হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপ আজকের যুগের একটি গুরুতর ও বিপজ্জনক রোগ হয়ে উঠেছে। এই অবস্থা তখন সৃষ্টি হয় যখন আমাদের রক্তনালীতে চাপ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়ে যায়। এর ফলে আমাদের হৃৎপিণ্ড রক্ত পাম্প করার জন্য অতিরিক্ত পরিশ্রম করে, যা ধীরে ধীরে আমাদের হৃৎপিণ্ড ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দ্বারা বিশ্ব উচ্চ রক্তচাপ দিবস উপলক্ষে এই রোগের প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধি করা অত্যন্ত প্রয়োজন, কারণ সময়মতো এর সন্ধান পাওয়া ও যথাযথ চিকিৎসা না করা হলে এর গুরুতর পরিণতি দেখা দিতে পারে। এই প্রবন্ধে আমরা জানব হাইপারটেনশনের কারণ, লক্ষণ এবং একে নিয়ন্ত্রণে রাখার কার্যকর উপায়।
হাইপারটেনশন কি এবং কেন এটি বিপজ্জনক?
হাইপারটেনশনের অর্থ হল রক্তচাপের স্বাভাবিক সীমার চেয়ে বেশি হয়ে যাওয়া। স্বাভাবিক রক্তচাপ প্রায় ১২০/৮০ mmHg হয়, কিন্তু যখন এটি ক্রমাগত ১৪০/৯০ mmHg এর উপরে থাকে, তখন তাকে উচ্চ রক্তচাপ বলে মনে করা হয়। যখন রক্তনালীতে চাপ বেশি থাকে তখন হৃৎপিণ্ডকে রক্ত পুরো শরীরে পৌঁছে দিতে বেশি শক্তি খরচ করতে হয়। এর ফলে হৃৎপিণ্ড দুর্বল হতে শুরু করে এবং যদি সময়মতো চিকিৎসা না করা হয় তাহলে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, কিডনি ফেইলিওরের মতো গুরুতর রোগ হতে পারে।
হাইপারটেনশনকে ‘নিঃশব্দ বিষ’ও বলা হয় কারণ এটি ধীরে ধীরে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। অনেক সময় এটি লক্ষণহীন থাকে, অর্থাৎ ব্যক্তি বুঝতেই পারে না যে তার রক্তচাপ বাড়ছে। তাই একে ‘সাইলেন্ট কিলার’ও বলা হয়।
হাইপারটেনশনের প্রাথমিক লক্ষণ
হাইপারটেনশনের অনেক প্রাথমিক লক্ষণ রয়েছে, যা প্রায়শই লোকেরা উপেক্ষা করে। কিন্তু যদি আপনি বারবার মাথায় তীব্র ব্যথা অনুভব করেন, তাহলে তা গুরুত্বের সাথে নেওয়া উচিত। এটি একটি ইঙ্গিত হতে পারে যে আপনার রক্তচাপ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি এবং আপনার শরীরে চাপ বাড়ছে।
বুকে ব্যথা এবং ভারীভাব: যদি আপনার বুকে ব্যথা বা ভারীভাব অনুভূত হয়, তাহলে এটিও হাইপারটেনশনের একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ হতে পারে। রক্তচাপ বৃদ্ধি পেলে হৃৎপিণ্ডের উপর বেশি চাপ পড়ে, যার ফলে এ ধরণের সমস্যা হয়।
শ্বাস নেওয়ার অসুবিধা: শ্বাস নেওয়ার অসুবিধা বা ঘুণাক্ষত অনুভব করাও উচ্চ রক্তচাপের একটি সাধারণ লক্ষণ। এটি শরীরে অক্সিজেনের অভাব এবং হৃৎপিণ্ডের দুর্বলতাকে নির্দেশ করে, যার জন্য দ্রুত মনোযোগ দেওয়া জরুরি।
মানসিক ক্লান্তি এবং চাপ: অত্যধিক ক্লান্তি অনুভব করা এবং ক্রমাগত চাপে থাকাও হাইপারটেনশনের লক্ষণ হতে পারে। যখন রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়, তখন শরীরে শক্তি কমে যায় এবং মস্তিষ্কে চাপ বৃদ্ধি পায়।
