রাজস্থানের কর্ণী মা মন্দির: ইঁদুরদের পূজা ও অলৌকিক রহস্য

🎧 Listen in Audio
0:00

রাজস্থানের মাটি অলৌকিক ঘটনা এবং আস্থার গল্পে পরিপূর্ণ। এই অলৌকিক স্থানগুলির মধ্যে একটি হল বিখ্যাত কর্ণী মা মন্দির, যা বিকারনেওর দেষনোক নামক শহরে অবস্থিত। এই মন্দিরটি কেবলমাত্র তার ধর্মীয় গুরুত্বের জন্যই নয়, হাজার হাজার ইঁদুরের উপস্থিতির জন্যও বিশ্বখ্যাত। এই মন্দিরের সবচেয়ে আশ্চর্যজনক দিক হল এখানে ইঁদুরদের দেবতা হিসেবে পূজা করা হয় এবং কোন ভক্ত যদি সাদা ইঁদুর দেখতে পান তবে তা অত্যন্ত শুভ ও সৌভাগ্যের লক্ষণ বলে মনে করা হয়।

কর্ণী মা কে ছিলেন? সহজ ভাষায় তথ্য

কর্ণী মাকে মা দুর্গার অবতার বলে মনে করা হয়। বলা হয়, তিনি ১৪শ শতাব্দীতে রাজস্থানে আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং তার জীবনে অনেক অলৌকিক ঘটনা ঘটিয়েছিলেন। তিনি মানুষের সাহায্য করেছিলেন, অসহায়দের আশ্রয় দিয়েছিলেন এবং সমাজে সৎকর্ম ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। তিনি বিকারনেওর এবং জোধপুরের রাজ পরিবারের কুলদেবীও, যাদের প্রজন্ম ধরে পূজা করা হয়। তার জীবন ছিল সাধনা, সেবা এবং ত্যাগে পরিপূর্ণ।

বিশ্বাস করা হয় যে, সংবৎ ১৫৯৫ সালের চৈত্র শুক্ল নবমীর দিন কর্ণী মা জ্যোতির্লিঙ্গ হয়ে তাঁর পার্থিব দেহ ত্যাগ করেছিলেন। এরপর দেষনোক গ্রামে তার মন্দির নির্মিত হয়, যেখানে আজও লক্ষ লক্ষ ভক্ত তার পূজা করেন। কর্ণী মার এই মন্দির ইঁদুরদের জন্যও অত্যন্ত বিখ্যাত, যার মধ্যে সাদা ইঁদুরদের বিশেষ শুভ বলে মনে করা হয়।

কেন ইঁদুরদের পূজা করা হয়?

কর্ণী মা মন্দিরের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল এখানে প্রায় ২৫,০০০ ইঁদুর বাস করে, যাদের ভক্তিপূর্ণভাবে "কাবা" বলা হয়। তাদের দেবতা সমান সম্মান দেওয়া হয়। এই ইঁদুরগুলি মন্দিরের প্রতিটি কোণে খোলাখুলি ঘুরে বেড়ায়, প্রসাদ খায়, ভক্তদের কাছে আসে কিন্তু কখনও কাউকে কামড়ায় না বা কোন ক্ষতি করে না। এমনকি মন্দিরে প্রথমে এই ইঁদুরদেরই ভোগ নিবেদন করা হয়, তারপর ভক্তদের মধ্যে প্রসাদ বিতরণ করা হয়।

ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, কর্ণী মার এক ভক্ত পরিবারের পুত্রের মৃত্যু হয়েছিল। যখন মা यমরাজের কাছে সেই শিশুটিকে জীবিত করার জন্য প্রার্থনা করেছিলেন, তখন यমরাজ তাকে ইঁদুরের রূপে পুনর্জন্ম দেওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন। এরপর কর্ণী মা আদেশ দিয়েছিলেন যে, তাঁর ভক্তরা মৃত্যুর পর এই মন্দিরে ইঁদুরের রূপে জন্ম নেবে। এই কারণেই এই ইঁদুরদের ভক্তিপূর্ণভাবে পূজা করা হয়।

সাদা ইঁদুর দেখা কেন শুভ?

কর্ণী মা মন্দিরে যেখানে হাজার হাজার কালো ইঁদুর রয়েছে, সেখানে অতি অল্প সংখ্যক সাদা ইঁদুরও দেখা যায়। এই সাদা ইঁদুরগুলিকে অত্যন্ত পবিত্র এবং বিশেষ বলে মনে করা হয়। বিশ্বাস করা হয় যে, এই ইঁদুরগুলি কর্ণী মা এবং তাঁর পরিবারের প্রতীক। বলা হয় যে, কোন ভক্ত যদি মন্দিরে সাদা ইঁদুর দেখতে পান, তবে তা অত্যন্ত শুভ লক্ষণ। এটা বিশ্বাস করা হয় যে, সেই ব্যক্তির সকল মনোকামনা শীঘ্রই পূর্ণ হবে। তাই ভক্তরা সাদা ইঁদুরের দর্শনকে সৌভাগ্য এবং ঈশ্বরের কৃপার প্রতীক বলে মনে করেন।

কর্ণী মা মন্দিরের অद्ভुत বৈশিষ্ট্যসমূহ

কর্ণী মা মন্দির রাজপুতানা স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত, যা এটিকে অত্যন্ত সুন্দর এবং জাঁকজমকপূর্ণ করে তুলেছে। মন্দিরের প্রধান দ্বার এবং স্তম্ভগুলিতে সাদা মার্বেলের সুন্দর খোদাই করা আছে, যা যেকোন ভক্তের মন মোহন করে। মন্দিরের দরজা রুপার তৈরি এবং এতে দেবী কর্ণী মার জীবন সংশ্লিষ্ট গল্পের ছবি খোদাই করা আছে, যা এখানে আসা লোকদের তাঁর জীবন এবং অলৌকিক ঘটনার কথা মনে করিয়ে দেয়।

