প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সম্প্রতি ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে জনসাধারণকে দৈনন্দিন জীবনে যোগকে অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁর বিশ্বাস, প্রতিদিন অন্তত ৪০ মিনিট যোগাসন করলে শুধুমাত্র শারীরিক শক্তিই বৃদ্ধি পাবে না, বরং বহু গুরুতর রোগ থেকেও রক্ষা পাওয়া যাবে। যোগকে শুধুমাত্র ব্যায়াম হিসেবে নয়, একটি সম্পূর্ণ স্বাস্থ্য টনিক হিসেবে দেখা উচিত। যোগ সম্পর্কিত এই আন্দোলন এখন গোটা দেশ জুড়ে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে এবং ইন্ডিয়া টিভিও এই দিকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আসুন জেনে নেওয়া যাক কিভাবে যোগ এবং সঠিক জীবনযাপনের মাধ্যমে আমরা নিজেদের সুস্থ ও নিরোগ রাখতে পারি।
যোগ: শুধু ব্যায়াম নয়, জীবনধারা
যোগের আবির্ভাব থেকে এ পর্যন্ত এর স্বাস্থ্যগত উপকারিতা বৈজ্ঞানিকভাবেও স্বীকৃত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও তাঁর বক্তব্যে এই বিষয়টিতে জোর দিয়েছেন যে, যোগ শুধুমাত্র শারীরিক ব্যায়াম নয়, বরং মানসিক ও আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্যেরও মাধ্যম। যোগের ফলে আমাদের শরীরের রক্ত সঞ্চালন উন্নত হয়, পেশী শক্তিশালী হয় এবং মন শান্ত হয়। যোগের নিয়মিত অনুশীলনের ফলে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ইত্যাদি রোগের ঝুঁকি অনেক কমে যায়।
এছাড়াও, যোগ ফুসফুস, লিভার এবং থাইরয়েডের মতো গুরুতর রোগের চিকিৎসা এবং প্রতিরোধেও সহায়ক। অস্টিওআর্থ্রাইটিসের মতো বয়সের সাথে সাথে দেখা দেওয়া সমস্যাগুলি থেকেও যোগের মাধ্যমে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। এই কারণেই প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীকে যোগের অভ্যাস গড়ে তোলার জোরালো আহ্বান জানিয়েছেন।
যোগের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে
আজ যোগ শুধুমাত্র ঘরের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। বড় বড় কর্পোরেট অফিস এবং স্টার্টআপগুলিও তাদের অফিসে যোগের জন্য নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করেছে। এর ফলে কর্মীদের স্বাস্থ্যের উন্নতি হয় এবং তারা মানসিক চাপমুক্ত থাকে, যার ফলে তাদের কার্যক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়। যোগের এই বর্ধমান জনপ্রিয়তা দেখে প্রধানমন্ত্রী মোদী মানুষকে যোগের চেইন তৈরি করার এবং যোগ সম্পর্কিত ভিডিও রিল তৈরিরও অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। যোগের এই চেইন ধীরে ধীরে গোটা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে, যার ফলে সকল শ্রেণির মানুষ যোগের সাথে যুক্ত হতে পারছে।
স্কুলগুলিতেও স্বাস্থ্য সচেতনতার নতুন উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে। কিছু স্কুলে ‘শুগার বোর্ড’ লাগানো হচ্ছে, যেখানে শিশুদের বলা হচ্ছে তারা কতটা চিনি সেবন করবে। এর ফলে শিশুদের মধ্যে কম বয়স থেকেই স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। এই ধরণের উদ্যোগের মাধ্যমে শিশুরা ডায়াবেটিস, স্থূলতা এবং অন্যান্য রোগ থেকে রক্ষা পেতে পারে, যা পরবর্তীতে তাদের জীবনে প্রভাব ফেলতে পারে।
যোগের এবিসিডি: সঠিক পদ্ধতি অবলম্বন করা জরুরি
যোগ করার আগে কিছু বিষয় বুঝে নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। যদি যোগ সঠিকভাবে না করা হয়, তাহলে এর সুবিধা কম হতে পারে বা আঘাত লাগতে পারে। যোগে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রক্রিয়া। সঠিক প্রাণায়াম করার ফলে শরীরে অক্সিজেনের প্রবাহ ভালো হয় এবং মানসিক চাপ দূর হয়।
যোগ করার সময় মনে রাখবেন খাওয়ার পরপর যোগ না করবেন। খাওয়ার কমপক্ষে ২ ঘন্টা পর যোগাভ্যাস শুরু করুন। যোগের সময়কাল ৩০ থেকে ৬০ মিনিটের মধ্যে হওয়া উচিত। যদি আপনি নতুন হন তাহলে প্রথমে হালকা আসন করুন এবং ধীরে ধীরে কঠিন যোগাসন গ্রহণ করুন।
শ্বাস-প্রশ্বাসের কৌশল (প্রাণায়াম), আসনের সঠিক পদ্ধতি এবং শরীরের সংকেত বোঝা জরুরী। যদি কোনও আসনের ফলে শরীরে টান বা ব্যথা হয় তাহলে অবিলম্বে থেমে যান। যোগের সময় ঝটকায় আসন পরিবর্তন করা বা দ্রুত উঠে দাঁড়ানো থেকে বিরত থাকুন।
কোন কোন রোগীর কোন কোন যোগাসন থেকে বিরত থাকা উচিত?
