জ্যৈষ্ঠ মাসের বড় মঙ্গল: হনুমানজীর আরাধনা ও প্রদীপ জ্বালানোর বিশেষ তাৎপর্য

🎧 Listen in Audio
0:00

হিন্দু পঞ্জিকার মতে, জ্যৈষ্ঠ মাসের মঙ্গলবারগুলিকে বিশেষভাবে পবিত্র ও অলৌকিক বলে মনে করা হয়। একে ‘বড় মঙ্গল’ বলা হয়, যা বিশেষ করে ভগবান হনুমানকে উৎসর্গীকৃত উৎসব। ২০ মে ২০২৫ সালে জ্যৈষ্ঠের দ্বিতীয় বড় মঙ্গল পালিত হবে। এই পবিত্র উপলক্ষে ভক্তগণ ব্রত পালন করেন, হনুমানজীর বিশেষ আরাধনা করেন এবং মন্দিরে গিয়ে দর্শনলাভ করেন।

পুরাণমতে, জ্যৈষ্ঠ মাসেই ভগবান হনুমান প্রথমবার শ্রীরামের সাথে দেখা করেছিলেন। তখন থেকেই এই মাস এবং এর মঙ্গলবার ভক্তদের কাছে অত্যন্ত পুণ্যময় বলে মনে করা হয়। যদি এই দিনে কিছু বিশেষ ধর্মীয় উপায় করা হয়, বিশেষ করে প্রদীপ জ্বালানোর প্রথা পালন করা হয়, তাহলে কেবলমাত্র ঘরে ইতিবাচক শক্তি আসে না, বরং জীবনের দুঃখও দূর হয়।

বড় মঙ্গলের গুরুত্ব

বড় মঙ্গলের দিন হনুমানজীর পূজার বিশেষ উপলক্ষ। হনুমানজীকে কলিয়ুগের সবচেয়ে শক্তিশালী ও সচেতন দেবতা বলে মনে করা হয়। মানুষ বিশ্বাস করে তাঁর ভক্তি ও আরাধনার মাধ্যমে দ্রুত মনোকামনা পূর্ণ হয়। বিশেষ করে মঙ্গলবার হনুমানজীর জন্য অত্যন্ত শুভ দিন, কারণ এটি তাঁর প্রিয় দিন। জ্যৈষ্ঠ মাসে যখন এই মঙ্গলবার আসে, তখন এর গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়। এই দিনে ব্রত রাখা, হনুমান চালিসা পাঠ করা এবং প্রদীপ জ্বালানোর ফলে ঘর-সংসারের সকল দুশ্চিন্তা ও বাধা দূর হয়। বড় মঙ্গলের দিন করা পূজার ফলে জীবনে সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি আসে। তাই এই দিনে হনুমানজীর ভক্তি পূর্ণ শ্রদ্ধার সাথে করতে হবে যাতে তাঁর আশীর্বাদে প্রতিটি বিপদ দূর হতে পারে।

এই স্থানগুলিতে প্রদীপ জ্বালানোর ফলে অলৌকিক লাভ পাওয়া যাবে

মূল দ্বারে প্রদীপ: বাড়ির মূল দরজাকে বাস্তু ও আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান বলে মনে করা হয়। এখানে সন্ধ্যায় প্রদীপ জ্বালানোর ফলে নেতিবাচক শক্তি প্রবেশ করতে পারে না এবং ঘরে ইতিবাচকতা বজায় থাকে। বড় মঙ্গলের দিন বিশেষ করে দরজার উভয় পাশে মাটির প্রদীপে তিল বা সরিষার তেল ভরে জ্বালান।

পূজাঘরে প্রদীপ: ভগবান হনুমানের মূর্তি বা ছবির সামনে ঘি-এর প্রদীপ জ্বালানো অত্যন্ত পুণ্যময়। এতে কেবলমাত্র ঘরে শান্তি ও সমৃদ্ধি আসে না, বরং এটি আত্মিক শুদ্ধিরও মাধ্যম হয়। এই সময় হনুমান চালিসা অথবা বজরঙ্গ বাণ পাঠ করুন।

