সনাতন ধর্মে একাদশী ব্রতের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে, আর সেই সকল একাদশীর মধ্যেও যোগিনী একাদশীকে অद्वितীয় পুণ্যপ্রদಾಯিনী বলে মনে করা হয়। ২০২৫ সালে এই পবিত্র তিথি ২১শে জুন, শনিবার পড়ছে। এই ব্রত কেবলমাত্র ভগবান বিষ্ণুর কৃপা লাভের শ্রেষ্ঠ মাধ্যমই নয়, জীবনে বিরাজমান পাপ থেকে মুক্তি, সুখ-সমৃদ্ধি, আরোগ্যতা এবং মোক্ষ লাভের জন্যও উত্তম বলে মনে করা হয়।
যোগিনী একাদশীর গুরুত্ব কী?
যোগিনী একাদশী আষাঢ় মাসের কৃষ্ণপক্ষের একাদশী তিথিতে পালিত হয়। পুরাণিক শাস্ত্রে উল্লেখ আছে যে, যোগিনী একাদশীর ব্রত পালন করলে ৮৮ হাজার ব্রাহ্মণকে ভোজন করানোর সমান পুণ্য লাভ হয়। এই তিথি বিশেষ করে ভগবান বিষ্ণু এবং মা লক্ষ্মীর উপাসনার জন্য সংরক্ষিত থাকে। বিষ্ণুপুরাণ এবং পদ্মপুরাণে এই ব্রতের বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে, যেখানে যোগিনী একাদশীকে সবচেয়ে পুণ্যপ্রদ এবং মোক্ষদায়ক ব্রতগুলির মধ্যে একটি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশেষ করে যাঁরা এই দিনে ভক্তি ও শ্রদ্ধার সাথে ব্রত পালন করেন, তাঁদের জীবনে কখনওই অন্ন, ধন ও সুখের অভাব হয় না।
- যোগিনী একাদশী ২০২৫: তিথি, মুহূর্ত এবং পারণ সময়
- একাদশী তিথি আরম্ভ: ২১শে জুন ২০২৫ সাল সকাল ৭:১৯ টায়
- একাদশী তিথি সমাপ্তি: ২২শে জুন ২০২৫ সাল সকাল ৪:২৮ টায়
- ব্রত পালনের তিথি: ২১শে জুন ২০২৫ (শনিবার)
- পারণ তিথি: ২২শে জুন ২০২৫
- পারণের শুভ মুহূর্ত: দুপুর ১:৪৭ টা থেকে সন্ধ্যা ৪:৩৫ টা পর্যন্ত
- হরিবাসর সমাপ্তি: সকাল ৯:৪১ টায়
যোগিনী একাদশীর পৌরাণিক কাহিনী
পদ্মপুরাণে যোগিনী একাদশীর কাহিনীর উল্লেখ পুলস্ত্য মুনি এবং হেমবতীর সংলাপের মাধ্যমে পাওয়া যায়। কাহিনী অনুসারে, রাজা কুবেরের হেমমাণী নামে একজন মালী ছিলেন, যিনি প্রতিদিন ভগবান শিবের পূজার জন্য ফুল আনতেন। একদিন তিনি নিজের স্ত্রীর প্রেমে মত্ত হয়ে নিজের কর্তব্য ভুলে গেলেন। এতে ক্রুদ্ধ হয়ে কুবের তাকে কুষ্ঠরোগী হওয়ার শাপ দিলেন।
বনে বনে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে একদিন হেমমাণী মুনি মার্কণ্ডেয়ের সাথে দেখা করলেন। তিনি তার দুঃখের কথা শুনে তাকে যোগিনী একাদশীর ব্রত পালনের পরামর্শ দিলেন। হেমমাণী শ্রদ্ধার সাথে ব্রত পালন করলেন এবং তার সকল পাপ ক্ষয় হল, এবং তিনি আগের মতো সুন্দর দেহ পেয়ে মোক্ষ লাভ করলেন।
যোগিনী একাদশীর পূজা পদ্ধতি
- যোগিনী একাদশীর পূজা পদ্ধতি বিশেষ। ভক্তদের প্রাতঃ ব্রহ্মমুহূর্তে উঠে শুদ্ধ হয়ে সংকল্প নেওয়া উচিত।
