প্রতি বছর ২১শে জুন বিশ্বজুড়ে ‘আন্তর্জাতিক যোগ দিবস’ পালিত হয়। এই দিনটি কেবলমাত্র যোগের প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্যকে সম্মান জানানোর সুযোগ নয়, বরং আধুনিক জীবনে মানসিক, শারীরিক ও আধ্যাত্মিক ভারসাম্যের প্রয়োজনীয়তাকেও তুলে ধরে। ২০২৫ সালে, এই দিবসটি আরও বিশেষ, কারণ করোনা মহামারীর পর যোগকে আলিঙ্গনকারীদের সংখ্যা বিশ্বজুড়ে দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে।
যোগ দিবসের সূচনা কীভাবে হল?
যোগের ঐতিহ্য ভারতে হাজার বছর ধরে চলে আসছে, কিন্তু আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এর স্বীকৃতি মিলেছে যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদী ২৭শে সেপ্টেম্বর ২০১৪ সালে জাতিসংঘ মহাসভায় যোগকে বিশ্বব্যাপী গ্রহণ করার প্রস্তাব দেন। তাঁর বক্তৃতায় তিনি বলেন যে, যোগ ভারতের অমূল্য ঐতিহ্য, যা শরীর, মন ও আত্মার মধ্যে ভারসাম্য স্থাপন করে এবং সমগ্র মানবতাকে একটি ইতিবাচক পথ দেখাতে পারে।
প্রধানমন্ত্রীর এই প্রস্তাবে ১৭৭টি দেশ সমর্থন দেয় এবং মাত্র ৭৫ দিনের মধ্যে জাতিসংঘ মহাসভা ২১শে জুনকে ‘আন্তর্জাতিক যোগ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে। প্রথম যোগ দিবস ২১শে জুন ২০১৫ সালে সমগ্র বিশ্বে পালিত হয়।
২১শে জুনের তারিখের বিশেষ গুরুত্ব
২১শে জুনকে যোগ দিবস হিসেবে নির্বাচন করা কোনও কাকতালীয় ঘটনা ছিল না। এটি বছরের সবচেয়ে দীর্ঘ দিন এবং সূর্যের উত্তরায়ণের সূচনা বলে মনে করা হয়। হিন্দু দর্শনের মতে, এই দিনটি আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য অত্যন্ত শুভ।
যোগের অর্থ ও গুরুত্ব
‘যোগ’ শব্দটি সংস্কৃত ‘যুজ্’ থেকে এসেছে, যার অর্থ – ‘যুক্ত করা’। যোগ কেবলমাত্র আসন পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি একটি জীবন ব্যবস্থা, যাতে শারীরিক, মানসিক, আবেগগত ও আধ্যাত্মিক বিকাশ ঘটে।
যোগ অনুশীলনের মাধ্যমে আমরা কেবল শরীরকে সুস্থ রাখি না, বরং মনকেও শান্ত ও স্থির রাখতে পারি। আজকের ব্যস্ত জীবনে যোগ মানসিক চাপ, উদ্বেগ, বিষণ্নতা ও অনিদ্রার মতো সমস্যা থেকে মুক্তি দানের কার্যকর উপায়।
যোগের প্রধান অঙ্গ
- যোগের আটটি প্রধান অঙ্গ রয়েছে, যাকে ‘অষ্টাঙ্গ যোগ’ বলা হয়:
- যম – সমাজের প্রতি নীতিবোধ
- নিয়ম – নিজের প্রতি অনুশাসন
- আসন – শারীরিক অবস্থান ও অনুশীলন
- প্রাণায়াম – শ্বাস নিয়ন্ত্রণ
- প্রত্যাহার – ইন্দ্রিয়ের সংযম
- ধারণা – মনকে একাগ্র করা
- ধ্যান – ধ্যান অবস্থায় স্থিরতা
- সমাধি – আধ্যাত্মিক ঐক্য ও ব্রহ্মজ্ঞান
যোগের সুবিধা: শরীর থেকে আত্মা পর্যন্ত
- শারীরিক স্বাস্থ্য: যোগের মাধ্যমে পেশী শক্তিশালী হয়, হাড় নমনীয় হয় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
- মানসিক শান্তি: যোগ চাপ ও উদ্বেগ কমায়। ধ্যান ও প্রাণায়ামের মাধ্যমে মন শান্ত থাকে।
- আবেগগত স্থিরতা: যোগ আবেগগত ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। এটি আত্ম নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
- জীবনযাত্রায় উন্নতি: নিয়মিত যোগের ফলে ঘুম ভালো হয়, খাদ্যাভ্যাস ভারসাম্যপূর্ণ থাকে এবং নেশা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
- আধ্যাত্মিক বিকাশ: যোগ ব্যক্তিকে আত্মজ্ঞানের দিকে নিয়ে যায় এবং জীবনের গভীর অর্থ বোঝার ক্ষেত্রে সাহায্য করে।
করোনা মহামারী ও যোগের ভূমিকা