তুলসীর গাছের পাশে প্রদীপ: হিন্দু ধর্মে তুলসীর গাছকে দেবী লক্ষ্মীর রূপ বলে মনে করা হয়। তুলসীর পাশে প্রদীপ জ্বালানোর ফলে ঘরে অর্থ ও সুখ-সমৃদ্ধি বজায় থাকে। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তুলসীর পাশে প্রদীপ রেখে, “ॐ তুলস্যৈ নমঃ” মন্ত্রের জপ করুন।

রান্নাঘরে প্রদীপ: রান্নাঘরকে অন্নপূর্ণার স্থান বলে মনে করা হয়। এখানে প্রদীপ জ্বালানোর ফলে ঘরে কখনো অন্নের অভাব হয় না এবং স্বাস্থ্যও ভালো থাকে। বিশেষ করে মহিলাদের জন্য এটি শুভ বলে মনে করা হয়। মাটি বা পিতলের প্রদীপে ঘি ভরে রান্নাঘরের পূর্ব কোণে রাখুন।

বটগাছের নিচে প্রদীপ: বটগাছকে হিন্দু ধর্মে অমরত্ব ও দেবতাদের বাসস্থান বলে মনে করা হয়। যদি আপনার বাড়ির কাছে বটগাছ থাকে, তাহলে তার নিচে প্রদীপ জ্বালানো অত্যন্ত ফলপ্রসূ। এতে পিতৃদোষও দূর হয় এবং হনুমানজীর কৃপা লাভ হয়।

বাড়ির ঈশান কোণে প্রদীপ: বাস্তুশাস্ত্র অনুসারে, ঈশান কোণ (উত্তর-পূর্ব দিক) কে দেবতাদের স্থান বলে মনে করা হয়। এখানে প্রদীপ জ্বালানোর ফলে ঘরে আধ্যাত্মিক শক্তির সংচার হয়। এটি শুভতা, শান্তি ও সদ্ভাৱের কেন্দ্র। বড় মঙ্গলের দিন এই স্থানে বিশেষ করে প্রদীপ অবশ্যই জ্বালান।

প্রদীপ জ্বালানোর নিয়ম ও সাবধানতা

শুচি স্থানে প্রদীপ রাখুন: প্রদীপ সর্বদা কোনও পরিষ্কার ও শুচি স্থানে জ্বালানো উচিত। গন্ধ ও অশুচি স্থানে প্রদীপ জ্বালানোর ফলে তার শক্তি সঠিকভাবে ছড়াতে পারে না এবং পূজার ফলও কম হয়। তাই পূজাঘর, মূল দ্বার বা বাড়ির ভালো কোণগুলিতে প্রদীপ রাখা শুভ বলে মনে করা হয়।

প্রদীপে তেল বা ঘির পরিমাণ যথেষ্ট হোক: প্রদীপে সর্বদা এত তেল বা ঘি ঢালুন যাতে তা পূজার সম্পূর্ণ সময় ধরে নিভে না যায়। যদি তেল বা ঘি কম হয় তাহলে প্রদীপ দ্রুত নিভে যেতে পারে, যার ফলে পূজা অসম্পূর্ণ থাকে। ঘি দিয়ে জ্বালানো প্রদীপ বিশেষ করে অধিক শুভ বলে মনে করা হয় কারণ এতে ইতিবাচক শক্তি আরও বৃদ্ধি পায়।

প্রদীপের শিখার দিক সঠিক রাখুন: প্রদীপ জ্বালানোর সময় তার শিখাকে সর্বদা উত্তর বা পূর্ব দিকে রাখুন। এই দিকগুলিকে শুভ বলে মনে করা হয় এবং এগুলো ইতিবাচক শক্তিকে ঘরে প্রবেশ করতে সাহায্য করে। এতে মন ও পরিবেশ উভয়েরই শান্তির পরিবেশ সৃষ্টি হয়।

পূজার সময় মন্ত্রের জপ করুন: যখন প্রদীপ জ্বালান তখন হনুমান চালিসা, সুন্দরকান্ড বা হনুমানজীর বৈদিক মন্ত্রের জপ অবশ্যই করুন। এতে প্রদীপের শক্তি বৃদ্ধি পায় এবং ভগবান হনুমানের কৃপা দ্রুত লাভ হয়। মন্ত্রের উচ্চারণ ভক্তিভাবের সাথে করুন যাতে সকল বিপদ দূর হয় এবং জীবনে সুখ-শান্তি বজায় থাকে।

