বেতালের গল্প: দয়ালু রাজা ও অনুতপ্ত ডাকাত

🎧 Listen in Audio
0:00

বেতাল গাছের ডালে আনন্দের সাথে ঝুলছিল, ঠিক তখনই বিক্রমাদিত্য সেখানে আবার এসে, তাকে গাছ থেকে নামিয়ে নিজের কাঁধে রেখে হাঁটা দিলেন। বেতাল আবার তার গল্প বলা শুরু করলো। অনেক পুরনো কথা। মধুপুরা রাজ্যে বৃষভানু নামের এক দয়ালু রাজা রাজত্ব করতেন। তিনি খুব বুদ্ধিমান শাসক ছিলেন, তাঁর প্রজারা শান্তিতে বসবাস করত। রাজ্যের ঠিক বাইরে একটি ঘন জঙ্গল ছিল। সেই জঙ্গলে ডাকাতদের একটি দল থাকত। যার নেতা ছিল উগ্রশীল। এই দলটি জঙ্গলের আশেপাশের গ্রামগুলোতে গিয়ে লুটপাট ও মারামারি করত। মধুপুরাবাসী সবসময় ভয়ে থাকত। রাজার পক্ষ থেকে ডাকাতদের ধরার সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গিয়েছিল।

ডাকাতরা সবসময় তাদের মুখের পাগড়ির প্রান্ত দিয়ে ঢেকে রাখত। যার ফলে তাদেরকে কেউ চিনতে পারত না। এইভাবে অনেক বছর কেটে গেল। উগ্রশীল এক সুন্দরী ও দয়ালু মহিলাকে ভালোবেসে বিয়ে করলো। সে উগ্রশীলের খারাপ কাজে তার সাথে যোগ দিত না। সে প্রায়ই তাকে শুধরানোর চেষ্টা করত, কিন্তু উগ্রশীল তার কথা শুনত না। কিছুদিন পর উগ্রশীল একটি পুত্রসন্তান লাভ করলো, যা তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। সে নম্র ও দয়ালু হতে শুরু করলো। পুত্রস্নেহের কারণে ডাকাতি করার পর সে মহিলাদের ও শিশুদের মারা বন্ধ করে দিল।

একদিন দুপুরে খাবার পর উগ্রশীল বিশ্রাম নেওয়ার সময় ঘুমিয়ে পড়ল। সে স্বপ্নে দেখল যে রাজার সৈন্যরা তাকে ধরে ফেলেছে এবং তার স্ত্রী ও সন্তানদের নদীতে ফেলে দিয়েছে। ভয়ে আঁতকে সে জেগে উঠল, শরীর ঘামে ভিজে গিয়েছিল। সেই মুহূর্তেই উগ্রশীল সিদ্ধান্ত নিল যে, সে এই কাজ ছেড়ে দিয়ে সৎ জীবন কাটাবে। সে তার দলের লোকেদের ডেকে তার ইচ্ছার কথা জানাল। দলের লোকেরা একসুরে বলল, “সর্দার, আপনি এমন করতে পারেন না। আপনাকে ছাড়া আমরা কী করব?” উগ্রশীলের এই সিদ্ধান্তে সবাই অসন্তুষ্ট হলো এবং উগ্রশীলকে মারার পরিকল্পনা করতে লাগল।

নিজের ও নিজের পরিবারের জীবন বাঁচানোর জন্য উগ্রশীল সেই রাতেই জঙ্গল থেকে পালিয়ে রাজমহলে পৌঁছল। নিজের স্ত্রী ও সন্তানদের বাইরে রেখে, দেওয়াল টপকে জানালার পথে সে রাজার বিশ্রামকক্ষে পৌঁছল এবং রাজার পায়ে পড়ে ক্ষমা চাইতে লাগল। রাজা হড়বড়িয়ে উঠে চিৎকার করে বললেন, “সৈনিকরা! চোর চোর” বলে চিৎকার করলেন। সৈন্যরা তৎক্ষণাৎ এসে উগ্রশীলকে ধরে ফেলল। উগ্রশীল হাত জোড় করে বিনীত স্বরে বলল, “মহারাজ, আমি চোর নই। আমি আমার ভুল শুধরাতে এবং আপনার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি। আমার স্ত্রী ও আমার পুত্র সাথে আছে, তাদের রাখার মতো আমার কাছে কোনো জায়গা নেই। আমি আপনাকে সব সত্যি কথা বলব।”

উগ্রশীলের চোখে জল এবং কথায় সত্যি দেখে রাজা তাকে ছেড়ে দেওয়ার আদেশ দিলেন। তার কাছ থেকে সব কথা শুনে রাজা তাকে মোহর ভর্তি একটি ছোট থলি দিলেন এবং বললেন, “এই নাও, এবার তুমি এর দ্বারা সৎ জীবন শুরু করো। তুমি মুক্ত এবং যেখানে ইচ্ছা যেতে পারো। প্রতিজ্ঞা করো যে, এক বছর পর তুমি আসবে এবং আমাকে জানাবে যে, তুমি ভুল পথে চলা ছেড়ে দিয়েছ।” উগ্রশীলের আনন্দের সীমা ছিল না। সে সজল চোখে রাজার পায়ে হাত দিয়ে থলিটি নিল এবং সেই রাতেই তার পরিবারের সাথে শহর ছেড়ে অন্য কোথাও চলে গেল।

বেতাল রাজা বিক্রমাদিত্যকে জিজ্ঞাসা করল, “রাজন, তোমার কী মনে হয়, রাজা সেই নিষ্ঠুর ডাকাতকে মুক্ত করে ঠিক কাজ করেছেন?” বিক্রমাদিত্য জবাব দিলেন, “রাজা বৃষভানুর উদার ব্যবহার তার দয়ালুতা ও বুদ্ধিমত্তার খুব ভালো উদাহরণ। রাজার প্রধান উদ্দেশ্য হল দোষীকে তার ভুল বুঝতে সাহায্য করা। যেহেতু উগ্রশীল নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিল, তাই রাজার ক্ষমা করাটা উচিত ছিল। এমন করে তিনি একটি উদাহরণ স্থাপন করলেন। সম্ভবত এই দৃষ্টান্ত শুনে অন্য ডাকাতরাও আত্মসমর্পণের জন্য প্রস্তুত হবে।”

বিক্রমাদিত্যের উত্তরে সন্তুষ্ট হয়ে বেতাল তৎক্ষণাৎ উড়ে গিয়ে গাছে বসল এবং রাজা আবার বেতালকে নেওয়ার জন্য গাছের দিকে রওনা হলেন।

Leave a comment