হিন্দু ধর্মে ব্রত ও ত্যাগের বিশেষ স্থান রয়েছে। এগুলি কেবল আধ্যাত্মিক উন্নতির মাধ্যমই নয়, জীবনে শৃঙ্খলা ও সমর্পণের भावনাও জাগ্রত করে। এমনই একটি কঠিন ও অত্যন্ত পবিত্র ব্রত হল নির্জলা একাদশী। এই ব্রতটি তার নাম অনুসারে ‘নির্জলা’, অর্থাৎ জল গ্রহণ না করে পালন করা হয়, যা তার কঠোর নিয়ম ও অপার ফলের জন্য বিখ্যাত। নির্জলা একাদশীর মাহাত্ম্য এত বড় যে, এটি পালনকারী বছরের সকল একাদশী ব্রতের সমপরিমাণ ফল লাভ করে।
নির্জলা একাদশী: ব্রতের মহত্ত্ব ও সময়
জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্ল পক্ষের একাদশী তিথিতে নির্জলা একাদশী পালিত হয়। ২০২৫ সালে এটি ৬ জুন, শুক্রবার পড়বে। এর প্রারম্ভ ৬ জুন প্রাতঃ ২:১৫ টায় এবং সমাপ্তি ৭ জুন প্রাতঃ ৪:৪৭ টায়। এই দিন ব্রতীরা জল গ্রহণ না করে পুরোদিন উপবাস পালন করেন, তাই একে নির্জলা (জল ছাড়া) একাদশী বলা হয়।
হিন্দু ধর্মশাস্ত্রে বলা হয়েছে যে, কোন ভক্ত যদি পুরো বছরের সকল একাদশী ব্রত পালন করতে না পারে, তবে কেবলমাত্র একবার নির্জলা একাদশী ব্রত পালন করে সকল একাদশীর ফল লাভ করতে পারে। এই ব্রতটি অত্যন্ত কঠিন হলেও সবচেয়ে ফলপ্রসূ বলে মনে করা হয়।
নির্জলা একাদশীতে করা পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ
ব্রতের সাথে সাথে কিছু বিশেষ কাজ করলে ব্রতী আরও বেশি ফল লাভ করে। আসুন জেনে নিই সেই পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ যা এই পবিত্র দিনে অবশ্যই করা উচিত।
১. ব্রত ও জল ত্যাগের সংকল্প করুন
নির্জলা একাদশীতে আহার ও জল ত্যাগ সবচেয়ে কঠিন। এটি তপস্যা ও সমর্পণের অনন্য দৃষ্টান্ত। ব্রতের শুরুতে স্নান করে, পরিষ্কার পোশাক পরে এবং ভগবান বিষ্ণুর ধ্যান করে সংকল্প নেওয়া উচিত। এই সংকল্পের সাথে মনের শুদ্ধি ও আত্মার পবিত্রতা লাভ হয়।
২. তুলসী পাতা দিয়ে ভগবান বিষ্ণুর পূজা করুন
তুলসী গাছ ভগবান বিষ্ণুর প্রিয় বস্তু। পূজায় তুলসী পাতার ব্যবহার অত্যন্ত শুভ বলে মনে করা হয়। তুলসী ছাড়া পূজা অসম্পূর্ণ বলে মনে করা হয়। পূজার সময় হলুদ ফুল, ছোলার ডাল, হলুদ মিষ্টান্ন ও পঞ্চামৃতের ব্যবহার করুন।
৩. গো-দান ও অন্যান্য বস্তুর দান করুন
দান পুণ্যের প্রধান উৎস। নির্জলা একাদশীতে বিশেষ করে গো-দান অত্যন্ত ফলপ্রসূ। এছাড়া জলপূর্ণ কলস, কাপড়, ছাতা, পাখা ও অন্নদানও শুভ ফল দেয়। বলা হয়, এই দিনে দান করা পুণ্য হাজারগুণ বৃদ্ধি পায়।
৪. ভগবান বিষ্ণুর কথা ও ভজন-কীর্তনে সময় কাটান
ব্রতের সময় বিষ্ণুভক্তকে মনকে ভক্তিতে নিয়োজিত করা উচিত। ভগবান বিষ্ণুর কথা শোনা, ভগবদ্গীতার পাঠ করা এবং ভজন-কীর্তন করা মানসিক শান্তি ও আধ্যাত্মিক উন্নতির পথ প্রশস্ত করে। ‘ॐ नमो भगवते वासुदेवाय’ মন্ত্র জপ করলে মনের একাগ্রতা বৃদ্ধি পায় এবং ব্রতের সাফল্য নিশ্চিত হয়।
৫. জলদান করুন
যখন নিজে জল গ্রহণ করা নিষিদ্ধ, তখন তৃষ্ণার্ত ও দরিদ্রকে জল দেওয়া একটি বড় পুণ্যকর্ম। এতে ব্রতের ফল দ্বিগুণ হয় এবং নিজের তৃষ্ণা নিবারণের সুযোগও হয় না। জলদান করলে জীবনে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি আসে।
পূজাবিধি
