কিশোর কুমার: সংগ্রাম থেকে সাফল্যের অমর কাহিনী

🎧 Listen in Audio
0:00

ভারতীয় চলচ্চিত্র ও সংগীত জগতে অনেক মহান শিল্পী হয়েছেন, কিন্তু কিছু ব্যক্তিত্ব এমন আছে যারা তাদের বহুমুখী প্রতিভা ও অসাধারণ ব্যক্তিত্বের কারণে সর্বকালের জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। কিশোর কুমার এমনই একজন মহান ব্যক্তিত্ব ছিলেন, যিনি কেবল প্লেব্যাক গানে তাঁর কণ্ঠের জাদু ছড়িয়েছেন তাই নয়, অভিনয়, পরিচালনা এবং সংগীত পরিচালনায়ও নিজের আলাদা পরিচয় তৈরি করেছেন। তাঁর ব্যক্তিত্ব ও কাজের ধরণ আজও চলচ্চিত্র ও সংগীতপ্রেমীদের হৃদয়ে জীবন্ত।

প্রাথমিক জীবন ও সংগ্রাম

কিশোর কুমারের জন্ম ৪ আগস্ট ১৯২৯ সালে মধ্যপ্রদেশের খান্ডোয়া শহরে। তাঁর আসল নাম ছিল অভাস কুমার গাঙ্গুলি। পরিবারে তিনি চার ভাইবোনের মধ্যে চতুর্থ। কিশোর কুমার কখনও তাঁর শিকড় থেকে দূরে সরে যাননি, এবং প্রায়শই গর্বের সাথে তাঁর জন্মভূমি খান্ডোয়ার উল্লেখ করতেন। শৈশবে দারিদ্র্য ও সংগ্রামের মধ্যেও তিনি হাল ছাড়েননি। ইন্দোরের ক্রিশ্চিয়ান কলেজে পড়াশোনার সময় তাঁর কাছে টাকার অভাব ছিল, কিন্তু তাঁর সাহস ও ইতিবাচক চিন্তাধারা তাঁকে সর্বদা এগিয়ে যেতে উৎসাহিত করেছে।

পড়াশোনার সময় কলেজের ক্যান্টিন থেকে ধার করে খাবার কেনার অভ্যাস ছিল। এই ছোট ছোট ঘটনাগুলি তাঁর ব্যক্তিত্বের ছবি স্পষ্ট করে—একজন সরল, সহজ ও নির্ভীক মানুষ যিনি কঠিন সময়েও সংগীত ও হাসি কে সাথে রাখতেন।

অভিনয় ও সংগীতের সূচনা

কিশোর কুমার ১৯৪৬ সালে ‘শিকারী’ চলচ্চিত্র দিয়ে অভিনয় জীবনের সূচনা করেন। সে সময় তাঁর বড় ভাই অশোক কুমার বলিউডের সফল অভিনেতা ছিলেন। কিশোর কুমারকে প্রথমদিকে গায়ক হিসেবে পরিচয় মেলেনি। ১৯৪৮ সালে ‘জিদ্দি’ চলচ্চিত্রে তাঁর প্রথম গানের চেষ্টা হয়, কিন্তু তা সফলতার সিঁড়ি হতে পারেনি। তিনি অভিনয় ও গান দুটোতেই পরিশ্রম করেছেন। ১৯৫১ সালে তিনি ‘আন্দোলন’ চলচ্চিত্রের নায়ক হন, কিন্তু ছবিটি ব্যর্থ হয়।

তাঁর বড় সাফল্য আসে ১৯৫৪ সালে বিমল রায়ের ‘নৌকরি’ চলচ্চিত্রে একজন বেকার যুবকের ভূমিকা দিয়ে, যা দর্শকদের হৃদয়ে তাঁর অভিনয় প্রতিভাকে স্থান করে দেয়। পরবর্তীতে ‘চলতি কা নাম গাড়ি’ ইত্যাদি চলচ্চিত্র তাঁকে অভিনেতা হিসেবে আরও জনপ্রিয় করে তোলে।

গানের জাদুকরী দুনিয়া

কিশোর কুমার সংগীতের ক্ষেত্রে যে পরিচয় পেয়েছিলেন, তা তাঁর অনন্য কণ্ঠ ও ভাবপূর্ণ গানের কারণে। তিনি হিন্দির পাশাপাশি তামিল, মারাঠি, অসমীয়া, গুজরাটি, কন্নড়, ভোজপুরী, মালয়ালম, উড়িয়া এবং উর্দু সহ অনেক ভাষায় গান গেয়েছেন। তিনি প্রায় ১৬,০০০ এর বেশি গান গেয়ে একটি রেকর্ড গড়েছেন, যা আজও কারো পক্ষে সহজ নয়।

তাঁর গান শুধু সংগীত ছিল না, বরং অনুভূতির সমুদ্র ছিল। রোমান্টিক গান হোক বা হাস্যরসাত্মক গান, প্রতিটি ধরণের গানে কিশোর কুমারের কণ্ঠ দর্শকদের হৃদয় স্পর্শ করেছে। তিনি এস.ডি. বর্মন, আর.ডি. বর্মন-এর মতো মহান সংগীত পরিচালকদের সাথে মিলিত হয়ে এমন সুর দিয়েছেন যা সর্বকালের জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ‘তেরা মস্তানা পিয়ার মেরা দিওয়ানা’, ‘ফান্টুশ’-এর ‘দুখী মান মেরে’, ‘ঝুমরু’ ইত্যাদি গান আজও মানুষের মনে বসবাস করছে।

