আমরা সকলেই জানি এবং বুঝি যে স্বাধীন ভারতে আমরা যে স্বাধীনতার নিঃশ্বাস নিচ্ছি, তা আমাদের গর্বে ভরিয়ে তোলে। এই স্বাধীনতার সংগ্রামে বহু মহান ব্যক্তি তাঁদের সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছেন। কেউ কঠোর কারাবাস সহ্য করেছেন, কেউ শহীদ হয়েছেন এবং কেউ হাসতে হাসতে ফাঁসির মুখোমুখি হয়েছেন। Subkuz.com আপনাদের জন্য এমনই কিছু নায়কের গল্প নিয়ে আসে। আজ আমরা পাঞ্জাব কেশরী শ্রী লালা লাজপত রায়ের জীবন নিয়ে আলোচনা করব।
লালা লাজপত রায় পরাধীন ভারতকে স্বাধীন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের তিন প্রধান নেতার মধ্যে একজন ছিলেন, যাঁদের লাল-বাল-পাল নামে জানা যেত। লালা লাজপত রায় শুধু একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক, সাহসী স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং একজন মহান নেতাই ছিলেন না, সেইসঙ্গে তিনি ছিলেন একজন প্রখর লেখক, আইনজীবী, সমাজ সংস্কারক এবং আর্য সমাজের অনুসারী। ভারত ভূমি চিরকাল বীরদের জন্ম দিয়েছে। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে বহু বীর যোদ্ধা উঠে এসেছেন, যাঁরা দেশের স্বাধীনতার জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করতেও পিছপা হননি। এমনই এক বীর সন্তান ছিলেন পাঞ্জাবের সিংহ লালা লাজপত রায়। তিনি ছিলেন ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের এক মহান যোদ্ধা, যিনি দেশের সেবায় নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, তাঁর জীবনের প্রতিটি কণা দেশের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন।
জন্ম ও প্রাথমিক জীবন:
লালা লাজপত রায় ১৮৬৫ সালের ২৮ জানুয়ারি পাঞ্জাব প্রদেশের মোগা জেলায় একটি বৈশ্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মা, গোলাপ দেবী, ছিলেন একটি শিখ পরিবারের, অন্যদিকে তাঁর বাবা, লালা রাধাকৃষ্ণন, উর্দু ও ফার্সি ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন এবং লুধিয়ানার বাসিন্দা ছিলেন। তাঁর বাবা প্রার্থনা ও উপবাসের মুসলিম ধর্মীয় রীতি অনুসরণ করতেন। তিনি ছিলেন তাঁর পিতামাতার জ্যেষ্ঠ পুত্র।
শিক্ষা:
লালা লাজপত রায়ের বাবা সরকারি হাই স্কুলের শিক্ষক ছিলেন, তাই সেখানেই তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। তিনি ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ছাত্র ছিলেন। স্কুল শিক্ষা শেষ করার পর তিনি ১৮৮০ সালে লাহোরের সরকারি কলেজে আইন পড়ার জন্য ভর্তি হন এবং আইন বিষয়ে পড়াশোনা সম্পন্ন করেন। ১৮৮২ সালে তিনি আইন এবং মুখতার (জুনিয়র উকিল) পরীক্ষা একই সাথে পাশ করেন। কলেজের দিনগুলিতে তিনি লাল হংসরাজ এবং পণ্ডিত গুরু দত্তের মতো জাতীয়তাবাদী ব্যক্তিত্ব ও স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সংস্পর্শে আসেন। লাজপত রায় ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারতকে মুক্ত করার জন্য বিপ্লবী পদ্ধতি গ্রহণের সমর্থক ছিলেন। তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নীতিগুলির বিরোধিতা করেছিলেন, কারণ তিনি মনে করতেন তাদের নীতির নেতিবাচক প্রভাব ছিল। তিনি পূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে সওয়াল করেছিলেন। তিনি পূর্ণ স্বরাজের ওকালতিও করেছিলেন।
রাজনৈতিক জীবন:
১৮৮৮ সালে তিনি প্রথমবার এলাহাবাদে কংগ্রেস অধিবেশনে অংশ নেন। ১৯০৫ সালে যখন ইংরেজরা বাংলা ভাগ করে, তখন লাজপত রায় সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি ও বিপিন চন্দ্র পালের সঙ্গে হাত মেলান এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে। তিনি দেশজুড়ে স্বদেশী আন্দোলনের সক্রিয় নেতৃত্ব দেন। ১৯০৬ সালে, তিনি কংগ্রেস প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসাবে গোপাল কৃষ্ণ গোখলের সাথে ইংল্যান্ডে যান। সেখান থেকে তিনি আমেরিকাতে চলে যান। ১৯০৭ সালে সরকার তাঁকে সর্দার অজিত সিং-এর সঙ্গে বার্মার মান্ডেলেতে নির্বাসিত করে। তিনি ছিলেন কংগ্রেসের চরমপন্থী গোষ্ঠীর প্রধান নেতাদের মধ্যে একজন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি পুনরায় কংগ্রেস প্রতিনিধি দলের সাথে ইংল্যান্ডে যান। সেখান থেকে তিনি জাপান এবং তারপর আমেরিকাতে যান। ১৯২০ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি যখন তিনি ভারতে ফিরে আসেন, তখন জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড হয়ে গেছে। ১৯২০ সালে নাগপুরে অনুষ্ঠিত অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্টস ফেডারেশনের সভাপতি হিসাবে তিনি ছাত্রদের জাতীয় আন্দোলনে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। ১৯২৫ সালে, তিনি হিন্দু মহাসভার কলকাতা অধিবেশনের সভাপতি নিযুক্ত হন। ১৯২৬ সালে তিনি জেনেভাতে দেশের শ্রমিক প্রতিনিধি হন।
সামাজিক কাজ:
লালা লাজপত রায় শুধু তাঁর রাজনৈতিক অবদানের জন্যই স্মরণীয় নন, সেইসঙ্গে তিনি তাঁর সামাজিক কাজের জন্যও স্মরণীয়। ১৮৯৬ থেকে ১৮৯৯ সাল পর্যন্ত উত্তর ভারতে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময় তিনি ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের সাহায্য করেন। তিনি সেই শিশুদের বাঁচিয়েছিলেন যাদের খ্রিস্টান ধর্মে রূপান্তরিত করা হচ্ছিল এবং তাদেরকে ফিরোজপুর ও আগ্রার আর্য অনাথ আশ্রমে পাঠান। ১৯০৫ সালে কাংড়াতে আসা ভয়াবহ ভূমিকম্পের সময় তিনি মানুষের সেবা করেন এবং ত্রাণ পৌঁছে দেন। ১৯০৭-০৮ সালে যুক্ত প্রদেশ এবং মধ্য প্রদেশে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময় তিনি আবারও মানুষের সাহায্য করেন।
ছোটবেলার মজার গল্প:
একবার স্কুলের পক্ষ থেকে পিকনিকের আয়োজন করা হয়েছিল এবং লালা লাজপত রায়কে সেখানে যেতে হত। যদিও, পিকনিকের জন্য তাঁর কাছে টাকা ছিল না এবং তাঁর পরিবারের কাছে তাঁর জন্য খাবার তৈরি করার মতো সংস্থানও ছিল না। তাঁর বাবা তাঁর ছেলের মন ভাঙতে চাননি। যখন তাঁর বাবা প্রতিবেশীর কাছ থেকে ঋণ চাইতে গিয়েছিলেন, তখন লালা লাজপত রায় তাঁদের কথোপকথন শুনে ফেলেন। তিনি তাঁর বাবাকে বলেন যে তাঁর ঋণ নেওয়ার দরকার নেই, কারণ তিনি এমনিতেও পিকনিকে যেতে চান না। যদি তাঁর যাওয়ার খুব দরকার হত, তাহলে বাড়িতে খেজুর থাকত এবং তিনি সেটাই নিয়ে যেতেন। তিনি টাকা ধার করে লোক দেখানো করতে চাননি।
মৃত্যু:
১৯২৮ সালের ৩০শে অক্টোবর যখন সাইমন কমিশন লাহোরে পৌঁছায়, তখন তিনি এর বিরুদ্ধে এক বিশাল বিক্ষোভের নেতৃত্ব দেন, যে সময় তাঁর উপর লাঠিচার্জ করা হয়, যার কারণে তিনি গুরুতর আহত হন। ফলস্বরূপ, ১৯২৮ সালের ১৭ই নভেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুতে সারা দেশে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে, যার কারণে ১৯২৮ সালের ১৭ই ডিসেম্বর ব্রিটিশ পুলিশ অফিসার সন্ডার্সকে হত্যা করা হয়।
```