নির্জলা একাদশীর পূজাবিধি সহজ কিন্তু কার্যকর।
- প্রাতঃকালে স্নান করে পরিষ্কার ও হলুদ রঙের পোশাক পরুন।
- ভগবান বিষ্ণুর প্রতিমা বা ছবি স্থাপন করে তুলসীপাতা, হলুদ ফুল, চন্দন ও পঞ্চামৃত দিয়ে পূজা করুন।
- ‘ॐ नमो भगवते वासुदेवाय’ মন্ত্র জপ করুন এবং বিষ্ণুসহস্রনাম পাঠ করুন।
- পূজার পর ভগবানকে ভোগ নিবেদন করুন এবং আরতি করুন।
- দ্বাদশী তিথিতে সূর্যোদয়ের পর ব্রতের পারণ করুন।
নির্জলা একাদশীর লাভ
নির্জলা একাদশী ব্রত পালনকারী ধর্মগ্রন্থ অনুসারে অপার পুণ্য লাভ করে।
- এই ব্রত সকল একাদশীর সমপরিমাণ পুণ্য প্রদান করে।
- পাপনাশ করে এবং মোক্ষ লাভে সাহায্য করে।
- জীবনে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য লাভ হয়।
- সমৃদ্ধি, শান্তি ও সুখের আশীর্বাদ লাভ হয়।
- ঈশ্বরের কৃপায় मनোকামনা পূর্ণ হয় এবং জীবনে স্থিরতা আসে।
আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে নির্জলা একাদশী
এই ব্রত কেবল শারীরিক তপস্যা নয়, মানসিক ও আধ্যাত্মিক সংযমেরও প্রতীক। জল ত্যাগ করে ব্রত পালন আমাদের মধ্যে সহনশীলতা, সংযম ও ভগবানের প্রতি পূর্ণ সমর্পণের भावना জাগ্রত করে। এই কঠিন তপস্যায় মনের ইচ্ছাগুলি শান্ত হয় এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির পথ প্রশস্ত হয়।
নির্জলা একাদশী ব্রতকথা
নির্জলা একাদশীর কথা অত্যন্ত প্রাচীন ও অনুপ্রেরণাদায়ক। মহাভারত কালে ভীমসেন তার শক্তি ও বলের জন্য পরিচিত ছিলেন, কিন্তু তিনি জল ছাড়া একাদশী ব্রত পালন করতে পারতেন না কারণ তাঁকে খুব ক্ষুধা ও তৃষ্ণা লাগত। তখন মহর্ষি বেদব্যাস তাঁকে বললেন যে, তিনি বছরে কেবলমাত্র একবার নির্জলা একাদশী ব্রত পালন করুন। যদি তিনি এই ব্রত সঠিকভাবে পালন করেন তবে তিনি সারা বছরের সকল একাদশীর ফল পাবেন। এই ব্রত কঠিন কারণ এতে না জল পান করা যায়, না খাবার খাওয়া যায়, কিন্তু এর ফল অপরিসীম।
নির্জলা একাদশীতে ভক্ত জল গ্রহণ না করে পুরো তৃষ্ণা ও ক্ষুধা সহ্য করে ভগবান বিষ্ণুর পূজা করেন। এই দিন ব্রতী প্রাতঃকালে স্নান করে ভগবানের আরাধনা করেন, তুলসীপাতা দিয়ে পূজা করেন এবং সংকল্প নেন যে, তিনি পুরোদিন জল ও আহার থেকে দূরে থাকবেন। বলা হয়, এই ব্রত পালন করলে পাপ ক্ষয় হয় এবং ব্যক্তি সুস্থ জীবন ও মোক্ষ লাভ করে। এই ব্রত আত্মাকে শুদ্ধ করে এবং মনকে ভক্তিতে নিয়োজিত করে।
কথায় এও বলা হয়েছে যে, নির্জলা একাদশী ব্রত পালনকারী ব্যক্তি ভগবান বিষ্ণুর বিশেষ কৃপার অধিকারী হয়। তিনি তার জীবনে সুখ-শান্তি, সমৃদ্ধি ও সাফল্য লাভ করেন। এই ব্রতের ফলে ব্যক্তি পরবর্তী বছরের সকল একাদশীর সমপরিমাণ পুণ্য লাভ করে। তাই এই ব্রত কেবলমাত্র ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, জীবনে শৃঙ্খলা ও সংযমের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়।
নির্জলা একাদশী ব্রত কঠিন বলে মনে করা হলেও এর মাহাত্ম্য ও ফল অপরিসীম। এই ব্রত আমাদের শেখায় যে, সত্যিকারের বল ও সমর্পণ কী। কঠিনতার মধ্যেও ঈশ্বরের প্রতি অটুট শ্রদ্ধা ও ভক্তি দ্বারা আমরা আমাদের জীবনকে কেবলমাত্র শুদ্ধই করতে পারি না, সুখ, সমৃদ্ধি ও মোক্ষের দিকেও এগিয়ে নিতে পারি।