প্লেব্যাক গায়ক থেকে মহানায়ক পর্যন্ত যাত্রা

যখন কিশোর কুমার প্লেব্যাক গানে পদার্পণ করেন, তখন তাঁর সমসাময়িকদের মধ্যে মুকেশ, মন্না দে, মোহাম্মদ রফি-এর মতো दिग्गज গায়কদের আধিপত্য ছিল। তারপরও তিনি নিজের আলাদা পরিচয় তৈরি করেছেন। তাঁর কণ্ঠে এক ধরণের জাদু ছিল যা দেব আনন্দ, রাজেশ খান্না, অমিতাভ বচ্চন-এর মতো বহু বড় অভিনেতার ব্যক্তিত্বের সাথে এত গভীরে মিশে যেত যে শ্রোতা বিশ্বাসই করতে পারত না যে এটি অন্য কারো কণ্ঠ।

কিশোর কুমার কেবল গায়কই ছিলেন না, বরং একজন সফল অভিনেতা ও পরিচালক হিসেবেও নিজের ছাপ রেখেছেন। তিনি ৮১টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন এবং ১৮টি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন। ‘পড়োশন’ চলচ্চিত্রে তাঁর অভিনীত মস্ত-মৌলা চরিত্র আজও হাস্যরসপ্রেমীদের হৃদয়ে অমর।

ব্যক্তিগত জীবনের উত্থান-পতন

কিশোর কুমারের ব্যক্তিগত জীবনও তাঁর চলচ্চিত্র ও গানের মতো রঙিন ও জটিল ছিল। তিনি চারবার বিবাহ করেছিলেন। তাঁর প্রথম বিবাহ হয় বাংলা অভিনেত্রী রুমা গুহ ঠাকুরতা-র সাথে, যা ১৯৫০ থেকে ১৯৫৮ পর্যন্ত স্থায়ী হয়। দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন মধুবালা, যার সাথে তাঁর বিবাহ হয় ১৯৬০ সালে। মধুবালার স্বাস্থ্যগত কারণ ও পারিবারিক মতবিরোধ সত্ত্বেও এই সম্পর্ক তাঁর জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। মধুবালার মৃত্যুর পর কিশোর কুমার যোগিতা বালি-র সাথে বিবাহ করেন, যা অল্প সময়ের জন্য স্থায়ী হয়। অবশেষে তিনি লিনা চন্দাওয়ারকারের সাথে বিবাহ করেন।

তাঁর ব্যক্তিগত জীবন কঠিনতায় পূর্ণ ছিল, কিন্তু তিনি কখনও তাঁর সংগীত ও অভিনয়ের আবেগকে দুর্বল হতে দেননি।

আপাতকাল ও সামাজিক প্রতিশ্রুতি

১৯৭৫ সালের আপাতকালীন সময়ে কিশোর কুমার সরকারের অনেক চাপের মুখোমুখি হন। তিনি সরকারি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকেন, যার ফলে তাঁর গানে আকাশবাণীতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় এবং তাঁর বাড়িতে আয়কর বিভাগের তল্লাশি হয়। তারপরও তিনি আপাতকালের সমর্থন করেননি। এটি তাঁর স্বাধীন চিন্তাধারা ও সত্যের প্রতি প্রতিশ্রুতির প্রমাণ ছিল।

সংগ্রাম থেকে সাফল্যের গল্প

কিশোর কুমারের যাত্রা সহজ ছিল না। যখন তিনি তাঁর কর্মজীবনের শুরু করছিলেন, তখন তাঁর পরিবারের বড় ভাই ও সমসাময়িক শিল্পীরা ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। সংগীত ও চলচ্চিত্র জগতে প্রতিযোগিতা এত তীব্র ছিল যে নবীন শিল্পীদের জন্য নিজের জায়গা তৈরি করা কঠিন ছিল। কিন্তু কিশোর কুমার তাঁর আবেগ, পরিশ্রম ও প্রতিভার মাধ্যমে প্রতিটি বাধা পেরিয়ে গেছেন। তিনি তাঁর কণ্ঠকে প্রতিটি অভিনেতার ব্যক্তিত্বের সাথে মানিয়ে নিয়েছেন এবং প্রতিটি গানকে জীবন্ত করে তুলেছেন।

তাঁর প্রতি সম্মান ও ঐতিহ্য

কিশোর কুমার আটবার ফিল্মফেয়ার পুরস্কারে ভূষিত হন, যা একটি কীর্তি। মধ্যপ্রদেশ সরকার তাঁকে লতা মঙ্গেশকর পুরস্কারে সম্মানিত করে এবং পরে তাঁর নামে ‘কিশোর কুমার পুরস্কার’ প্রতিষ্ঠা করে। তাঁর গানের ধরণ, অভিনয় ও জীবনযাত্রা আজও অনেক শিল্পী ও সংগীতপ্রেমীদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস।

কিশোর কুমার শুধু একজন শিল্পী ছিলেন না, বরং একজন সম্পূর্ণ শিল্পী ছিলেন যিনি তাঁর বহুমুখী প্রতিভার মাধ্যমে হিন্দি চলচ্চিত্র ও সংগীতকে অমর করেছেন। তাঁর কণ্ঠে লুকিয়ে থাকা জাদু, তাঁর অভিনয়, তাঁর ব্যক্তিত্ব এবং তাঁর সংগ্রাম আমাদের শেখায় যে পরিশ্রম ও ধৈর্য্যের মাধ্যমে প্রতিটি কঠিন কাজকে জয় করা সম্ভব। তিনি আজও ভারতীয় সংগীত ও চলচ্চিত্রের ইতিহাসের মহানায়ক, যাঁর ঐতিহ্য যুগ যুগ ধরে স্মরণ করা হবে।

Leave a comment