অন্যান্য গুরুতর লক্ষণ: যদি আপনার চোখের সামনে ধোঁয়াচ্ছা দেখা দেয়, হঠাৎ দুর্বলতা বা মাথা ঘোরা অনুভূত হয়, অথবা কথা বলা এবং শোনার সমস্যা হয়, তাহলে এটি ইঙ্গিত করে যে অবস্থাটি গুরুতর হতে পারে। এই ক্ষেত্রে অবিলম্বে চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করা উচিত।
হাইপারটেনশনের কারণ
হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপ অনেক কারণে হতে পারে। এই সমস্যাটি ধীরে ধীরে শরীরকে প্রভাবিত করে এবং যদি সময়মতো মনোযোগ না দেওয়া হয় তাহলে গুরুতর পরিণতি হতে পারে।
মোটা ও অতিরিক্ত ওজন: যখন আমাদের ওজন বেড়ে যায় এবং শরীরে অতিরিক্ত চর্বি জমা হয়, তখন রক্ত প্রবাহের উপর চাপ বৃদ্ধি পায়। এর ফলে হৃৎপিণ্ডকে রক্ত পাম্প করতে বেশি পরিশ্রম করতে হয়, যা রক্তচাপ বৃদ্ধির কারণ হয়। তাই সঠিক ওজন বজায় রাখা খুবই জরুরি।
পরিবারে রক্তচাপের ইতিহাস: যদি আপনার পরিবারে কোন সদস্যের উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা থাকে, তাহলে আপনার এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। এটিকে জিনগত কারণ বলা হয়। তাই এ ধরণের পরিবারের লোকদের নিজেদের স্বাস্থ্যের বিশেষ যত্ন নেওয়া উচিত।
ভুল খাদ্যাভাস: জাঙ্ক ফুড, ভাজা খাবার যেমন পিজ্জা, বার্গার, ফ্রাইড ফুডের অত্যধিক সেবন এবং বেশি লবণ খাওয়াও উচ্চ রক্তচাপের একটি বড় কারণ। এই জিনিসগুলি শরীরে রক্তনালী সংকুচিত করে এবং রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়।
ধূমপান এবং মদ্যপান: সিগারেট পান করা বা তামাক ব্যবহার ধমনীতে সংকোচন তৈরি করে, যার ফলে রক্ত প্রবাহ প্রভাবিত হয় এবং রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়। এছাড়াও অতিরিক্ত মদ্যপান এই সমস্যাটিকে বাড়িয়ে তুলতে পারে।
চাপ এবং অনিয়মিত জীবনযাপন: আজকের দ্রুত এবং চাপময় জীবনে মানসিক চাপ এবং ঘুমের অভাব থেকেও হাইপারটেনশন বৃদ্ধি পায়। ক্রমাগত চাপ এবং অনিয়মিত দিনচর্যা থেকে শরীরে হরমোন ভারসাম্যহীন হয়ে যায়, যা রক্তচাপ বাড়ানোর কারণ হয়।
ডায়াবেটিস, কিডনি রোগ এবং গর্ভাবস্থা: ডায়াবেটিস বা মধুমেহ এবং কিডনি রোগও উচ্চ রক্তচাপের কারণ হতে পারে। এছাড়াও গর্ভাবস্থার সময় অনেক মহিলার রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়, যাকে প্রিক্লেম্পসিয়া বলা হয়। এই ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ জরুরি।
হাইপারটেনশন প্রতিরোধের জন্য গৃহোপযোগী ও আয়ুর্বেদিক উপায়
হাইপারটেনশন সম্পূর্ণরূপে সারাতে জীবনযাত্রার পরিবর্তন এবং সঠিক খাদ্যাভাস অত্যন্ত প্রয়োজন। এর জন্য নিম্নলিখিত উপায়গুলি সহায়ক হতে পারে:
- নিয়মিত ব্যায়াম করুন: প্রতিদিন অন্তত ২০-২৫ মিনিট ব্যায়াম করা হৃৎপিণ্ডকে শক্তিশালী করে এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে। যোগ এবং ধ্যানও চাপ কমাতে সহায়ক, যা হাইপারটেনশন প্রতিরোধে সহায়ক।
