যখনই ভারতের আধুনিক উন্নয়নের ভিত্তির কথা উঠে, তখনই সবার আগে এক নাম মনে পড়ে—রাজীব গান্ধী। ভারতের সবচেয়ে যুব প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাজীব গান্ধী কেবল একজন নেতা ছিলেন না, বরং একজন দূরদর্শী ব্যক্তিত্বও ছিলেন, যিনি বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, শিক্ষা এবং গণতান্ত্রিক সবলীকরণের মতো ক্ষেত্রে দূরদর্শী সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে দেশকে নতুন দিক দিয়েছিলেন। ২১শে মে তাঁর পুণ্যতিথির দিনে আসুন জেনে নেই তাঁর পাঁচটি সবচেয়ে বড় অবদান, যা ভারতের চিত্রই বদলে দিয়েছে।
ডিজিটাল বিপ্লবের ভিত্তি স্থাপন
আজ যার ডিজিটাল ইন্ডিয়ার কথা বলা হয়, তার ভিত্তি রাজীব গান্ধী ১৯৮০-এর দশকেই স্থাপন করেছিলেন। তিনি ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন যে ভারতকে যদি বিশ্বমঞ্চে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়, তাহলে তথ্য প্রযুক্তি (IT) এবং দূরসংযোগে আত্মনির্ভরতা অপরিহার্য।
এই চিন্তাধারার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৮৪ সালে তিনি C-DOT (Centre for Development of Telematics)-এর প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রতিষ্ঠানটি দেশজুড়ে টেলিফোন নেটওয়ার্কের সম্প্রসারণ শুরু করে। ফলশ্রুতিতে দূরবর্তী গ্রামগুলিতেও যোগাযোগ সুবিধা পৌঁছে যায় এবং গ্রামের মানুষও দেশ-বিদেশের সাথে যুক্ত হতে শুরু করে।
MTNL (Mahanagar Telephone Nigam Limited)-এর সূচনা ১৯৮৬ সালে তাঁরই উদ্যোগে হয়, যার মাধ্যমে নগর টেলিফোন সেবাগুলিকে ব্যবস্থাপিত করা হয়। আজ ভারত যার মোবাইল এবং ইন্টারনেট বিপ্লবে গর্ব করে, তার ভিত্তি রাজীব গান্ধী অনেক আগেই স্থাপন করেছিলেন।
কম্পিউটারকে সাধারণ জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়া
এক সময় ভারতে কম্পিউটারকে চাকরির শত্রু বলে মনে করা হত। কিন্তু রাজীব গান্ধী এই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে কম্পিউটারের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন।
তিনি বিজ্ঞানী স্যাম পিত্রোদার সাথে মিলে দেশে কম্পিউটার বিপ্লবের সূচনা করেন। কম্পিউটার হার্ডওয়্যারের আমদানি শুল্ক কমিয়ে দেওয়া হয় যাতে তা সস্তা হয় এবং আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছায়।
ভারতীয় রেলওয়েতে কম্পিউটারের মাধ্যমে টিকিট বুকিং, সরকারি দপ্তরের ডিজিটাইজেশন এবং ব্যাংকিং সেবায় প্রযুক্তিগত উন্নয়ন—এগুলি সবই তাঁর চিন্তাধারার ফল।
কম্পিউটার শিক্ষাকে উৎসাহিত করার জন্য স্কুলের পাঠ্যক্রমে কম্পিউটার যুক্ত করা হয় এবং প্রযুক্তিগত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে শক্তিশালী করা হয়।
১৮ বছরে ভোট দেওয়ার অধিকার
রাজীব গান্ধী যুব ভারতের শক্তিতে পূর্ণ আস্থা রাখতেন। সে সময় ভারতে ভোট দেওয়ার বয়স ছিল ২১ বছর, যা তিনি কমিয়ে ১৮ বছর করে দেন।
১৯৮৯ সালে ৬১তম সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে তিনি কোটি কোটি যুবককে রাজনৈতিক অংশগ্রহণের অধিকার দেন। এতে কেবলমাত্র যুবকদের গণতন্ত্রে অংশগ্রহণের সুযোগই হয়নি, বরং দেশের রাজনীতিতে নতুন শক্তি ও দৃষ্টিভঙ্গি এসেছে।
এই সিদ্ধান্তটি যুবকদের রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালনের জন্য অনুপ্রাণিত করে এবং গণতন্ত্রকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক করে তোলে।
পঞ্চায়েত রাজকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি
রাজীব গান্ধীর সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক সাফল্যের মধ্যে একটি হল পঞ্চায়েত রাজ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ। তাঁর বিশ্বাস ছিল যে যতক্ষণ না গ্রামের মানুষ নিজেরাই নিজেদের উন্নয়নের সিদ্ধান্ত নেবে, ততক্ষণ সত্যিকারের গণতন্ত্র আসবে না।
তিনি পঞ্চায়েত রাজ নিয়ে ৬৪তম সংবিধান সংশোধন বিল প্রস্তুত করান। যদিও তাঁর জীবদ্দশায় এই আইনটি হয়নি, কিন্তু তাঁর চিন্তাধারার ভিত্তিতে ১৯৯২ সালে ৭৩তম এবং ৭৪তম সংবিধান সংশোধন पारিত হয়, যার ফলে পঞ্চায়েতগুলিকে সাংবিধানিক মর্যাদা দেওয়া হয়।
এর পর ২৪শে এপ্রিল ১৯৯৩ থেকে সারা দেশে পঞ্চায়েত নির্বাচন বাধ্যতামূলক হয় এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ হয়। আজ গ্রামে সরপঞ্চ থেকে ব্লক প্রধান পর্যন্ত সরাসরি অংশগ্রহণ এই চিন্তাধারারই ফল।
জওহর নবোদয় বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা
রাজীব গান্ধী শিক্ষার শক্তিতেও গভীর বিশ্বাস রাখতেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল যে প্রতিভা কেবল শহরেই নয়, গ্রামেও জন্ম নেয় এবং তাকে উপযুক্ত সুযোগ পাওয়া উচিত।
১৯৮৬ সালে তিনি জাতীয় শিক্ষানীতি (National Education Policy) ঘোষণা করেন এবং তার অধীনে জওহর নবোদয় বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেন।
এই আবাসিক বিদ্যালয়গুলি দেশজুড়ে গ্রামীণ অঞ্চলে স্থাপিত হয়, যেখানে প্রবেশ পরীক্ষার মাধ্যমে নির্বাচিত মেধাবী শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে শিক্ষা, খাবার এবং থাকার সুবিধা দেওয়া হয়।
আজ দেশজুড়ে ৫৫০-এর বেশি নবোদয় বিদ্যালয় চালু আছে, যেখানে লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী শিক্ষা লাভ করছে। রাজীব গান্ধীর দূরদর্শিতার ফলেই দেশের পিছিয়ে থাকা এলাকা থেকে বেরিয়ে আজ অনেক শিক্ষার্থী বিশ্বমঞ্চে দেশের নাম উজ্জ্বল করছে।
রাজীব গান্ধী যদিও এক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি যে বীজ বপন করেছিলেন, সেগুলি আজ বিশাল বৃক্ষে পরিণত হয়েছে। তাঁর চিন্তাধারা কেবল বর্তমানকে নয়, আগামী ভবিষ্যৎকেও গড়ে তোলার মতো ছিল। তিনি প্রযুক্তি, শিক্ষা, গণতন্ত্র এবং যুবকদের ক্ষেত্রে এমন ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন, যা আজও ভারতের উন্নয়নের মেরুদণ্ড হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।