আজকের নারীরা পরিবার ও কর্মজীবন—দুই ক্ষেত্রেই সমানে সমানে এগিয়ে চলেছেন, কিন্তু নিজেদের স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে অনেক সময় পিছিয়ে পড়ে যাচ্ছেন। গত কয়েক দশকে নারীদের মধ্যে বেশ কিছু স্বাস্থ্য সমস্যা দ্রুত বেড়েছে। এর মধ্যে অস্টিওআর্থারাইটিস, ডায়াবেটিস এবং অ্যানিমিয়া যে রোগগুলো এখন সাধারণ হয়ে উঠেছে, সেগুলি উল্লেখযোগ্য। এই নিবন্ধে আমরা জানবো এই রোগগুলোর কারণ কি এবং এগুলি থেকে কীভাবে রক্ষা পাওয়া যায়।
১. অস্টিওআর্থারাইটিস: নারীদের মধ্যে ১৩০% বেড়েছে আক্রান্তের সংখ্যা
গত ৩০ বছরে নারীদের মধ্যে অস্টিওআর্থারাইটিসের ঘটনা ১৩০% বেড়েছে। এটি এক প্রকারের জয়েন্টের রোগ, যেখানে হাড়ের মধ্যবর্তী কারটিলেজ (হাড়ের আস্তরণ) ধীরে ধীরে ঘষে যায়, ফলে জয়েন্টে ব্যথা, প্রদাহ এবং শক্তবোধ হয়। নারীদের মধ্যে এই সমস্যাটি বিশেষ করে মেনোপজের পরে বেশি দেখা যায়, যখন শরীরে ইস্ট্রোজেন হরমোনের মাত্রা কমতে শুরু করে। এছাড়াও বয়স বৃদ্ধি, স্থূলতা, পুষ্টির অভাব এবং শারীরিক কর্মকাণ্ডের অভাবের কারণেও এই রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
উপায়
• ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার খান।
• প্রতিদিন হালকা ব্যায়াম বা যোগাসন করুন।
• ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন এবং দীর্ঘক্ষণ একই ভঙ্গিতে বসে থাকা থেকে বিরত থাকুন।
২. ডায়াবেটিস: নারীদের মধ্যে দ্বিগুণ বেড়েছে প্রভাব
১৯৯০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী ডায়াবেটিসের ঘটনা দ্বিগুণ বেড়েছে। বিশেষ করে নারীদের মধ্যে ডায়াবেটিসের ঘটনা দ্রুত বেড়ে চলেছে, যার প্রধান কারণ হলো হরমোনের পরিবর্তন, বর্ধিত চাপ, স্থূলতা এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকার জীবনযাত্রা। ১৯৯০ সালে বিশ্বব্যাপী ১৯৮ মিলিয়ন মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিলেন, যা এখন বেড়ে ৮২৮ মিলিয়নে পৌঁছেছে। নারীদের মধ্যে এই রোগের বর্ধমান ঘটনা ইঙ্গিত করে যে এই সমস্যা দিন দিন আরও গুরুতর হয়ে উঠছে।
উপায়
• প্রতিদিন ৩০ মিনিট হাঁটুন।
• চিনি এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার থেকে বিরত থাকুন।
• নিয়মিত রক্তে চিনির পরীক্ষা করান।
• ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন এবং চাপ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করুন।
৩. অ্যানিমিয়া: প্রতি দুইজনের একজন নারী আক্রান্ত
ভারতে ১৫-৪৯ বছর বয়সী ৫৭% নারী অ্যানিমিয়া (রক্তাল্পতা) রোগে আক্রান্ত, যা এনএফএইচএস-৫ (ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে) দ্বারা জানা গেছে। অ্যানিমিয়া শরীরে হিমোগ্লোবিন এবং আয়রনের অভাবের কারণে হয়, যার ফলে ক্লান্তি, দুর্বলতা এবং মাথা ঘোরা সাধারণ হয়ে ওঠে। এই সমস্যাটি মাসিক, গর্ভাবস্থা এবং পুষ্টির অভাবের কারণে হয়। বিশেষ করে গ্রামীণ অঞ্চলে এই সমস্যাটি বেশি দেখা যায়, যেখানে অশিক্ষিত এবং দরিদ্র নারীরা বেশি প্রভাবিত হন।
উপায়
• আয়রন সমৃদ্ধ খাবার যেমন পালংশাক, গুড়, চুকন্দর, আনার শামিল করুন আপনার খাদ্যতালিকায়।
• চিকিৎসকের পরামর্শে আয়রন ও ফলিক অ্যাসিড সাপ্লিমেন্ট খান।
• গর্ভবতী নারীদের সময় সময় হিমোগ্লোবিন পরীক্ষা করানো উচিত।
নারীদের মধ্যে স্বাস্থ্য সমস্যার বৃদ্ধি: কারণ
• দুর্বল পুষ্টি: নারীরা প্রায়শই নিজেদের খাওয়ার চেয়ে পরিবারের জন্য রান্না করার অভ্যাসে থাকে, যার ফলে তাদের নিজস্ব পুষ্টি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
• চাপ ও কাজের বোঝা: ঘর ও কাজের দায়িত্বের মধ্যে বর্ধিত চাপ স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
• শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা: ব্যায়ামের অভাবও স্বাস্থ্য সমস্যার প্রধান কারণ হতে পারে।
নারীদের স্বাস্থ্যের যত্ন কীভাবে নেওয়া যায়?
গাইনোকোলজিস্ট ডাঃ প্রতিমা আগরহরী মতে, নারীদের নিজেদের স্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং এর জন্য কিছু মৌলিক নিয়ম অনুসরণ করা অত্যন্ত জরুরী।
সুস্থ জীবনযাত্রা গ্রহণ করুন
• সমতুলিত খাদ্য গ্রহণ করুন, যার মধ্যে থাকবে সবুজ শাকসবজি, ফল, পুরো ধান ও প্রোটিন।
• প্রতিদিন ৭-৮ ঘন্টা ঘুমোন।
নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান
• বছরে একবার পুরো শরীরের পরীক্ষা করান।
• সময় সময় রক্তচাপ, রক্তে চিনির মাত্রা এবং হিমোগ্লোবিন পরীক্ষা করিয়ে নিন।
স্ব-যত্নকে অগ্রাধিকার দিন
• আপনার শরীরের ইঙ্গিতগুলোকে উপেক্ষা করবেন না।
• স্বাস্থ্য সমস্যা হলে অবিলম্বে চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করুন।
• নারীদের নিজেদের স্বাস্থ্যের দায়িত্ব নিজেই নিতে হবে।
আজকের সময়ে নারীদের জন্য নিজের স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া ঠিক যতটা জরুরী পরিবার ও কর্মজীবনের যত্ন নেওয়া। ছোট ছোট সতর্কতা এবং সঠিক জীবনযাত্রার মাধ্যমে তারা বড় বড় রোগ থেকে রক্ষা পেতে পারেন। নারীদের নিজেদেরকে অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং নিজেদের স্বাস্থ্যের প্রতি সচেতন থাকতে হবে।