এই মন্দিরের প্রথম নির্মাণ বিকারনেওর রাজা জয় সিংহ করিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে, মহারাজা গঙ্গা সিংহের সময়কালে এর সম্প্রসারণ হয় এবং এটি আজকের জাঁকজমকপূর্ণ রূপ পায়। ১৯৯৯ সালে হায়দ্রাবাদের কুন্দন লাল বর্মাও মন্দিরের কিছু অংশ আরও সুন্দর করে নির্মাণ করেছিলেন। এই কারণেই এই মন্দিরটি আজ কেবলমাত্র ধর্মীয় নয়, স্থাপত্য দিক থেকেও অত্যন্ত বিশেষ বলে মনে করা হয়।

বৈজ্ঞানিকদের কাছে রহস্য রয়ে গেছে কর্ণী মা মন্দির

কর্ণী মা মন্দিরে হাজার হাজার ইঁদুর থাকে, তবুও সেখানে কখনও কোন ধরনের রোগ বা সংক্রমণের খবর আসে না। এটা বৈজ্ঞানিকদের জন্য অত্যন্ত বিস্ময়ের বিষয়। সাধারণত যেখানে এত ইঁদুর থাকে, সেখানে গন্ধ, দুর্গন্ধ এবং রোগের আশঙ্কা বেড়ে যায়, কিন্তু এই মন্দিরে পরিবেশ একেবারেই পরিষ্কার এবং শান্ত থাকে।

এখানকার ইঁদুরগুলিও কাউকে ক্ষতি করে না এবং অত্যন্ত শান্ত স্বভাবের হয়। বৈজ্ঞানিকরা এই রহস্য বুঝতে অনেকবার গবেষণা করেছেন, কিন্তু এখনও বুঝতে পারেননি যে এত ইঁদুর থাকা সত্ত্বেও এখানে স্বাস্থ্য সমস্যা কেন হয় না। এই স্থান বিজ্ঞানের জন্য আজও একটি অমীমাংসিত রহস্য হয়ে রয়েছে।

মন্দিরে দর্শন এবং ভ্রমণের তথ্য

কর্ণী মা মন্দির রাজস্থানের বিকারনেওর জেলায়, দেষনোক নামক শহরে অবস্থিত। এটি বিকারনেওর শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে। এখানে পৌঁছাতে বিকারনেওর রেলওয়ে স্টেশন থেকে ট্যাক্সি, জীপ বা বাসের সুযোগ সুন্দরভাবে পাওয়া যায়। এছাড়াও, দেষনোকের রেলওয়ে স্টেশন মন্দিরের খুব কাছে, যাতে ট্রেনে ভ্রমণ করাও বেশ সুবিধাজনক হয়।

এখানে সারা বছর ভক্তদের ভিড় জমে থাকে, কিন্তু চৈত্র এবং শারদীয় নবরাত্রির সময় মন্দিরে বিশেষ মেলার আয়োজন করা হয়। এই মেলায় হাজার হাজার ভক্ত দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দর্শনার্থী হিসেবে আসেন। ভক্তদের থাকার জন্য মন্দির প্রাঙ্গণের আশেপাশে ধর্মশালা এবং হোটেলও রয়েছে, যা ভ্রমণকে আরামদায়ক করে তোলে।

ভক্তদের জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়াবলী

কর্ণী মা মন্দিরে প্রবেশ করার সময় ভক্তদের এই বিশেষ বিষয়টির দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে যে কোন ইঁদুরকে আঘাত না করা হয়। এখানে ইঁদুরগুলিকে পূজার অংশ হিসেবে মনে করা হয়, তাই তাদের সুরক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়। যদি কোন ভক্তের ভুলবশত কোন ইঁদুর মারা যায়, তবে তাকে এর ক্ষতিপূরণ হিসেবে রুপার ইঁদুর বানিয়ে মন্দিরে দান করতে হয়। এই রীতি ইঁদুরদের প্রতি সম্মান ও ভক্তিকে প্রতিফলিত করে।

মন্দির প্রশাসন ভক্তদের সুবিধার জন্য মন্দির প্রাঙ্গণের কাছে ধর্মশালা এবং থাকার ব্যবস্থা করেছে। এখানে আসা ভক্তরা শান্তি এবং ভক্তির পরিবেশে সময় কাটান এবং মা কর্ণীর দর্শন করে তাদের জীবনকে পুণ্যে পরিপূর্ণ করেন।

কর্ণী মা মন্দির কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় স্থান নয়, এটি একটি অলৌকিক অভিজ্ঞতাও যা ভক্তদের আধ্যাত্মিকতা, ভক্তি এবং রহস্যের গভীরতার সাথে যুক্ত করে। এখানে ইঁদুরের উপস্থিতি নেতিবাচকতা নয় বরং আস্থা এবং অলৌকিকতার প্রতীক হিসেবে মনে করা হয়। কর্ণী মার মহিমা আজও মানুষের জীবনে বিশ্বাস এবং শক্তির সংযোগ স্থাপন করে। যদি কখনও বিকারনেও যান, তবে এই মন্দিরের দর্শন অবশ্যই করুন এবং সেই অলৌকিক অভিজ্ঞতা অনুভব করুন যা শব্দে বর্ণনা করা কঠিন।

Leave a comment