যোগ সবার জন্যই উপকারী, কিন্তু কিছু যোগাসন কিছু নির্দিষ্ট রোগীদের জন্য উপযুক্ত নয়। তাই যোগ করার আগে নিজের স্বাস্থ্য সম্পর্কে বুঝে নেওয়া এবং চিকিৎসক বা যোগ বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করা অত্যন্ত জরুরি।
হৃদরোগী ও যোগাসন: হৃদরোগীরা কিছু নির্দিষ্ট যোগাসন করা থেকে বিরত থাকুন। যেমন, চক্রাসন, হালাসন, সর্বাঙ্গাসন এবং শিরশাসন। এই যোগাসনগুলি হৃদয়ে অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করতে পারে। কপালভাতি ও ভস্ত্রিকা প্রাণায়াম যদি করেন তাহলে ধীরে ধীরে এবং সাবধানতার সাথে করুন।
উচ্চ রক্তচাপ ও যোগাসন: যদি আপনার রক্তচাপ বেশি থাকে তাহলে দণ্ড-বৈঠক, শিরশাসন এবং সর্বাঙ্গাসন যোগাসন করবেন না। এই যোগাসনগুলি রক্তচাপ বৃদ্ধি করতে পারে এবং সমস্যা আরও বাড়াতে পারে। তাই এ ধরণের যোগাসন থেকে বিরত থাকাই ভালো।
সার্ভিকাল রোগী ও যোগাসন: সার্ভিকালের সমস্যা থাকলে গলা বেশি বাঁকানো যোগাসন করবেন না। ঝটকায় আসনে আসা-যাওয়া থেকে বিরত থাকুন। যদি যোগ করার সময় মাথায় ব্যথা বা ঘোরাঘুরি শুরু হয় তাহলে যোগ বন্ধ করে দিন।
স্লিপ ডিস্ক ও যোগাসন: যদি আপনার কোমরে স্লিপ ডিস্কের সমস্যা থাকে তাহলে পাদহস্তাসন, ত্রিকোণাসন এবং উত্তানপাদাসন থেকে বিরত থাকুন। এই আসনগুলি কোমর এবং মেরুদণ্ডে অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করে, যার ফলে ব্যথা বাড়তে পারে।
সুস্থ জীবনযাপনের অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপায়
যোগের সাথে সাথে আরও কিছু অভ্যাস গড়ে তোলা জরুরি যাতে আপনার স্বাস্থ্য আরও উন্নত হয়। যেমন:
- আলোভেরা ও গিলয়ের রস: এগুলি প্রাকৃতিক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
- হলুদ মিশ্রিত দুধ: হলুদে প্রদাহ কমানোর উপাদান রয়েছে যা জয়েন্টের ব্যথা এবং অন্যান্য সমস্যায় উপশম দেয়।
- জিরা, ধনে, মৌরী, মেথি: এই মশলাগুলি হজম ও মেটাবলিজমের জন্য অত্যন্ত উপকারী।
- আজওয়াইনের পানি: এটি হজমতন্ত্রকে শক্তিশালী করে এবং শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ বের করে দেওয়ার কাজ করে।
- পর্যাপ্ত পানি পান করুন: প্রতিদিন অন্তত ৮-১০ গ্লাস পানি পান করুন। পানি শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ বের করে দেয় এবং কিডনির পরিষ্কার করে।
- চাপ ও উদ্বেগ কম করুন: চাপ স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক। যোগ, ধ্যান এবং প্রাণায়ামের মাধ্যমে এটিকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
- সঠিক সময়ে খাবার খান এবং জাঙ্ক ফুড থেকে বিরত থাকুন: নিয়মিত এবং সুষম খাবার শরীরকে সুস্থ রাখে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর যোগকে উৎসাহিত করার আহ্বান শুধুমাত্র একটি আনুষ্ঠানিক বক্তব্য নয়, বরং সুস্থ ভারতের দিকে একটি দৃঢ় পদক্ষেপ। যোগ ও সুস্থ জীবনযাপনের সঠিক মিশ্রণের মাধ্যমে আমরা শুধুমাত্র আমাদের শরীরকে সুস্থ রাখতে পারব না, বরং মানসিক চাপ থেকেও মুক্ত হতে পারব। যোগের সঠিক অনুশীলন, সুষম খাবার এবং স্বাস্থ্যকর অভ্যাসগুলিকে আপনার দৈনন্দিন জীবনে অন্তর্ভুক্ত করুন। এর ফলে শুধুমাত্র আপনিই নয়, আপনার পরিবারও দীর্ঘদিন সুস্থ ও সুখী থাকবে।