শ্রীকৃষ্ণ মহাভারতে যুদ্ধ করেননি কেন?

🎧 Listen in Audio
0:00

মহাভারতের যুদ্ধ যত বিশাল ও বিধ্বংসী ছিল, ততটাই রহস্যময়ীও। এই যুদ্ধে যখনই আপনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকার দিকে তাকাবেন, তখনই তিনি সারথী হিসেবে চোখে পড়বেন – যোদ্ধা হিসেবে নয়। প্রশ্ন উঠে, আসলে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজে কেন যুদ্ধ করেননি? যখন তিনি পূর্ণ পুরুষোত্তম বিষ্ণুর অবতার ছিলেন, তখন তিনি অস্ত্র তোলা থেকে কেন বিরত ছিলেন? আর কেন শুধুমাত্র অর্জুনের সারথী হয়ে তাঁকে मार्গদর্শন দিয়েছেন?

শ্রীকৃষ্ণের বাক্য: ‘আমি যুদ্ধ করব না’

মহাভারতের যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে যখন উভয় পক্ষ – পান্ডব ও কৌরব – ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছে সাহায্য চাইতে এসেছিল, তখন শ্রীকৃষ্ণ খুব স্পষ্টভাষায় একটি শর্ত দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি এই যুদ্ধে কোনও অস্ত্র তুলব না, আর কারও সাথে যুদ্ধ করব না। আমার কাছে দুটি বিকল্প আছে – একটি আমার নারায়ণী সেনা আর অপরটি আমি নিজে, কিন্তু যুদ্ধ ছাড়া। তোমরা দুজনে যা চাও, তা বেছে নিতে পারো।’

দুর্যোধন শ্রীকৃষ্ণের বিশাল সেনাকে বেছে নিয়েছিল, অন্যদিকে অর্জুন ভগবান শ্রীকৃষ্ণকেই বেছে নিয়েছিল – যদিও তিনি যুদ্ধ করবেন না, কিন্তু তাঁর সাথে থাকাই তাঁর কাছে সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল।

শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের সারথীর কাজ করেছিলেন এবং অস্ত্র তোলা ছাড়াই পুরো যুদ্ধনীতি ও রণকৌশল অর্জুনকে শিখিয়েছিলেন। তিনি অর্জুনকে গীতার জ্ঞান দিয়ে তাঁকে ধর্ম, কর্তব্য ও জীবনের সঠিক পথ দেখিয়েছিলেন। এইভাবে শ্রীকৃষ্ণ যদিও যুদ্ধ করেননি, কিন্তু তিনিই অর্জুনকে বিজয়ী করেছিলেন।

নর ও নারায়ণের কাহিনী – অর্জুন ও শ্রীকৃষ্ণের পূর্বজন্মের রহস্য

শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুনের সম্পর্ক শুধুমাত্র মহাভারতে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং এর সম্পর্ক তাদের পূর্বজন্মের সাথেও জড়িত। পুরাণের কথামালা অনুসারে, এরা দুজনে নর ও নারায়ণ রূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তারা বদ্রীনাথে কঠোর তপস্যা করতেন এবং ভগবান বিষ্ণুর অংশ বলে বিবেচিত হতেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল – ধর্ম রক্ষা করা এবং পাপীদের ধ্বংস করা। সেই সময় একজন শক্তিশালী অসুর ছিল – দম্বোদ্ভব, যে সূর্যদেবের কঠোর তপস্যার ফলে ১০০০ কবচের বরদান পেয়েছিল। শর্ত ছিল যে, যে তার একটা কবচ ভাঙবে, তাকে ১০০০ বছর তপস্যা করতে হবে এবং তাকে মৃত্যুবরণ করতে হবে। এই বরদানের ফলে সে অহংকারী হয়ে উঠেছিল এবং দেবতাদেরকে বিরক্ত করতে শুরু করেছিল।

