ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আলী খামেনি ১২ দিনের নীরবতা ভেঙে প্রকাশ্যে এলেন, কিন্তু তাঁর ভাষণে উৎসাহের অভাব ছিল। বিশেষজ্ঞদের মতে, তাঁর ক্ষমতার ওপর নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হচ্ছে এবং উত্তরাধিকার নিয়ে বিতর্ক বাড়ছে।
Iran: ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি সম্প্রতি যখন ১২ দিনের নীরবতা ভেঙে টিভিতে আসেন, তখন তাঁর অবস্থা এবং ভঙ্গি দেখে বিশেষজ্ঞ এবং সাধারণ মানুষ উভয়ের মধ্যেই অনেক প্রশ্ন দেখা দেয়। ৮৬ বছর বয়সী খামেনির মুখ ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল মৃদু এবং তাঁর ভাষণ সেই উৎসাহ নিয়ে আসেনি যার জন্য তিনি পরিচিত। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই প্রথম খামেনিকে এত দুর্বল এবং অসহায় দেখা গেছে।
প্রকাশ্য মঞ্চের পরিবর্তে ক্যামেরার পিছন থেকে কথোপকথন
সাধারণত খামেনি জনতাকে খোলা মঞ্চে সম্বোধন করতেন, হাজার হাজার মানুষের ভিড় তাঁর সামনে থাকত যারা শ্লোগান দিত এবং তাঁর বক্তৃতা শুনে উৎসাহিত হত। কিন্তু এবার তিনি ক্যামেরার সামনে একটি সাধারণ পর্দার সঙ্গে দেখা দেন। তাঁর পিছনে ১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনির ছবি টাঙানো ছিল। এই দৃশ্য বুঝিয়ে দেয় যে এখন তিনি প্রকাশ্যে আসতেও দ্বিধা বোধ করছেন।
ইজরায়েলের বিপদ থেকে বাঁচতে বাঙ্কারে খামেনি
ইসরায়েলের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা এবং যুদ্ধের আশঙ্কার কারণে, রিপোর্ট অনুযায়ী, খামেনি পুরো সংঘর্ষের সময় বাঙ্কারে ছিলেন। তিনি কোনো ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করেননি যাতে তাঁর অবস্থান ট্র্যাক করা না যায়। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রীও প্রকাশ্যে বলেছেন যে সুযোগ পেলে খামেনিকে হত্যা করতে ইসরায়েলি বাহিনী পিছপা হত না। এটি স্পষ্ট যে ইরানের সর্বোচ্চ ক্ষমতাও এখন নিজেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ মনে করছে না।
রাজনৈতিক ক্ষমতা দুর্বল হতে দেখা যাচ্ছে
ওটোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক থমাস জুনোর মতে, ইরানি শাসন এখনই পতনের দ্বারপ্রান্তে না হলেও, এর অভ্যন্তরীণ দৃঢ়তা আগের মতো নেই। খামেনির বিশ্বাসযোগ্যতা এবং তাঁর কার্যকারিতা নিয়ে এখন প্রশ্নচিহ্ন তৈরি হয়েছে। তাঁর সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এবং নেতৃত্বে সেই ভরসা আর দেখা যায় না যা আগে ছিল।
ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ শুরু?
ইরান ইন্টারন্যাশনাল এবং নিউ ইয়র্ক টাইমসের রিপোর্ট অনুযায়ী, খামেনি যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন না। এই আলোচনাগুলি ইরানের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ এবং নতুন রাষ্ট্রপতি মাসুদ পেজেশকিয়ান পরিচালনা করেন। যদি এই রিপোর্টগুলি সত্যি হয়, তবে এটি একটি স্পষ্ট ইঙ্গিত যে ক্ষমতা এখন ধীরে ধীরে তাঁর হাত থেকে সরে যাচ্ছে।
ব্যক্তিত্বের অবক্ষয়
বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক আর্শ আজিজির মতে, খামেনি এখন কেবল তাঁর পুরনো ব্যক্তিত্বের ছায়া মাত্র। তাঁর ভাষণ দুর্বল ছিল এবং তাঁর মধ্যে নেতৃত্বের সেই শক্তি দেখা যায়নি যা আগে ছিল। এখন ক্ষমতা তেহরানের অভ্যন্তরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং গোষ্ঠীর মধ্যে ভাগ হয়ে যাচ্ছে এবং উত্তরাধিকার নিয়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দল বাড়তে পারে।
ইরানের সামনে একাধিক অভ্যন্তরীণ সংকট
দেশের ভিতরে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সংকট, জ্বালানির অভাব, দুর্নীতি এবং মুদ্রাস্ফীতি খামেনির ভাবমূর্তিকে আরও দুর্বল করেছে। তেহরানপন্থী গোষ্ঠী যেমন হামাস এবং হিজবুল্লাহর ভাবমূর্তিও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কমছে। সিরিয়ায় ইরানপন্থী বাশার আল-আসাদের অবস্থাও আগের মতো শক্তিশালী নেই। এই সবকিছু মিলে ইরানের 'প্রতিরোধ ব্লক'-কে দুর্বল করেছে।
২০২২-২৩ সালে যখন কঠোর পোশাকবিধির বিরুদ্ধে দেশজুড়ে বিক্ষোভ হয় এবং মাহসা আমিনি নিহত হন, তখন খামেনি সেই আন্দোলনকে দমন করতে কঠোরতা দেখিয়েছিলেন। কিন্তু এই ঘটনা আজও খামেনির ভাবমূর্তিকে মলিন করে এবং যুবকদের মধ্যে তাঁর প্রতি অসন্তোষ বাড়ায়।
উত্তরাধিকার নিয়ে অনিশ্চয়তা
খামেনির স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। ১৯৮১ সালে তিনি একটি হত্যা প্রচেষ্টায় আহত হয়েছিলেন, যার ফলে তাঁর ডান হাত কাজ করে না। তা সত্ত্বেও, ইরানে তাঁর উত্তরাধিকারী নিয়ে কোনো স্পষ্ট প্রক্রিয়া নেই। এই বিষয়ে জনসাধারণের আলোচনাও এক প্রকার নিষিদ্ধ। এমন পরিস্থিতিতে তাঁর অনুপস্থিতি বা দুর্বল অবস্থা ইরানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎকে অস্থির করতে পারে।