গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপ ও উচ্চ শর্করা: ঝুঁকি ও প্রতিরোধ

🎧 Listen in Audio
0:00

গর্ভাবস্থা একজন মহিলার জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল সময়। এই সময় শুধুমাত্র মায়ের স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া জরুরি নয়, গর্ভে বিকশিত শিশুর সুরক্ষাও ততটাই গুরুত্বপূর্ণ। গর্ভাবস্থায় খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাত্রা এবং স্বাস্থ্যের সরাসরি প্রভাব গর্ভস্থ শিশুর স্বাস্থ্যের উপর পড়ে। বিশেষ করে যদি এই সময় রক্তচাপ বা শর্করার মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়ে যায়, তাহলে এটি মায়ের এবং শিশুর উভয়ের জন্যই গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।

গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা: প্রি-এক্লেম্পসিয়া

গর্ভাবস্থায় যদি রক্তচাপ বেশি হয় তবে তাকে হাইপারটেনশন বলা হয়। গর্ভাবস্থার ২০ সপ্তাহ পরে যখন রক্তচাপ অত্যন্ত বৃদ্ধি পায় এবং একই সাথে প্রস্রাবে প্রোটিন আসা, মাথাব্যথা, চোখে ধোঁয়াচ্ছা, শরীরে ফোলাভাব ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়, তখন তাকে প্রি-এক্লেম্পসিয়া বলা হয়। এই অবস্থা গুরুতর হতে পারে এবং যদি এর সময়োপযোগী চিকিৎসা না করা হয়, তাহলে মাতৃ-শিশু উভয়েরই জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর মতে, প্রি-এক্লেম্পসিয়া গর্ভবতী মহিলাদের মৃত্যুর একটি বড় কারণ। আমেরিকায় প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মহিলা এবং নবজাতকের মৃত্যুর কারণ এই রোগ। ভারতেও এই সমস্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ডাক্তার মীরা পাঠক জানান যে, প্রি-এক্লেম্পসিয়ায় প্লাসেন্টা সঠিকভাবে বিকাশ পায় না, যার ফলে মায়ের থেকে শিশুর রক্ত ​​প্রবাহ কমে যায়। এর ফলে শিশুর বিকাশ প্রক্রিয়া ব্যাহত হয় এবং জন্মের পরেও তাকে অনেক স্বাস্থ্য জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়।

গর্ভকালীন ডায়াবেটিস: শর্করার ঝুঁকি

গর্ভাবস্থার সময় ডায়াবেটিস, যাকে গর্ভকালীন মধুমেহ বলা হয়, প্রায় ২৫% মহিলাকে প্রভাবিত করে। এটি তখন ঘটে যখন শরীরে ইনসুলিনের মাত্রা ভারসাম্যহীন হয়ে যায় এবং রক্তে শর্করার মাত্রা বৃদ্ধি পায়।

গর্ভকালীন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না থাকলে এটি মায়ের এবং শিশুর উভয়ের জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। মেয়ো ক্লিনিক এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ (NIH)-এর মতে, এই অবস্থায় শিশুর জন্মগত ত্রুটি, অকাল জন্ম, অত্যধিক ওজন এবং জন্মের সময় মৃত্যুর ঝুঁকি থাকে।

উচ্চ রক্তচাপ এবং শর্করার কারণে হওয়া ঝুঁকি

মায়ের জন্য সম্ভাব্য ঝুঁকি: গর্ভাবস্থায় যদি রক্তচাপ বা শর্করা বেশি হয়ে যায়, তাহলে মায়ের অনেক গুরুতর সমস্যা হতে পারে। যেমন প্রি-এক্লেম্পসিয়া এবং এক্লেম্পসিয়া, যেখানে কখনও কখনও মাথা ঘোরাও হতে পারে। এছাড়াও, গর্ভাশয়ে রক্ত ​​প্রবাহ কমে যায়, যার ফলে শিশুর কাছে প্রয়োজনীয় পুষ্টি পৌঁছায় না। এর ফলে কিডনি, হৃৎপিণ্ড এবং লিভারের মতো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের স্বাস্থ্যও প্রভাবিত হতে পারে। এছাড়াও, ভবিষ্যতে মায়ের হৃদরোগ এবং মধুমেহ হওয়ার ঝুঁকিও বেড়ে যায়।

শিশুর জন্য সম্ভাব্য ঝুঁকি: উচ্চ রক্তচাপ এবং শর্করার কারণে শিশুর বিকাশে বাধা আসতে পারে, যার ফলে তার ওজন কম হতে পারে। এর ফলে শিশুর জন্ম অকালেও হতে পারে, যা তার স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। জন্মের সময় শিশুর শ্বাস নিতে অসুবিধা হতে পারে এবং তাকে হৃদরোগ বা মস্তিষ্কের সাথে সম্পর্কিত গুরুতর রোগও হতে পারে। এছাড়াও, জন্মগত ত্রুটি বা অতিরিক্ত ওজনের কারণে প্রসবের সময়ও জটিলতা দেখা দিতে পারে, যার ফলে মায়ের এবং শিশুর উভয়েরই জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে।

লক্ষণগুলির উপর নজর দেওয়া কেন জরুরি?

