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ একে অপরকে শুভেচ্ছা জানায় এবং মিলেমিশে উৎসব উপভোগ করে। এটি ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সাংস্কৃতিক ঐক্যের এক অনন্য উদাহরণ।

ঈদ-এ-মিলাদ উপলক্ষে কিছু অনুপ্রেরণামূলক উক্তি

"যা তুমি নিজের জন্য পছন্দ করো, তাই অন্যদের জন্যও পছন্দ করো।"— পয়গম্বর মুহাম্মদ

উত্তম মুসলমান সেই ব্যক্তি যার কথা ও কাজে কারও কষ্ট হয় না।

"জ্ঞান অর্জন করা প্রতিটি মুসলিম পুরুষ ও নারীর কর্তব্য।"

ঈদ-এ-মিলাদুন্নবী একটি উৎসব যা আমাদের জীবনের সঠিক পথ দেখায়। এটি কেবলমাত্র একটি উৎসব নয়, বরং এক অনুপ্রেরণা—সত্য, সেবা, করুণা ও ন্যায়বিচারের। পয়গম্বর মুহাম্মদ সাহেবের জীবন আমাদের শেখায় যে, কীভাবে প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও ইমানদারী, ধৈর্য্য ও মানবতাকে ধরে রাখা যায়।

এই দিন আমরা কেবল উৎসব পালন করি না, বরং আমাদের মনের ভেতরের উত্তম মানুষটিকে জাগ্রত করার চেষ্টা করি। আমাদের উচিত নবীর শিক্ষাগুলো কেবলমাত্র বইয়ে রাখা নয়, বরং জীবনে প্রয়োগ করা এবং সমাজে একজন উত্তম মানুষ হওয়ার চেষ্টা করা।

Leave a comment