- স্নানের পর হলুদ বাস্ত্র পরিধান করুন।
- ভগবান বিষ্ণুর প্রতিমা বা ছবির সামনে ধূপ-দীপ, ফুল, চন্দন, তুলসী-পাতা ইত্যাদি অর্পণ করুন।
- যোগিনী একাদশী ব্রত কাহিনীর পাঠ করুন।
- বিষ্ণু গায়ত্রী মন্ত্র এবং বিষ্ণু মঙ্গল মন্ত্রের জপ করুন:
- ॐ শ্রী বিষ্ণবে চ বিদমহে বাসুদেবায় ধীমহি। তন্নো বিষ্ণুঃ প্রচোদয়াত্॥
- মঙ্গলং ভগবান বিষ্ণুঃ, মঙ্গলং গরুড়ধ্বজঃ। মঙ্গলং পুণ্ডরীকাক্ষঃ, মঙ্গলায় তনো হরিঃ॥
- এই দিনে পিপুল গাছের পূজা এবং জল অর্পণ করাও অত্যন্ত শুভ বলে মনে করা হয়।
- সন্ধ্যায় আরতি, প্রসাদ বিতরণ এবং ভজন-কীর্তন করুন।
যোগিনী একাদশীর ব্রতের নিয়ম
- এই দিনে অন্ন ও চাল খাওয়া নিষিদ্ধ। এমনকি যারা ব্রত পালন করেন না, তাদেরও চাল খাওয়া উচিত নয়।
- নির্জলা ব্রত (জল পর্যন্ত না নেওয়া) পালনকারীদের জন্য এই দিনটি বিশেষ তপস্যার সুযোগ।
- চুল কাটা, দাড়ি কাটা অথবা নখ কাটা নিষেধ।
- ব্রাহ্মণদের অন্ন, বাস্ত্র বা দক্ষিণা দান করা বিশেষ পুণ্যপ্রদ।
- একাদশীর পারণ হরিবাসর শেষ হওয়ার পর করা আবশ্যক।
বৈষ্ণব সমাজে বিশেষ গুরুত্ব
- বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের অনুসারীরা এই দিনটি অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে পালন করেন। মন্দিরে বিশেষ হরি-কীর্তন, ভগবদ্গীতা পাঠ এবং প্রবচনের আয়োজন করা হয়। অনেক জায়গায় রাত জাগরণ এবং ভজনসন্ধ্যাও করা হয়।
- জীবনে ধন, ভোগ-বিলাস এবং ঐশ্বর্যের প্রাপ্তি হয়।
- পাপের ক্ষয় হয় এবং মোক্ষের পথ সুগম হয়।
- বিশ্বাস করা হয় যে, এই ব্রত পালন করলে পূর্বজন্মের পাপও ধ্বংস হয়।
- সন্তান সুখ, বিবাহ, চাকরি এবং ব্যবসা ইত্যাদি জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সাফল্য লাভ হয়।
যোগিনী একাদশী: বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি
আয়ুর্বেদের মতে, উপবাস করলে শরীর ডিটক্স হয়। একাদশী ব্রতে বিশেষ করে ফলাহার এবং জলের সেবন শরীরকে শক্তি প্রদান করে। মানসিকভাবেও এই দিনটি ধ্যান এবং চিন্তার উত্তম সময়। যোগিনী একাদশী কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় তিথি নয়, বরং আত্মার শুদ্ধি, কর্মের পরিপক্কতা এবং ঈশ্বরের সাথে যোগাযোগের একটি শক্তিশালী মাধ্যম।
২১শে জুন ২০২৫ সালে এই সুযোগ আবারও আসছে, যখন ভক্তগণ ভগবান বিষ্ণুর আশ্রয় নিয়ে জীবনের সকল বাধা থেকে মুক্তি পেতে পারেন। এই দিনটি প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য একটি সুবর্ণ সুযোগ, যারা আধ্যাত্মিক উন্নতি, পুণ্য সঞ্চয় এবং সুখময় জীবনের আশা করে।