ডঃ ভারগীজ কুরিয়ান: ভারতের ‘শ্বেত বিপ্লব’ের জনক

🎧 Listen in Audio
0:00

ভারতকে যখনই কৃষি ও দুগ্ধক্ষেত্রে আত্মনির্ভরতার উদাহরণ হিসেবে দেখা হয়, তখনই সবার আগে একজনের নাম মনে পড়ে – ডঃ ভারগীজ কুরিয়ান। তিনি কেবল ‘শ্বেত বিপ্লব’-এর জনকই ছিলেন না, বরং গ্রামীণ ভারতকে অর্থনৈতিকভাবে সবল করার জন্য একটি শক্তিশালী সমবায় আন্দোলনের ভিত্তিও স্থাপন করেছিলেন। তাঁর জীবন সংগ্রাম, দূরদর্শিতা ও দেশপ্রেমের এক অনন্য উদাহরণ। আসুন জেনে নেই, কীভাবে একজন সাধারণ ইঞ্জিনিয়ার ভারতকে বিশ্বের সর্ববৃহৎ দুগ্ধ উৎপাদক দেশে পরিণত করেছিলেন।

শুরু: যেখান থেকে পরিবর্তন শুরু

ডঃ ভারগীজ কুরিয়ানের জন্ম ২৬ নভেম্বর ১৯২১ সালে কেরালার কোঝিকোড়ে (তৎকালীন মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি) একটি সিরিয়ান খ্রিস্টান পরিবারে। তাঁর শিক্ষা-দীক্ষা ছিল পদার্থবিজ্ঞান ও যান্ত্রিক প্রকৌশলে। মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে যান্ত্রিক প্রকৌশলে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করে তিনি ভারতে ফিরে আসেন। তাঁকে গুজরাটের আনন্দ শহরের একটি সরকারি ক্রিমারিতে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু এটি কেবল একটি চাকরি ছিল না – এটি ছিল ভারতীয় গ্রামবাসীদের ভাগ্য পরিবর্তনের সূচনা।

যখন ডঃ কুরিয়ান কৃষকদের পথ বেছে নেন

ভারতে ফিরে এসে ডঃ কুরিয়ানের সঙ্গে ত্রিভুবনদাস প্যাটেলের দেখা হয়, যিনি খেড়া জেলার কৃষকদের সংগঠিত করে দুগ্ধ সমবায় সংস্থা পরিচালনা করছিলেন। ডঃ কুরিয়ান এই ক্ষুদ্র আন্দোলনকে জাতীয় পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার সঙ্কল্প নেন। এখান থেকেই ‘অমুল’-এর জন্ম – ভারতের সবচেয়ে সফল ডেইরি ব্র্যান্ড। তিনি কেবল দুধ বিক্রি করতে শেখাননি, বরং কৃষকদের তাদের পরিশ্রমের পুরো মূল্য পেতে শেখান।

অমুল: নাম নয়, আন্দোলন

১৯৪৬ সালে শুরু হওয়া অমুল আন্দোলন কেবল একটি সমবায় সংস্থা নয়, বরং গ্রামীণ সবলীকরণের জীবন্ত উদাহরণ। ডঃ কুরিয়ান কেবল কৃষকদের একত্রিত করেননি, বরং প্রযুক্তিগত ও বৈজ্ঞানিক সম্পদের মাধ্যমে তাদের সবল করে তুলেছেন। তিনি ভেড়ার দুধ থেকে মিল্ক পাউডার তৈরির প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেন, যা বিশ্বে একটি অনন্য প্রয়াস ছিল। এর ফলে ভারত, যা একসময় দুধের জন্য বিদেশি আমদানির উপর নির্ভরশীল ছিল, কয়েক বছরের মধ্যেই দুগ্ধ উৎপাদনে আত্মনির্ভর হয়ে ওঠে।