নর ও নারায়ণ সেই অসুরের মোকাবেলা করেছিলেন এবং পর্যায়ক্রমে তপস্যা করে ৯৯৯ কবচ ভেঙেছিলেন। প্রতিটি কবচ ভাঙার পর একজন তপস্যা করতেন এবং অপরজন যুদ্ধ করতেন। কিন্তু যখন শুধুমাত্র একটি শেষ কবচ বাকি ছিল, তখন দম্বোদ্ভব ভীত হয়ে সূর্যদেবের আশ্রয় নিয়েছিল। যেহেতু ভগবান বচনবদ্ধ থাকেন, সূর্যদেব তাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। পরে সেই অসুরই কর্ণ রূপে জন্মগ্রহণ করেছিল, এবং তারই বধ করার জন্য অর্জুনকে জন্ম নিতে হয়েছিল। শ্রীকৃষ্ণ এই বিষয়টি জানতেন, তাই তিনি বলেছিলেন যে এটি অর্জুনের যুদ্ধ – তিনি শুধুমাত্র मार्গদর্শক হবেন, যোদ্ধা নন।

তাই শ্রীকৃষ্ণ বলেছিলেন – ‘এই যুদ্ধ তোমার অর্জুন’

যখন দম্ভে ভরা দম্বোদ্ভব রাক্ষস হাজার বছর তপস্যা করে অনেক বরদান পেয়েছিল, তখন সে তার দেহকে হাজার কবচ দিয়ে সুরক্ষিত করে নিয়েছিল। দেবতারা তার অবসান ঘটানোর জন্য পরিকল্পনা করেছিল এবং তাকে পৃথিবীতে কর্ণ রূপে জন্ম নিতে হয়েছিল। কিন্তু তার শেষ কবচ ভাঙার মতো একজন ব্যক্তি হতে হবে, যে নিজেই হাজার বছর তপস্যা করেছে। নর অর্থাৎ অর্জুন সেই তপস্যা করেছিলেন, তাই শুধুমাত্র অর্জুনই কর্ণের বধ করতে পারতেন।

শ্রীকৃষ্ণ এই বিষয়টি ভালোভাবে জানতেন। তাই তিনি যুদ্ধের আগে অর্জুনকে স্পষ্ট করে বলেছিলেন – ‘এই যুদ্ধ তোমার অর্জুন, আমি শুধু তোমার मार्গদর্শন করব।’ তিনি নিজে অস্ত্র তুলেননি, বরং অর্জুনের সারথী হয়ে পুরো রণনীতির পরিচালনা করেছিলেন। তাই মহাভারতের যুদ্ধে শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকা ছিল मार्গদর্শকের, সেনাপতি বা যোদ্ধার নয়।

একবার শ্রীকৃষ্ণ কেন রথের চাকা তুলেছিলেন?

মহাভারত যুদ্ধে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্পষ্ট করে বলেছিলেন যে তিনি যুদ্ধে অস্ত্র তুলবেন না। কিন্তু এক সময় এমন হয়েছিল যখন ভীষ্ম পিতামহ অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে উঠেছিলেন এবং অর্জুনের উপর ভারী পড়তে শুরু করেছিলেন। এটা দেখে শ্রীকৃষ্ণ ক্রুদ্ধ হয়ে রথ থেকে লাফিয়ে উঠেছিলেন। তিনি মাটিতে পড়ে থাকা রথের চাকা তুলে নিয়েছিলেন এবং ভীষ্মের দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করেছিলেন। এটা দেখে অর্জুন ভয় পেয়ে তৎক্ষণাৎ শ্রীকৃষ্ণের চরণ ধরেছিলেন। সে তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল যে তিনি অস্ত্র না তোলার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন।

এই দৃশ্যটি অত্যন্ত আবেগঘন ছিল। শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের কথা মেনে নিয়েছিলেন এবং রথের চাকা ফেলে দিয়েছিলেন। এই ঘটনাটি দেখায় যে ভগবানের কাছেও বচন ও ধর্ম সর্বোচ্চ। তিনি নিজেও তাঁর বচন পালন করেন এবং আমাদেরকেও তাই শেখান – পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, যদি আপনি কোনও প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকেন তাহলে তা পালন করতে হবে।

