ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস (Indian National Congress, INC) এর প্রতিষ্ঠা দিবস প্রতি বছর ২৮শে ডিসেম্বর পালিত হয়। এই দিনটি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের গঠনের তারিখ, যা ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে এক প্রধান ভূমিকা পালনকারী রাজনৈতিক দল। কংগ্রেস পার্টির প্রতিষ্ঠা দিবস ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং ভারতীয় রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষ।
কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠার ইতিহাস
* প্রতিষ্ঠার তারিখ: ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা ২৮শে ডিসেম্বর, ১৮৮৫ সালে হয়েছিল।
* প্রতিষ্ঠার স্থান: এটি কলকাতা (তৎকালীন কলিকাতা), বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
* প্রতিষ্ঠাতা সদস্য: ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা কিছু ব্রিটিশ কর্মকর্তা এবং ভারতীয় নেতাদের সহযোগিতায় হয়েছিল। এর গঠন মূলত অর্ডিনারি নামক এক ইংরেজ কর্মকর্তা এবং অ্যালান অক্টোভিয়ান হিউম (Allan Octavian Hume)-এর তত্ত্বাবধানে হয়েছিল। এছাড়াও, ভারতীয় নেতাদের মধ্যে দার্শনিক ও লেখক দীনবন্ধু অ্যান্ড্রুজ, স্বামী বিবেকানন্দ এবং পন্ডিত জওহরলাল নেহরুর মতো ব্যক্তিত্বরাও এর প্রারম্ভে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন।
* প্রথম অধিবেশন: ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশন ১৮৮৫ সালের ২৮ ও ২৯শে ডিসেম্বর কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই সভার সভাপতিত্ব করেন উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।
উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের দিশা
* ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম: ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের সংগঠিত করা। কংগ্রেস ভারতীয়দের রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার রক্ষার জন্য একটি মঞ্চ প্রদান করেছিল।
* স্বরাজ: সময়ের সাথে সাথে কংগ্রেসের প্রধান উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায় "স্বরাজ" (স্বাধীনতা) অর্জন করা এবং ভারতীয়দের নিজেদের সরকার গঠনের অধিকার লাভ করা।
* সামাজিক সংস্কার: কংগ্রেস সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন কুপ্রথা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিল। জাতিভেদ, বৈষম্য এবং মহিলাদের অধিকারের জন্যও পার্টি সরব হয়েছিল।
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রধান ঘটনাবলী
* ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ: কংগ্রেসের প্রধান ঘটনাগুলির মধ্যে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ ছিল, যার বিরুদ্ধে কংগ্রেস প্রতিবাদ করেছিল।
* লবণ সত্যাগ্রহ (১৯৩০): মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস লবণ করের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে এবং স্বাধীনতার দিকে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেয়।
* ঔপনিবেশিকতা বিরোধী আন্দোলন: কংগ্রেস ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আন্দোলন শুরু করে, যেমন ১৮৫৭ সালের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম, ১৯৪২ সালের "ভারত ছাড়ো আন্দোলন" ইত্যাদি।
* ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে ভূমিকা: কংগ্রেস ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর নেতারা ভারতীয় জনমানসে সচেতনতা তৈরি করেন এবং স্বাধীনতা লাভের জন্য বিভিন্ন আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন।
কংগ্রেসের অবদান
* মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্ব: ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস মহাত্মা গান্ধীকে নেতৃত্ব দেয়, যিনি সত্যাগ্রহ ও অহিংসার মাধ্যমে ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামকে নতুন দিশা দেন।