সুরক্ষার দিকে নজর রাখুন: প্রদীপ জ্বালানোর সময় সর্বদা শিশু ও পোষা প্রাণীদের নাগালের বাইরে রাখুন। প্রদীপ উন্মুক্ত আগুন, তাই যদি এটি কোনও শিশু বা প্রাণীর কাছে রাখা হয় তাহলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। বিশেষ করে যখন ঘরে শিশু থাকে তখন সাবধানতা অবলম্বন করা অত্যন্ত জরুরি যাতে পূজার সময় কোনও দুর্ঘটনা না ঘটে।

মন্ত্র জপ

ॐ হনুমতে নমঃ
এই মন্ত্রের জপ করার ফলে হনুমানজীর শক্তি লাভ হয় এবং সকল বাধা দূর হয়।

রাম রামায় নমঃ
ভগবান রামের স্মরণ করে এই মন্ত্র জীবনে সাফল্য ও শান্তি নিয়ে আসে।

ॐ বজরঙ্গ বাণায় নমঃ
বজরঙ্গ বাণ হনুমানজীর সবচেয়ে শক্তিশালী মন্ত্র বলে মনে করা হয়। এটি পাঠ করার ফলে বিপদ দূর হয় এবং মানসিক শক্তি বৃদ্ধি পায়।

সংকট মোচন হনুমান আস
এই মন্ত্রের জপ করে হনুমানজীর কাছে বিপদ থেকে মুক্তি ও সুরক্ষার প্রার্থনা করা হয়।

বড় মঙ্গলের বিশেষ উপায়

বড় মঙ্গলের দিন ভগবান হনুমানজীর বিশেষ পূজা-অর্চনা করা হয়। এই দিনে হনুমানজীকে লাল রঙের চোলা পরিধান করানো অত্যন্ত শুভ বলে মনে করা হয়। লাল রঙ শক্তি ও উর্জার প্রতীক, যা সকল বাধা দূর করে। এর সাথে গুড় ও চনার ভোগ দেওয়াও অত্যন্ত ফলপ্রসূ। এই জিনিসগুলি ভগবানকে প্রিয় বলে মনে করা হয় এবং এগুলি অর্পণ করার ফলে মনোকামনা দ্রুত পূর্ণ হয়। পূজার পর দরিদ্রদের লাল বস্ত্র বা খাবার দান করাও বড় মঙ্গলের দিনের বিশেষ উপায়। এতে কেবলমাত্র আপনার পূজা সম্পূর্ণ হয় না, বরং দান করার ফলে আপনার জীবনেও সুখ-সমৃদ্ধি আসে।

বড় মঙ্গলের দিন বিশেষ করে সেসব ব্যক্তির জন্যও অত্যন্ত উপকারী যাদের উপর শনি দোষ বা মঙ্গল দোষের প্রভাব রয়েছে। এই ধরণের ব্যক্তিদের জন্য এই দিনে ব্রত রাখা এবং হনুমানজীকে সিঁদুর অর্পণ করা অত্যন্ত উপকারী। এতে দোষের প্রভাব কমে যায় এবং জীবনে সুখ-শান্তি বজায় থাকে। এছাড়াও, এই উপায় সকল ধরণের দুঃখ ও বাধা দূর করতে সাহায্য করে। তাই বড় মঙ্গলের দিন এই উপায়গুলি অবলম্বন করে ভগবান হনুমানজীর বিশেষ কৃপা লাভ করুন এবং আপনার জীবনকে সুন্দর করুন।

বড় মঙ্গল কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় তিথি নয়, বরং একটি শক্তির উৎস। এই দিনে করা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পূজাবিধি এবং প্রদীপ জ্বালানোর মতো উপায় জীবনে বড় পরিবর্তন আনতে পারে। হনুমানজীর কৃপায় অসম্ভবকেও সম্ভব করা যায়, শর্ত হলো শ্রদ্ধা ও ভক্তি সত্যিকারের হতে হবে।

Leave a comment