- সমতা ও পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করুন: আপনার খাবারে পুরো ধান, তাজা ফল এবং সবুজ শাকসবজি অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত করুন। জাঙ্ক ফুড, ভাজা-ভুঁড়ি খাবার এবং বেশি লবণ খাওয়া থেকে বিরত থাকুন কারণ এগুলি রক্তচাপ বাড়ায়। স্বাস্থ্যকর খাদ্য হৃৎপিণ্ডকে সুস্থ রাখে।
- বাদাম খাওয়া: প্রতিদিন ৪-৫টি বাদাম এবং ৪টি আখরোট খাওয়া রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে। এই বাদামগুলি হৃৎপিণ্ডের জন্য খুব উপকারী এবং শরীরকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি প্রদান করে।
- তেলে পরিবর্তন করুন: রান্না করার জন্য সরিষার তেলের পরিবর্তে সয়াবিন অথবা অলিভ অয়েল ব্যবহার করুন। এই তেলগুলি রক্ত প্রবাহকে উন্নত করে এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে।
- তাজা সালাদ খাওয়া বাড়ান: সালাদে পেঁয়াজ, টমেটো, কাকড়ি, গাজর, মূলা এবং বাঁধাকপি মতো শাকসবজি অন্তর্ভুক্ত করুন। এই সবজিগুলি শরীরকে ঠান্ডা করে এবং রক্ত পরিষ্কার রাখতে সহায়ক।
- ধূমপান এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার থেকে বিরত থাকুন: ধূমপান রক্তচাপ বাড়ানোর সবচেয়ে বড় কারণ, তাই এটি ত্যাগ করা উচিত। এছাড়াও চাটনি, আচার, সস, মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট মত প্রক্রিয়াজাত খাবারের সেবন কমিয়ে আনুন কারণ এগুলি রক্তচাপকে ক্ষতি করে।
- আমলা, রসুন, লেবু পানি এবং করলার ব্যবহার করুন: প্রতিদিন আমলার রস এবং কাঁচা রসুন খাওয়া রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে। দিনে একবার লেবু পানি পান করলেও উপকার হয়। এছাড়াও করলাকে শাক বা রস হিসেবে গ্রহণ করলে উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে।
হাইপারটেনশনে সতর্কতা ও চিকিৎসা
হাইপারটেনশন অর্থাৎ উচ্চ রক্তচাপকে উপেক্ষা করা খুবই বিপজ্জনক হতে পারে। তাই সময়-সময় রক্তচাপ পরীক্ষা করা খুবই জরুরি। যদি আপনার রক্তচাপ ক্রমাগত বৃদ্ধি পায় তাহলে দেরি না করে চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করুন এবং তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন শুরু করুন। এছাড়াও, আপনার জীবনযাত্রায় উন্নতি আনাও জরুরি, যেমন সঠিক খাদ্যাভাস, নিয়মিত ব্যায়াম এবং গৃহোপযোগী উপায়গুলি অনুসরণ করা। এই সমস্ত জিনিস মিলে হাইপারটেনশন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
হাইপারটেনশনের রোগীদের চাপ থেকে দূরে থাকা উচিত এবং প্রতিদিন যথেষ্ট ঘুম ঘুমানো জরুরি যাতে শরীর সঠিকভাবে বিশ্রাম নিতে পারে। এছাড়াও, শরীরকে হাইড্রেটেড রাখাও জরুরি, অর্থাৎ যথেষ্ট পরিমাণে পানি পান করা উচিত। অতিরিক্ত মদ্যপান এবং বেশি ক্যাফিন যেমন চা, কফি বা এনার্জি ড্রিঙ্ক থেকে বিরত থাকা উচিত কারণ এগুলি রক্তচাপ বাড়াতে পারে। এই সতর্কতাগুলি মেনে চললে আপনি আপনার স্বাস্থ্যকে আরও ভালো করতে পারবেন এবং হাইপারটেনশনের গুরুতর সমস্যা থেকে বাঁচতে পারবেন।