* নেহেরুর সভাপতিত্ব: পন্ডিত জওহরলাল নেহরু, যিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের একজন প্রধান নেতা ছিলেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্ব প্রদান করেন এবং ভারতীয় গণতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপন করেন।
কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা দিবসের তাৎপর্য
কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা দিবস ভারতীয় রাজনীতি ও স্বাধীনতা সংগ্রামের তাৎপর্য উদযাপনের দিন হিসেবে বিবেচিত হয়। এই দিনটি দলের ইতিহাসকে স্মরণ করার, এর সংগ্রাম ও লক্ষ্যগুলিকে পুনরায় জীবিত করার সুযোগ। এই দিনে কংগ্রেস পার্টি তাদের আদর্শগুলিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করে এবং দলের নেতা, কর্মী ও দেশবাসীকে স্বাধীনতা সংগ্রামের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে উৎসাহিত করে।
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নীতিসমূহ
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস (INC) ১৮৮৫ থেকে ১৯০৫ সালের মধ্যে তাদের বার্ষিক অধিবেশনে যে প্রস্তাবগুলি পাশ করেছিল, সেগুলি ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয় জনগণের সমস্যা ও দাবি উত্থাপনের প্রাথমিক পদক্ষেপ। এই সময়ে কংগ্রেস 'নম্র প্রতিরোধের' নীতি অনুসরণ করেছিল। এর প্রস্তাব ও দাবিগুলি কয়েকটি প্রধান ক্ষেত্রে কেন্দ্রভূত ছিল:
১. নাগরিক অধিকার (Civil Rights)
* সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাকস্বাধীনতা: কংগ্রেস সংবাদপত্রের উপর নিষেধাজ্ঞা এবং অন্যান্য মাধ্যমে সেন্সরশিপ বন্ধ করার দাবি জানায়।
* শান্তিপূর্ণ সভা ও মিছিল: কংগ্রেস জনসভা, মিছিল এবং সংগঠনের স্বাধীনতাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করত।
* সামাজিক অধিকার: জনগণের সামাজিক অধিকারগুলি সুরক্ষিত করার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করা হয়।
২. প্রশাসনিক সংস্কার (Administrative Reforms)
* সরকারি চাকরিতে ভারতীয়দের অংশগ্রহণ: ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের একচেটিয়া ক্ষমতা শেষ করে ভারতীয়দের উচ্চ প্রশাসনিক পদে নিয়োগ করার আহ্বান জানানো হয়।
* কৃষকদের জন্য ত্রাণ ব্যবস্থা: কৃষকদের ঋণ কমানো এবং তাদের সাহায্যের জন্য কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেওয়া হয়।
* বৈষম্যমূলক আইনের বিরোধিতা: যে আইনগুলি ভারতীয় জনগণের বিরুদ্ধে বৈষম্য করত, সেগুলির বিরোধিতা করা হয়।
* জনকল্যাণ নীতির সূচনা: প্রশাসনের কাছে জনকল্যাণের জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবার উন্নতির দাবি জানানো হয়।
৩. সাংবিধানিক সংস্কার (Constitutional Reforms)
* আইনসভাগুলির ক্ষমতা বৃদ্ধি: আইন পরিষদগুলির আরও বেশি ক্ষমতা দেওয়ার দাবি করা হয়।
* নির্বাচিত ভারতীয় প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ: পরিষদগুলিতে আরও বেশি ভারতীয় সদস্যকে নির্বাচিত করার আহ্বান জানানো হয়।
* ব্রিটিশ সরকারের উপেক্ষা: ব্রিটিশ সরকার এই দাবিগুলিকে গুরুত্ব না দেওয়ায় কংগ্রেসের অভ্যন্তরে অসন্তোষ বাড়ে এবং এর নেতারা ধীরে ধীরে আরও সক্রিয় ও বিরোধী মনোভাব গ্রহণ করেন।
৪. অর্থনৈতিক সংস্কার (Economic Reforms)
* ব্রিটিশ নীতির সমালোচনা: ব্রিটিশ শাসনের নীতিগুলিকে ভারতীয় সম্পদের "অপচয় তত্ত্ব" (Drain of Wealth) এর কারণ বলা হয়।
* লবণ করের বিরোধিতা: কংগ্রেস লবণ কর তুলে দেওয়ার দাবি জানায়, কারণ এটি গরিবদের উপর সরাসরি বোঝা ছিল।
* শিল্প বিকাশের সমর্থন: আধুনিক শিল্প স্থাপনে উৎসাহিত করার দাবি জানানো হয়।
* সরকারি চাকরির ভারতীয়করণ: সরকারি ও জনসেবায় ভারতীয়দের অংশগ্রহণ বাড়ানোর প্রস্তাব পাশ করা হয়।
* দারিদ্র্য দূরীকরণ: কংগ্রেস জনগণের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থার উপর জোর দেয়।