করোনা মহামারী সমগ্র বিশ্বকে কাঁপিয়ে তুলেছিল। এই সময় যোগ মানুষকে শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে বড় ভূমিকা পালন করেছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ বাড়িতে বসেই যোগ অনুশীলন শুরু করে। ভার্চুয়াল যোগ ক্লাস, ইউটিউব টিউটোরিয়াল ও মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে যোগ ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে।
আন্তর্জাতিক যোগ দিবস ২০২৫-এর থিম
প্রতি বছরের মতো এবারও আন্তর্জাতিক যোগ দিবস একটি বিশেষ থিম নিয়ে পালিত হবে। এর আগে “যোগ: শান্তি ও সামঞ্জস্যের জন্য”, “ঘরে যোগ, পরিবারের সাথে যোগ” এবং “মানবতার জন্য যোগ” এর মতো থিম নির্বাচিত হয়েছে। ২০২৫ সালের জন্য সম্ভাব্য থিম “Yoga for Global Wellness” হতে পারে, যা সমগ্র বিশ্বের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যকে ভারসাম্যপূর্ণ ও সুদৃঢ় করার উপর জোর দেবে।
স্কুল ও তরুণদের মধ্যে যোগের ভূমিকা
আজকের তরুণরা সোশ্যাল মিডিয়া, স্ক্রিন টাইম ও অনিয়মিত জীবনযাত্রার কারণে অনেক শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় ভোগে। এমন পরিস্থিতিতে যোগ তাদের একটি নতুন দিক দেখাতে পারে। বিদ্যালয়ে যোগ শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা এই দিকে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। শিশুরা যদি প্রারম্ভ থেকেই যোগ শিখে তাহলে তাদের শারীরিক বিকাশের সাথে সাথে মানসিক ও আবেগগত বিকাশও উন্নত হবে।
বিশ্বজুড়ে যোগের জনপ্রিয়তা
আজ যোগ কেবলমাত্র ভারতে সীমাবদ্ধ নয়। আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও উপসাগরীয় দেশগুলিতেও লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রতিদিন যোগ অনুশীলন করে। বিশ্বের প্রধান বিশ্ববিদ্যালয় ও স্বাস্থ্য সংস্থা যোগকে একটি বিকল্প চিকিৎসা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। অনেক বিদেশী তারকাও যোগকে আলিঙ্গন করেছেন।
ডিজিটাল যুগে যোগ
ডিজিটাল মাধ্যম যোগের প্রচারকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। আজ হাজার হাজার অনলাইন কোর্স, মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন, ইউটিউব চ্যানেল ও ওয়েবসাইট পাওয়া যায়, যা মানুষকে যোগ শেখায়। COVID-19-এর সময় মানুষ অনলাইনের মাধ্যমে যোগ শেখা শুরু করে, যা আজও চলছে।
কীভাবে যোগ দিবস ২০২৫ পালন করবেন
- সকালে তাড়াতাড়ি উঠুন এবং উন্মুক্ত পরিবেশে যোগ অনুশীলন করুন।
- স্থানীয় যোগ শিবির বা সম্মিলিত যোগ সেশনে অংশগ্রহণ করুন।
- আপনার পরিবার ও বন্ধুদের যোগ করার জন্য অনুপ্রাণিত করুন।
- সোশ্যাল মিডিয়ায় যোগ সম্পর্কিত অভিজ্ঞতা শেয়ার করুন।
- স্কুল ও প্রতিষ্ঠানে যোগ প্রতিযোগিতা ও কর্মশালা আয়োজন করুন।
প্রধানমন্ত্রী ও নেতাদের অবদান
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও ভারত সরকার যোগকে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি দिलानेর জন্য অভূতপূর্ব প্রচেষ্টা করেছেন। যোগ দিবসকে সফল করার জন্য প্রতি বছর বিশেষ আয়োজন করা হয়, যাতে লক্ষ লক্ষ মানুষ অংশগ্রহণ করে।
ভারতের অমূল্য ঐতিহ্য
যোগ কেবলমাত্র ভারতের সাংস্কৃতিক পরিচয় নয়, বরং এটি বিশ্বকে ভারতের সবচেয়ে সুন্দর উপহার। এটি প্রমাণ করেছে যে, ভারতীয় জ্ঞান ঐতিহ্য আজকের যুগেও ঠিক ততটাই প্রভাবশালী।
আন্তর্জাতিক যোগ দিবস কেবলমাত্র একদিনের উৎসব নয়, বরং এটি আমাদের প্রতিদিন যোগকে আলিঙ্গন করার এবং সুস্থ জীবনযাপনের অনুপ্রেরণা দেয়। যোগ এমন একটি জীবনযাত্রা যা আমাদের শরীর, মন ও আত্মাকে একত্র করে। আজ যখন বিশ্ব অনেক সমস্যার সাথে লড়াই করছে, তখন যোগ শান্তি, সম্প্রীতি ও স্বাস্থ্যের পথ দেখাতে পারে।