গর্ভাবস্থায় রক্তচাপ বা শর্করা বৃদ্ধির প্রাথমিক লক্ষণগুলি চিনতে পারা এবং সময়মতো ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি আপনার নিম্নলিখিত লক্ষণগুলি দেখা দেয় তাহলে অবিলম্বে পরীক্ষা করান:

  • বারবার মাথাব্যথা বা মাথা ঘোরা
  • চোখের সামনে ধোঁয়াচ্ছা বা উজ্জ্বল আলো দেখা
  • হাত-পা ফোলা, বিশেষ করে মুখ এবং পা
  • বারবার বমি বমি ভাব বা পেটে ব্যথা
  • প্রস্রাবে অস্বাভাবিক পরিবর্তন বা জ্বালাপোড়া অনুভব করা
  • অত্যধিক ক্লান্তি বা দুর্বলতা

প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণের উপায়

গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপ এবং শর্করাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে:

  • নিয়মিত পরীক্ষা: গর্ভবতী মহিলার নিয়মিতভাবে ডাক্তারের কাছে গিয়ে রক্তচাপ এবং রক্তে শর্করার পরীক্ষা করানো উচিত। এতে প্রাথমিক সমস্যার সন্ধান পাওয়া যায় এবং সময়মতো চিকিৎসা শুরু করা যায়।
  • স্বাস্থ্যকর খাদ্য: সুষম এবং পুষ্টিকর খাবার খান। ভাজা-ভুড়ি, অতিরিক্ত লবণ, মিষ্টি এবং জাঙ্ক ফুড থেকে বিরত থাকুন। তাঁজা সবজি, ফল, সাটো ধান ও প্রোটিনের সেবন করুন।
  • নিয়মিত ব্যায়াম: ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী হালকা ব্যায়াম বা যোগাসন করুন। এটি রক্ত ​​সঞ্চালন সুধারণ এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
  • চাপ কমিয়ে ফেলুন: গর্ভাবস্থায় মানসিক চাপ কম করার জন্য ধ্যান, মেডিটেশন বা ভালো ঘুম গুরুত্বপূর্ণ।
  • ঔষধের সঠিক সেবন: ডাক্তার কর্তৃক নির্দেশিত ঔষধগুলি কোনও পরিবর্তন ছাড়াই সেবন করুন এবং আপনার স্বাস্থ্যের নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করুন।
  • ধূমপান এবং মদ্যপান থেকে বিরত থাকুন: গর্ভাবস্থায় এগুলি থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকুন কারণ এগুলি শিশুর জন্য ক্ষতিকারক।

ডাক্তারের পরামর্শ কেন জরুরি?

গর্ভাবস্থায় রক্তচাপ বা শর্করার সমস্যাকে কখনোই হালকাভাবে নেওয়া উচিত নয়। স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মীরা পাঠক জানান যে, যদি এই সমস্যাগুলির সময়মতো চিকিৎসা না করা হয় তাহলে প্রি-এক্লেম্পসিয়া এবং গেস্টেশনাল ডায়াবেটিসের কারণে মায়ের এবং শিশুর উভয়েরই জীবন গুরুতর ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। তাই গর্ভবতী মহিলাদের ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ঔষধ সেবন করা উচিত এবং সময় সময় তাদের পরীক্ষা করিয়ে রাখা উচিত। নিয়মিত পরীক্ষার মাধ্যমে সময়মতো রোগের সন্ধান পাওয়া যায় এবং সঠিক চিকিৎসা করা যায়, যার ফলে মাতৃ-শিশু উভয়ই সুরক্ষিত থাকে।

গর্ভাবস্থার সময় রক্তচাপ এবং শর্করার নিয়ন্ত্রণ মায়ের এবং শিশুর উভয়ের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন। সঠিক খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম, সময়মতো পরীক্ষা এবং ডাক্তারের পরামর্শের মাধ্যমে এই ঝুঁকিগুলি থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। গর্ভাবস্থাকে সুন্দর এবং সুখময় করে তোলার জন্য এই সতর্কতাগুলি অনুসরণ করা প্রতিটি মহিলার অধিকার এবং দায়িত্বও বটে।

Leave a comment