অপারেশন ফ্লাড: ‘বিলিয়ন লিটার আইডিয়া’র সূচনা

১৯৭০ সালে জাতীয় ডেইরি উন্নয়ন বোর্ড (NDDB) স্থাপিত হয় এবং ডঃ কুরিয়ানকে এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি করা হয়। এখান থেকেই শুরু হয় ‘অপারেশন ফ্লাড’ – অর্থাৎ ‘শ্বেত বিপ্লব’। এই পরিকল্পনা গ্রামে গ্রামে দুগ্ধ সরবরাহের নেটওয়ার্ককে শক্তিশালী করে এবং শহরগুলিতে দুধের সরবরাহ নিশ্চিত করে। এর ফলে কেবল দুধের উৎপাদনই বৃদ্ধি পায়নি, বরং গ্রামীণ অর্থনীতিতেও নতুন প্রাণ সঞ্চারিত হয়।

সম্মান ও পুরষ্কারের ঝড়

ডঃ কুরিয়ান ভারত ও বিশ্বব্যাপী অনেক পুরষ্কারে ভূষিত হন। তাঁকে পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ, পদ্মবিভূষণ প্রভৃতি ভারতের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মানে ভূষিত করা হয়। এছাড়াও তিনি রামন ম্যাগসেসে পুরষ্কার, বিশ্ব খাদ্য পুরষ্কার, ওয়াল্টার পিস প্রাইজ প্রভৃতি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেন। কিন্তু তাঁর সর্ববৃহৎ পুরষ্কার ছিল – কোটি কোটি কৃষকের হাসি।

‘দ্য ম্যান হু মেড এলিফ্যান্ট ড্যান্স’: আত্মজীবনীতে লুকিয়ে থাকা জীবনের সূত্র

ডঃ কুরিয়ান তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতা ‘আই টু হ্যাড এ ড্রিম’ নামক আত্মজীবনীতে লিখেছেন। এই বইটি কেবল একজন মানুষের সাফল্যের গল্প নয়, বরং এটি বলে যে, কীভাবে একজন ব্যক্তি, যদি সততা ও দূরদর্শিতার সাথে কাজ করে, তাহলে তিনি সমগ্র দেশের দিক পরিবর্তন করতে পারেন।

জনপ্রিয় সংস্কৃতিতেও অমূল্য অবদান

শ্যাম বেনেগাল পরিচালিত ‘মন্থন’ ছবিটি ডঃ কুরিয়ানের জীবন ও আন্দোলনের উপর ভিত্তি করে নির্মিত। এর বিশেষত্ব হল, এই ছবিটি ৫ লক্ষ কৃষক ২-২ টাকা করে অবদান দিয়ে তৈরি করেছিলেন। এটি বিশ্বের প্রথম এমন চলচ্চিত্র ছিল যা কৃষকদের অর্থায়নে নির্মিত হয়েছিল। ছবিটি জাতীয় পুরষ্কার জিতেছে এবং সমবায়ের ধারণাকে জন-জনের কাছে পৌঁছে দিয়েছে।

ঐতিহ্য যা আজও জীবন্ত

ডঃ কুরিয়ানের মৃত্যু হয় ৯ সেপ্টেম্বর ২০১২ সালে, কিন্তু তাঁর প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলি – অমুল, NDDB, IRMA – আজও লক্ষ লক্ষ কৃষককে আত্মনির্ভর করে তুলছে। তিনি শিখিয়েছেন যে, উন্নয়ন কেবল শহরের নয়, গ্রামেরও হওয়া উচিত। তাঁর জীবন আমাদের এমন একটা অনুপ্রেরণা দেয় যে, যদি চিন্তাভাবনায় সততা থাকে এবং উদ্দেশ্যে জনকল্যাণ থাকে, তাহলে কোন কাজই অসম্ভব নয়।

ভারগীজ কুরিয়ান ভারতকে দুধে আত্মনির্ভর করে তুলেছিলেন, কিন্তু তাঁর সর্ববৃহৎ অবদান ছিল তিনি কৃষকদের বিশ্বাস দিয়েছিলেন, তাদের হাতে ক্ষমতা দিয়েছিলেন এবং একটি নতুন ভারত গড়ে তুলেছিলেন। আজ যখন আমরা প্রতিদিন সকালে অমুলের দুধ খাই, তখন তার মধ্যে লুকিয়ে থাকে এক অসাধারণ মানুষের স্বপ্ন – একটি স্বপ্ন যাকে তিনি বাস্তবায়ন করেছিলেন।

Leave a comment