জীবনের সার: যখন যুদ্ধ তোমার, তখন লড়াইও তোমাকেই করতে হবে

মহাভারতের যুদ্ধ শুধুমাত্র পান্ডব ও কৌরবদের মধ্যে ছিল না, বরং এটি প্রত্যেক মানুষের মধ্যে চলমান ভালো ও মন্দ সংগ্রামের প্রতীকও। এই যুদ্ধে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের রথ অবশ্যই চালিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি কখনো অস্ত্র তুলেননি। তিনি অর্জুনকে শিখিয়েছিলেন যে প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার জীবনের লড়াই নিজেই করতে হয়। ঈশ্বর পাশে থাকেন, কিন্তু তারা শুধুমাত্র मार्গদর্শন করেন – লড়াই তো আমাদেরকেই করতে হয়।

শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছিলেন – ‘এই যুদ্ধ তোমার। আমি শুধুমাত্র मार्গদর্শক, সারথী, কিন্তু যুদ্ধ লড়াই তোমাকেই করতে হবে।’ এই বাক্য শুধুমাত্র অর্জুনের জন্য নয়, সমগ্র মানবতার জন্য একটি গভীর বার্তা। যতক্ষণ আমরা আমাদের কর্ম ও দায়িত্ব থেকে পালিয়ে যাই না, ততক্ষণ ঈশ্বর আমাদের সাথে থাকেন। কিন্তু যদি আমরা ভয়ে বা ভ্রান্তিতে লড়াই থেকে পিছিয়ে যাই, তাহলে ভগবানও আমাদের সাহায্য করতে পারবেন না।

জীবনে অনেক সময় এমন সুযোগ আসে যখন আমাদের মনে হয় যে পথ কঠিন, চ্যালেঞ্জ বড়, আর কোনও সাহায্য নেই। সেই সময় আমাদের মনে রাখতে হবে যে সত্য ও ধর্মের পথে চলতে থাকা কেউ একা নয়। যদি আমরা নিষ্ঠা ও সাহস নিয়ে এগিয়ে যাই, তাহলে ভগবান নিজেই আমাদের সারথী হয়ে উঠবেন, যেমনটি তিনি অর্জুনের জন্য রথ চালিয়েছিলেন। यही আত্মবল, यही বিশ্বাস ও यही কর্মশীলতা জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা।

মহাভারত আজও প্রাসঙ্গিক কেন?

মহাভারত শুধুমাত্র একটি পুরোনো গল্প বা ঐতিহাসিক গ্রন্থ নয়, বরং এটি এমন একটি আয়না যার মধ্যে আজকের সমাজও স্পষ্টভাবে দেখা যায়। এতে যারা চরিত্র আছে – যেমন অর্জুন, দ্রৌপদী, কর্ণ, ভীষ্ম, এবং শ্রীকৃষ্ণ – তারা সবাই আমাদের চারপাশের মানুষের মতোই। তাদের মধ্যেও আবেগ, সংগ্রাম, মোহ, এবং ধর্ম-অধর্মের জটিলতা ছিল। অর্জুনের যুদ্ধের আগে ভয় পেয়ে যাওয়া, শ্রীকৃষ্ণের তাকে मार्গদর্শন দেওয়া – এ সব আমাদের আজকের জীবনে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার অনুপ্রেরণা দেয়।

ভগবদ্গীতা, যা মহাভারতেরই অংশ, আজও কোটি কোটি মানুষকে জীবনের পথ দেখায়। তাতে বলা হয়েছে – ‘কর্ম কর, ফলের চিন্তা কোরো না।’ এই কথাটি আমাদের শেখায় যে আমাদের কাজটি ইমানদারীপূর্ণভাবে করতে থাকো, তার ফল সময়মতো পাওয়া যাবে। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা হল – ‘অধর্মের বিরুদ্ধে দাঁড়াও, সত্যের জন্য লড়াই করো।’ এটি আজকের সময়েও ততটাই প্রয়োজনীয়, যখন অন্যায় ও দুর্নীতির মতো পরিস্থিতি দেখা দেয়।

শ্রীকৃষ্ণ যা গীতায় বলেছেন, তা হল ঈশ্বর সর্বদা ধর্মের সাথে থাকেন। যখন আমরা সত্য, ভালো ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াই, তখন ভগবান আমাদের সাথে থাকেন। তাই মহাভারত শুধু ইতিহাস নয়, জীবনযাপনের একটি গভীর শিক্ষা, যা আজও ততটাই সঠিক ও প্রয়োজনীয়।

Leave a comment